রাতের শেষ প্রহরে তিনটি সামরিক পিকআপ জিপ এসে দাঁড়ালো চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের গেটের সামনের রাস্তায়। একটি পিকআপ থেকে একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেলের কাঁধে র রকেট লঞ্চার থেকে ছুটে গেল একটি রকেট। ঘুমন্ত রাস্ট্রপতির কক্ষ তাক করে ছোড়া রকেটটি লক্ষভ্রস্ট হয়ে সার্কিট হাউজের ছাদের একাংশ উড়িয়ে নিয়ে গেল ।
তারপর আরেক মেজরের কাঁধে থাকা রকেট লঞ্চার থেকে আরেকটি রকেট ছুটে গিয়ে আঘাত হানল বাংলোতে ঢুকার দরজার ঠিক উপরে। আক্রমণকারীরা রাস্তা থেকেই আকাশে বাতাসে সাব মেশিন গানের গুলি ছুড়তে ছুড়তে সার্কিট হাউসের প্রধান প্রবেশ পথের দিকে এগিয়ে যায়, দৃশ্যত সার্কিট হাউসের প্রহরায় নিয়োজিত পুলিশ ও প্রেসিডেন্টস গার্ডস রেজিমেন্টের সদস্যদের ভয় দেখিয়ে নিষ্ক্রিয় করার উদ্দেশ্যে।
ঝড় বৃষ্টির পরে প্রহরীদের অধিকাংশই ঘুমিয়ে পড়েছিল। গুলির শব্দে ঘুম ছুটে গেলে তারা এলোমেলো গুলি চালাতে আরম্ভ করে, কিন্তু তা বেশিক্ষন অব্যাহত রাখতে পারেনা। প্রতিপক্ষের প্রবল আক্রমনের মুখে প্রধান প্রবেশ পথের পুলিশ প্রহরিরা অচিরেই অস্ত্র ফেলে দিয়ে উবু হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে। কিংবা বুকে হামা দিয়ে সরীসৃপের মত এদিক সেদিক পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন পালটা গুলি আসতে শুরু করে সার্কিট হাউসের বাংলোয় ঢুকার দরজায় প্রহরারত প্রেসিডেন্টস গার্ড রেজিমেন্টের সদস্যদের স্বয়ংকৃয় চীনা রাইফেল থেকে। আক্রমণকারীরা সেদিকে লক্ষ্য করে এক পশলা বুলেট বৃষ্টি ঝরালে পালটা গুলি আসা বন্ধ হয়ে যায়।
সামরিক যুবকেরা আকাশে বাতাসে গুলি বৃষ্টি ঝরাতে ঝরাতে পিকআপ ভ্যান শুদ্ধ ঢুকে পড়ে সার্কিট হাউসের লনের ভিতরে। দরজার সামনে এসে তারা দুপদাপ জিপ থেকে লাফিয়ে নামে; ডানে বামে সাব মেশিন গানের নল ঘুরিয়ে আবার ফাঁকা গুলি চালিয়ে বাংলোতে প্রবেশের মুল দরজার সামনের বারান্দায় উঠে পড়ে; সেখনে রক্তে ডোবা মেঝেতে গুলিবিদ্ধ দুই প্রহরীর দেহ লাফ মেরে ডিঙিয়ে যায়, এবং আকাশমুখি গুলি করতে করতে “কে কোথায় আছ হাতিয়ার ফেলে শুয়ে পড়” বলে চিৎকার করতে করতে ঢুকে পড়ে সার্কিট হাউসের মুল বাংলোর ভিতরে।
কিন্তু সিড়ির গোড়ায় দাঁড়ানো প্রেসিডেন্টস গার্ড রেজিমেন্টের সদস্যদের একজনের স্বয়ংকৃয় চীনা রাইফেল গর্জে ঊঠে, ফলে সঙ্গে সঙ্গে বিপরিত দিক থেকে এক ঝাক বুলেট ছুটে গিয়ে বিদ্ধ করে তাকে,এবং তার ছিন্ন ভিন্ন দেহটি সিঁড়ির পাশের দেয়ালে আছাড় খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগেই তার হাতের স্বয়ংকৃয় রাইফেল স্বশব্দে পড়ে যায় কাঠের মেঝেতে। গার্ড রেজিমেন্টের অন্য সৈন্যরা এদিক সেদিক পালিয়ে প্রান রক্ষা করে। আক্রমণকারী যুবকদের কয়েকজন অস্ত্র উঁচিয়ে নিচ তলার করিডোরের এ মাথা থেকে ও মাথা দাপিয়ে বেড়ায়। কয়েকজন চিৎকার করতে করতে একেক লাফে সিঁড়ির তিনটি করে ধাপ ডিঙিয়ে উঠে যেতে থাকে দোতলায়।
দোতলার করিডোরে কেউ নেই। প্রেসিডেন্টস গার্ড রেজিমেন্টের সদস্যরা নিজেদের প্রাণ নিয়ে সরে গেছে রাস্ট্রপতির স্যুইটের দরজা থেকে। হঠাত করিডোরের শেষ মাথার একটি কক্ষের দরজা খুলে যায়।স্বয়ংকৃয় চীনা রাইফেল হাতে বেরিয়ে আসেন প্রেসিডেন্টস গার্ড রেজিমেন্টের তরুণ অফিসার ছয় ফুট দীর্ঘ ক্যাপ্টেন হাফিজ। সিঁড়ির মাঝামাঝি থেকে ছুটে যাওয়া বুলেটের আঘাতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার আগে সে গুলি চালায় সিঁড়ি লক্ষ্য করে। সিঁড়িতে কঁকিয়ে ঊঠে আক্রমণকারী দলের ক্যাপ্টেন জামিল। কাঁধে গুলি খেয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেসে উপরের পাটির দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট জোরে কামড়ে ধরে বসে পড়ে সে।
করিডোরের শেষ মাথায় ক্যাপ্টেন হাফিজের রাইফেল থেমে যায় এবং খসে পড়ে হাত থেকে, কাঠের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে সে নিজের দেহ থেকে রক্ত নির্গমনের শব্দ শুনতে শুনতে শ্রুতির জগত অতিক্রম করে যায়।
আক্রমণকারী যুবকেরা এবার রাস্ট্রপতির কক্ষের সেগুন কাঠের ভারী দরজায় লাথি,ঘুশি ও কনুইয়ের ধাক্কা মারতে শুরু করে।
২/
চট্রগ্রামের মসজিদগুলির মাইক থেকে ফজরের আজান বেজে উঠার আগেই হঠাৎ রাস্ট্রপতির ঘুমন্ত দেহটি তড়াক করে স্বয়ংকৃয় ভাবে উঠে বসে।বিভ্রান্ত বড় বড় চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের ডানে বামে তাকিয়ে তিনি ঠাওর করার চেষ্টা করেন, তিনি এখন কোথায়? কোথাও কিছু বিস্ফোরিত হল কিনা, পৃথিবীটা কেঁপে উঠল কিনা। কিন্তু পর মুহুর্তে প্রচন্ড আরেক বিস্ফোরণে তাঁর এ স্নায়বিক বৈকল্য কেটে যায়। তিনি ধরতে পারলেন শব্দটা গোলা বিস্ফোরণের এবং নিজেকে আবিস্কার করলেন চট্ট্রগ্রাম সার্কিট হাউসে। তাঁর টনক নড়ে। কারণ সামরিক গোয়েন্দারা তাঁকে চট্ট্রগ্রাম আসতে বারন করেছিল।
ঝট করে তাঁর মনে ভেসে উঠল ডিজিএফআই এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাব্বতজান চৌধুরীর উদ্বিগ্ন মুখচ্ছবি। কাল সকালে তিনি যখন চট্ট্রগ্রামে আসার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, তখন মোহাব্বতজানের ফোন আসে- স্যার আপনার সাথে খুব জরুরি কথা ছিল।
- কি কথা বল।
- স্যার ওয়ান টু ওয়ান বলা দরকার,স্যার আমি কি এক্ষুনি আসতে পারি?
- আমিতো এয়ারপোর্টে যাচ্ছি।
- আপনি কি স্যার বাসা থেকে বের হয়ে গেছেন?
- না, এক্ষুনি বেরোব।
- তাহলে স্যার আমি আসি?
- আসো আসো, জলদি!
আসতে বললেন বটে, কিন্তু তাঁর জন্য রাষ্ট্রপতি অপেক্ষা করলেন না। চা শেষ না করেই উঠে কাপড় পরে নিলেন। তার পর বেরিয়ে পড়লেন।গাড়িতে উঠার মুহুর্তে মোহাব্বতজান চৌধুরী এসে হাজির। রাষ্ট্রপতি তাঁকে বল্লেন-‘তুমি আমার গাড়িতে উঠে বসো।এয়ারপোর্টে যেতে যেতেই শোনা যাবে কি এমন জরুরি কথা তোমার।‘
সেনানিবাসের মঈনুল রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে প্রেসিডেন্টের গাড়ী এয়ারপোর্টের দিকে এগিয়ে চলল। মোহাব্বতজান চৌধুরী রাস্ট্রপতিকে বললেন, ‘স্যার আজকের চিটাগাং ভিজিটটা কি ক্যান্সেল করা যায়না?’ তাঁর কন্ঠের আকুতি প্রেসিডেন্টের কাছে নাটুকেপনা মনে হয়। তিনি দেখে আসছেন বাড়তি সুনজর ও বদান্যতার লোভে প্রত্যেকটা লোক ভক্তি-ভালবাসার কী অভিনয়ইনা করে। বরাবরের মতই বিরক্ত হলেন তিনি। তাঁর জানা আছে সামরিক গোয়েন্দা প্রধান তাঁকে কি বলার জন্য এই সাত সকালে ছুটে এসেছেন। তাই মৃদু ভর্তসনার সুরে তাঁকে বল্লেন-‘ডোন্ট বি রিডিকুলাস। কি বলতে চাও পরিষ্কার করে বল।
- আমি স্যার এটাই বলতে চাইছি, প্লিজ ক্যান্সেল দা ভিজিট।‘
- হোয়াই?
- স্যার আমার লোকজন যতটা খবর পেয়েছে, চিটাগাং ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা মোটেই স্বাভাবিক না। ভীষণ অস্বাভাবিক এবং সন্দেহজনক।কিছু একটা কন্সপিরেন্সি হচ্ছে,আমি স্যার নাইন্টি নাইন পার্সেন্ট নিশ্চিত।ফ্রিডম ফাইটার অফিসারদের মুভমেন্ট,কথাবার্তা সবকিছু স্যার ভীষণ সন্দেহ জনক মনে হচ্ছে।
- ইউ এন্ড ইয়োর পিপল অলরেডি টোল্ড অল দিজ স্টোরিজ মেনি টাইমস,নাউ টেল মি ইফ ইউ হ্যাভ এনি কংক্রিট ইন্টেলিজেন্স; হোয়াট দেট কন্সপিরেন্সি? হু ইজ প্লটিং হোয়াট?
গোয়েন্দা প্রধান ঢোক গিললেন। তাঁর কাছে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সুনির্দিস্ট কোন গোয়েন্দা তথ্য নেই। তিনি কেবল সন্দেহের কথা বলতে এসেছেন, আর রাস্ট্রপতির জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে নিজের শংকা-উদ্বেগ জানাতে এসেছেন। রাষ্ট্রপতি তাঁর চোখে মুখে সেটাই দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু শঙ্কাতো নিছক শঙ্কা, কোন তথ্য নয়।
-স্যার ভিজিট ক্যান্সেল করা যদি একেবারেই সম্ভব না হয়,তাহলে স্যার ঠিক আছে। আই উইশ ইয়োর জার্নি বি সেফ। কিন্তু স্যার প্লিজ রাতে চিটাগাং থাকবেন না। মিটিং শেষ করে ঢাকায় ব্যাক করলেই স্যার ভাল হবে।
- তোমার আর কিছু বলার আছে?
- জি স্যার, ওখানে রাতে থাকাটা ঠিক হবেনা।
- আচ্ছা, আর কিছু?
- জি না স্যার, এটুকুই।
- পেছনে তোমার গাড়ি আছে না?
- জি স্যার আছে।
- আচ্ছা তুমি তাহলে এখানে এসো।
বিমান বন্দর পৌঁছানোর আগেই রাষ্ট্রপতি রাস্তার উপর গাড়ী থামাতে বললেন। মোহাব্বতজান চৌধুরী পেছনে থাকা নিজের গাড়িতে উঠে পড়লেন। প্রেসিডেন্টের গাড়ী বহর বিমান বন্দরের দিকে চলে গেল। গোয়েন্দা প্রধানের গাড়ি উল্টো ঘুরে ছুটে চলল তাঁর বাসভবনের দিকে।
এসব ভাবনা রাস্ট্রপতিকে কিংকর্তব্যবিমুঢ় করে দেয়। খাটের কিনারে তিনি থ হয়ে বসে থাকেন।
তখন তাঁর মাথার ভিতর কারা যেন চিৎকার শুরু করে, তারপর হঠাৎ শব্দ আসে মাথার বাইরে থেকে, দরজার দিক থেকে; তাঁর ঘাড় চট করে ঘুরে যায়, চোখ ছুটে যায় দরজার দিকে। দরজায় ধাক্কা পড়ছে; তিনি এগিয়ে জান দরজার দিকে--।
৩/
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে প্রেসিডেন্ট জিয়ার স্যুইটের দরজা খুলে যায়। বিস্ময় ও প্রশ্ন ভরা চোখে বেরিয়ে আসেন সাদা ধবধবে পাঞ্জাবী পরিহিত রাস্ট্রপতি। যুবকেরা তাকে ঘিরে দাঁড়ায়, কেউ কিছু বলতে চায়,রাস্ট্রপতিও তাদের কিছু বলতে চান। ঠিক তখন “জিয়া কোথায়? জিয়া কোথায়?” চিৎকার করতে করতে সিঁড়ি ভেঙ্গে যেন উড়ে আসে এক যুবক; রাস্ট্রপতি কোন কথা উচ্চারণ করার আগেই গর্জে উঠে যুবকটির হাতের চায়নিজ এসএমজি; মাগজিনের আটাশটি বুলেট একসঙ্গে বেরিয়ে এসে ঝাঁঝরা করে দেয় রাস্ট্রপতির পেট,বুক ও মুখমণ্ডলের এক পাশ।
অন্য যুবকেরা চিৎকার করে উঠে “কি করলেন? কি করলেন?”
একঝাঁক বুলেটের আঘাতে রাস্ট্রপতির দেহটি দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে গেল কাঠের মেঝেতে। মুহুর্তেই নিথর হয়ে গেলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। চোখের পলকে তাঁর পরনের ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী ভিজে উঠল টকটকে লাল রক্তে। তাঁর ছিন্ন ভিন্ন পেট,বুক,গলা ও মুখমণ্ডলের শিরা উপশিরা থেকে তিব্র বেগে রক্ত বেরিয়ে ফেনায়িত হতে থাকল।
সেনানিবাস থেকে আসা সশস্ত্র যুবকেরা এবার স্তম্ভিত ও বড় বড় চোখে পরস্পরের দিকে তাকায়।
“আপনারা এইটা কি করলেন?” বলে কেঁদে উঠে একজন।
সিঁড়িতে গোঙাতে গোঙাতে চেতনা হারাল গুলিবিদ্ধ ক্যাপ্টেন জামিল।তাকে কাঁধে তুলে নিল একজন। সিড়ি বেয়ে দুপদাপ নামতে শুরু করল সবাই।
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের দোতলার কাঠের করিডোরে রাস্ট্রপতির স্যুইটের দরজার কাছে রক্তে ভেজা কাঠের মেঝেতে নিথর পড়ে রইল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রাণহীন ছিন্নভিন্ন দেহ।
১৯৮১ সালের আজকের এই দিনে নিহত হন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান; মরহুমের জান্নাতবাস কামনা করছি।
(লকডাউন সময়ে মশিউল আলমের লিখা “দ্বিতীয় খুনের কাহিনী” বইটি পড়লাম।উপরের লেখাটি উক্ত বই থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত। জিয়া ও মঞ্জুর হত্যা কি এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের গল্প? প্রেসিডেন্ট জিয়া ও জেনারেল মঞ্জুর হত্যাকান্ডের ঘটনা নিয়ে গড়ে উঠেছে “দ্বিতীয় খুনের কাহিনী” বইটি। অনুসন্ধান ও গবেষণায় রুদ্ধদ্বার এ সত্য কাহিনী তুলে আনা হয়েছে ইতিহাসের অন্ধকার থেকে, এ কাহিনী গোয়েন্দা গল্পকেও হার মানায়।)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০২০ বিকাল ৩:৫৫