চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকায় (ইপিজেড) ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডটি যেন এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের নাম। এক মুহূর্তেই দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে বিশাল ভবনটি। হাজারো শ্রমিক ও কর্মকর্তার প্রাণ বাঁচাতে সেসময় সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে হয়েছে। ভ্যাগিস— ভাগ্যক্রমে— সবাই নিরাপদে ভবন থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। নয়তো আগুনের যে লেলিহান শিখা দাবানলের মতো পুরো ভবনজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, তাতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারতো। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি হয়তো আরেকটি অগ্নিদুর্যোগের মর্মান্তিক অধ্যায় হয়ে থাকতো।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষায়, শেষ মুহূর্তে তাপমাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে হাড়গোড় পর্যন্ত গলে যাওয়ার মতো ভয়ংকর ছিল পরিবেশ। আধুনিক প্রযুক্তি ও উচ্চমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দেশেও এমন অবস্থায় উদ্ধার কাজ কঠিন হতো। ঠিক এই সময়ে সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় ছিল কিছু তথাকথিত “হলুদ সাংবাদিকতা”—যাদের চোখে মানুষের নিরাপদে বেঁচে যাওয়া যেন এক ধরনের হতাশার কারণ! হতাহতের খবর না থাকায় তারা যেন সংবাদমূল্য খুঁজে পাচ্ছিল না। এক সাংবাদিক এমনকি এক প্রত্যক্ষদর্শীকে বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, “কি বলেন, একজনও আহত হয়নি?” তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “যেমনটা শুনছিলাম, এখন পর্যন্ত কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।” এই ঘটনাটি আমাদের মিডিয়া সংস্কৃতির নৈতিক দায়বদ্ধতার এক বেদনাদায়ক প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।
কিন্তু ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বন্ধ হয়ে গেলে যে বাস্তবতা শুরু হয়, সেটিই সবচেয়ে করুণ। আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে একটি সম্পূর্ণ শিল্প ইউনিট, যেখানে কাজ করতেন প্রায় হাজারখানেক শ্রমিক। রাতারাতি তাদের রুজিরোজগারের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। কোম্পানি পুনরায় উৎপাদনে ফিরবে কি না, সেটিও এখন অনিশ্চিত। যদি না ফেরে, তবে এ অগ্নিকাণ্ড শুধু এক ভবনের ক্ষতি নয়—বরং এক হাজারের বেশি পরিবারের জীবিকার ভিত্তি ধ্বংসের সমান।
বেপজা ও বেজা কর্তৃপক্ষের কাছে তাই জরুরি আবেদন—দয়া করে এই শ্রমিকদের ভুলে যাওয়া যাবে না। কোম্পানির বীমা থেকে মালিক হয়তো কিছু ক্ষতিপূরণ পাবেন, কিন্তু শ্রমিকদের ভাগ্যে কী আছে? আগুনের লেলিহান শিখা নিভে গেছে, কিন্তু জীবনের আগুন এখন জ্বলছে তাদের ঘরে। আজ যখন দেশে বেকারত্ব ক্রমশ বেড়েই চলেছে, তখন আরও এক হাজার বেকার যুক্ত হওয়া আমাদের অর্থনীতির জন্যও বড় আঘাত।
এই ঘটনার পর প্রয়োজন শুধু তদন্ত নয়, বরং একটি মানবিক উদ্যোগ—যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পুনর্বাসন, আর্থিক সহায়তা এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। তাদের জন্য একটি পুনর্বাসন তহবিল গঠন, স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে তা তদারকি এবং দ্রুত বাস্তবায়ন—এই মুহূর্তে সময়ের দাবি।
এই অগ্নিকাণ্ড কেবল একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি নয়; এটি এক দৃষ্টান্ত, যা আমাদের আবারও মনে করিয়ে দেয়—নিরাপত্তা, দায়বদ্ধতা ও মানবিকতার সমন্বয় ছাড়া টেকসই শিল্পায়ন সম্ভব নয়। আগুনের শিখা নিভে গেলেও, যেন আর কোনো শ্রমিকের জীবনের আলো নিভে না যায়—এটাই হোক আমাদের শিক্ষা ও অঙ্গীকার।

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০২৫ সকাল ১০:০১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


