ভারতবর্ষের কিংবদন্তী এক বীরের সম্মানে লোককবি মুকুন্দ দাস একটি গান রচনা করেন -
--দশ মাস দশদিন পরে
জন্ম নেব মাসির ঘরে মাগো
তখন যদি না চিনতে পারিস
দেখবি গলায় ফাঁসি।
একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী।
বিংশ শতাব্দীর এমন শ্রোতা পাওয়া দুস্কর হবে যে এ গানটা শুনেননি। ১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সুভাষচন্দ্র চলচ্চিত্রে এই গানটিতে কন্ঠ দেন লতা মঙ্গেশকর , আর সেই গান শুনে চোখের জল ফেলেননি এমন বাঙালি বোধহয় খুব কমই আছেন।
গানের চরন পাঠে পাঠক অনুমান করে ফেলেছেন, কার কথা বলছি। হ্যাঁ ক্ষুদিরাম বসু। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের কনিষ্ঠতম বিপ্লবী ক্ষুদিরামের আজ জন্মদিন। যার জন্মের কথা বলতে গেলেও মৃত্যুর কথা চলে আসে।
তৎকালীন সময়ে বিহারের মুজাফ্ফরপুরের মেজিস্ট্রেট ছিলেন বড়লাট ডগলাস কিংসফোর্ড। কলকাতা প্রেসিডেন্সির চিফ মেজিস্ট্রেট থাকাকালীন বহু তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের নির্মম সাজা দিয়েছিলেন তিনি। অত্যাচারী এই ব্রিটিশ প্রশাসককে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীকে।
১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যায় ইউরোপিয়ান ক্লাবের গেটে কিংসফোর্ডের গাড়ির অপেক্ষা করছিলেন ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী। গাড়ি ক্লাবের গেটে পৌঁছলে, একহাতে বন্দুক তুলে তা থামান ক্ষুদিরাম। এরপর আরেক হাতে বোমা নিয়ে গাড়ি লক্ষ্য করে ছোড়েন। বিস্ফোরণে ৩ জনের মৃত্যু হয়। কিন্তু, তাঁদের মধ্যে কিংসফোর্ড ছিলেন না। মুজাফ্ফরপুরের বার অ্যাসোসিয়েশনের অ্যাডভোকেট প্রিঞ্জল কেনেডির পরিবারের সদস্যরা ওই বোমায় নিহত হন।
এরপরই প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরামের পিছনে ধাওয়া করে ব্রিটিশ পুলিশ। পরের দিনই পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ক্ষুদিরাম। কয়েকদিন পর মোকামঘাটের কাছে এক রেলস্টেশনে পুলিশের জালে ধরা পড়েন চাকী। কিন্তু, তিনি নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। আদালত দোষীসাব্যস্ত করে ক্ষুদিরাম বসুকে। ১৯০৮ সালের ১১ অগাস্ট ফাঁসি দেওয়া হয় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কনিষ্ঠতম বিপ্লবীকে।
ক্ষুদিরামের বিচারের সময় আশ্চর্যজনকভাবে দেখা যায় পশ্চিম বাংলা অর্থাৎ কলকাতা, মেদিনীপুর এসব অঞ্চলের কোনো উকিল তার পক্ষে দাঁড়াতে রাজি হননি। শেষে পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) রংপুর থেকে যাওয়া কয়েকজন উকিল লড়েছিলেন ক্ষুদিরামের পক্ষে। কোর্টে উকিলদের অনেক জোরাজুরিতে ক্ষুদিরাম আগে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেয়া জবানবন্দি বদলে নতুন জবানবন্দি দেন। যেহেতু প্রফুল্ল মারা গেছেন, তাই উকিলরা চেষ্টা করেছিলেন যদি তার উপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে ক্ষুদিরামের দণ্ড লঘু করা যায়!
কিন্তু এতেও লাভ হয়নি। ব্রিটিশরা বিপ্লবের প্রশ্নে কোনো রকমের ছাড় দেয়ার মতো অবস্থায় ছিল না। ক্ষুদিরামকে ফাঁসির সাজা শোনানো হয়। এরপর ১৯০৮ সালের এগারো আগস্ট ক্ষুদিরামের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা যায়, হাসিমুখে গর্বের সাথেই ক্ষুদিরাম বরণ করে নিয়েছিলেন ফাঁসির দড়িকে।
১৮৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর মেদিনীপুরের কেশপুরের মোহবনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ক্ষুদিরাম বসু। পিতা- ত্রৈলক্যনাথ বসু , মাতা- লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী। ক্ষুদিরামের জন্মের আগে ত্রৈলক্যনাথ ও লক্ষ্মীপ্রিয়ার দুই পুত্র সন্তান জন্মের পর পরই মারা যায়। সেকালের সংস্কার অনুযায়ী এই পুত্র সন্তানটি যাতে সুস্থ থাকে, তার জন্য তিন মুঠো খুদের বিনিময়ে নিজের বড় মেয়ের কাছে বিক্রি করে দেন ত্রৈলক্যনাথ বসু । খুদ দিয়ে কিনেছিলেন বলে দিদি অপরূপা দেবী ভাইটির নাম রাখেন ক্ষুদিরাম।
বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ১৩০ তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
তথ্য-:
https://bengali.oneindia.com/news/features
https://eisamay.indiatimes.com/
https://roar.media/bangla/