somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হঠাৎ হাওয়ায় নির্বাপিত

৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২৯ ডিসেম্বর ২০১৬। অন্যান্য দিনের মতই সকালে ঘুম ভাঙ্গার পরেও একটা ঘুম ঘুম আমেজ নিয়ে কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে র’লো রুখসানা। বিছানায় শুয়ে শুয়েই স্মৃতির যাবর কাটতে থাকে। একদিন কত ব্যস্ত ছিল তার দিন! সেই সাত সকালে ঘুম থেকে ওঠা, বাচ্চাদেরকে স্কুলের জন্য তৈরী করা, স্বামী অফিস যাওয়ার আগে তার নাস্তাটা টেবিলে পরিবেশন করা, তারপর একে একে সবাই বেরিয়ে গেলে নিজের ঘর সংসারের কাজে মন দেয়া। এ ছিল এক দীর্ঘ রুটিন। প্রতিদিন রুদ্ধশ্বাসে সে এই রুটিন প্রায় বিরতিহীনভাবে পালন করেছে। আজ সে ব্যস্ততা নেই। স্বামী চাকুরী থেকে বেশ ক’বছর আগে স্বাভাবিক অবসর গ্রহণ করেছে। অবসরের পর কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা ব্যবসায়ে পুঁজি নিয়োগ করেছে, সেখান থেকে মোটামুটি একটা নিয়মিত লাভ আসে। পড়ুয়া স্বামী তার। অবসরের পরেও এখানে সেখানে বেশ আগ্রহভরে কয়েকটা অন লাইন কোর্স করেছেন। জার্মান ভাষাটা চাকুরীতে থাকতেই সেখানে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে ভালভাবে রপ্ত করেছিলেন। এর পরেও আরো দুটো আন্তর্জাতিক ভাষা শিখেছেন নিজ আগ্রহে। দু দুটো মাস্টার্সও করেছেন। চাকুরীকালে যেক’টা কোর্স করেছিলেন, সব ক’টাতে তার মেধার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। ঘরে যতক্ষণ থাকেন, বইপত্র নিয়েই থাকেন। তবে সংসারের প্রতি তিনি মোটেই উদাসীন নন। পরিবারের সবার ভালমন্দের প্রতি তাঁর তীক্ষ্ণ নজর।

সকাল সকাল রুখসানার মনে পড়লো, আজ রাতে একটা বিয়ের দাওয়াতে যেতে হবে। ওরা উভয়ে খুব সামাজিক জীবন যাপন করে বিধায় ডিসেম্বর-জানুয়ারীর প্রায় প্রতি রাতেই তাদের কোন না কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য বাইরে যেতে হয়। আলস্যভরে চা নাস্তা খেয়ে সে একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো এবং আগ্রহভরে ঠিক করতে শুরু করলো রাতের অনুষ্ঠানের জন্য নিজের এবং স্বামী সায়েফ এর পোশাক পরিচ্ছদ। এই শীতের মওশুমে অন্যান্যদিন সে বেলা দশটা নাগাদ নেমে পড়ে তাদের বাসার কাছেই পুকুরপাড়ে হাঁটার জন্য। আরো কয়েকজন বান্ধবী তথা স্বামীর বন্ধুপত্নীও নিয়মিত হাঁটেন সেখানে। তাদের সাথে হাঁটা এবং নৈমিত্তিক খোশগল্পে যোগ দিয়ে সে অনেক আনন্দ পায়। কিন্তু আজ আর ইচ্ছে হলোনা হাঁটার, যদিও ক্রমাগতভাবে বিয়ে বাড়ীর এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের তৈলাক্ত খাবার খেতে খেতে তার ওজন যে এ মাসে বেশ কিছটা বেড়ে গেছে, তা সে ওজন মাপক যন্ত্রের উপড় না দাঁড়িয়েও বেশ বুঝতে পারে।

সন্ধ্যের পর সে দ্রুত তৈরী হয়ে নিল। স্বামীও তার আগেই তৈরী হয়ে ছিল। কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে দেরীতে যাওয়াটা তাদের উভয়ের অপছন্দের ছিল। প্রথম ব্যাচে বসতে না পারলে অন্যের ধোওয়া প্লেটে তার আর খাওয়ার রুচিই হয় না। আর খাওয়া দাওয়ার পরে অন্ততঃ ঘন্টা খানেক ধরে ঘুরে ঘুরে পরিচিত সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ এবং কিছুটা গল্প গুজব করে তবে তারা ঘরে ফিরতো। মাঝে মাঝে যেদিন খোশগল্পের আসরটা দীর্ঘ হতো, সেদিন ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় বারটা পার হতো। আজও সে খাওয়া দাওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে গল্পগুজব করবে বলে মনস্থির করলো। ঠিক সময়মত তারা অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হলো। ক্লোজ কমিউনিটি বলে গাড়ী থেকে নামার পর থেকেই পরিচিতজনদের দেখা মেলে। তেমনি কয়েকজন পরিচিতের সাথে কথা বলতে বলতে তারা ফটকের দিকে এগোতে থাকলো। রুখসানার স্বামীকে দেখতে বেশ রাশভারী লোক মনে হলেও আদতে তিনি খুব আমুদে, বন্ধু বৎসল এবং আলাপী লোক। তাকে যারা চেনে এবং তার গল্পের পছন্দের বিষয় সম্পর্কে যারা জানে, তারা একবার তার সঙ্গ পেলে সহজে তা ত্যাগ করতে চায় না।

নৈশভোজের আয়োজন দোতলায় ছিল। সেখানে যাবার জন্য এস্কেলেটরে পা রাখার আগেই কেমন করে জানি সায়েফের হাত থেকে গিফটের প্যাকেটটা পড়ে যায়। সাথে সাথে সেটা হাতে তুলে নিয়ে এস্কেলেটরে উঠেই সায়েফ অনুভব করলেন, তার মাথাটা কেমন যেন একটা চক্কর দিয়ে উঠলো। আজকাল মাঝে মাঝেই তার এমন হয়, তাই তিনি এটাকে আমলে নিলেন না। দোতলায় উঠে বসার জন্য তিনি কাছেই একটা টেবিল নির্বাচন করলেন। বসার পর আশে পাশের লোকজনদের সাথে গল্পও শুরু করলেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কেমন যেন একটা অস্বস্তি! তখনো খাবার পরিবেশন করা শুরু হয়নি। হঠাৎ তার পাশে বসা কয়েকজন খেয়াল করলো, তার মাথাটা একদিকে যেন একটু কাৎ হয়ে পড়লো। কেউ কেউ তাকে জিজ্ঞেস করলো, তার কিছু হয়েছে কিনা। তিনি অস্ফূট স্বরে জানালেন, না তেমন কিছু নয়, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু লোকজন তার চেহারায় অস্বাভাবিকতা দেখে তাকে চেয়ার থেকে মেঝেতে নামিয়ে বসালো। কেউ কেউ তার জুতো খুলে দিল, কেউ টাই। তিনি নীচু স্বরে একটু পানি চাইলেন। তার কপালে ঘামের ফোঁটা দেখে এরই মধ্যে অনেকেই বুঝে নিল, একটা হার্ট এটাক আসন্ন! বিয়ের আসরে শোরগোল পড়ে গেল। কেউ একজন দৌড়ে পানি নিয়ে এলো। মাইকে ঘোষণা করা হলো কারো কাছে হার্ট এটাক প্রতিষেধক স্প্রে আছে কিনা, কোন ডাক্তার উপস্থিত আছেন কিনা ইত্যাদি। ইতোমধ্যে রুখসানা এসে তার মাথাটা নিজ কাঁধে নিল। আস্তে আস্তে গালে একটু প্যাট করে জেনে নিতে চাইলো সে ঠিক আছে কিনা। কিন্তু এরই মধ্যে ধীরে ধীরে তার কন্ঠ স্তব্ধ হয়ে আসলো। পরিচিত কয়েকজন সতীর্থ দ্রুত বেগে গাড়ী চালিয়ে দশ মিনিটের মধ্যে তাদেরকে হাসপাতালে নিয়েও এলো। কিন্তু জরুরী বিভাগের ডাক্তার তার নাড়ী, চোখ, হৃদস্পন্দন ইত্যাদি পরীক্ষা করে জানালেন, “Brought in dead”!

অনতিবিলম্বে তার শুভার্থী, সতীর্থ এবং পরিচিত শুভানুধ্যায়ীদের অনেকেই বিয়ের নৈশভোজ না করেই হাসপাতালে ছুটে এলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই যারপরনাই বিস্মিত, বিমূঢ়! সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত, যা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে রুখসানার মনে কী ঝড় বয়ে চলেছে, তা ভাবার সময় কার কোথায়? রুখসানা একটা বেঞ্চিতে বসে ফ্যাল ফ্যাল করে সবার অভিব্যক্তির দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইতোমধ্যে তার ছোট ছেলে সাকিব খবর পেয়ে হাসপাতালে এসেছে। বড় ছেলেটা বোধশক্তিহীন, তাই তাকে আনেনি। ঘটনার আকস্মিকতায় সাকিব বাকহীন, শুধু নিষ্পলক চোখে তার সদ্যমৃত পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এভাবেই ঘন্টা দুয়েক সময় ধরে তাদের ঘোরের মধ্যেই সায়েফের বন্ধুরা মৃতদেহ সৎকারের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতার প্রতি মনযোগী হলেন। রাতের মধ্যেই ঠিক করে ফেলা হলো আগামী কয়েকদিন ধরে কে কে তাদের বাসায় তিনবেলার খাবার পাঠাবে। রাত বারটার দিকে শুভানুধ্যায়ীগণ তাদেরকে বাসায় পৌঁছে দিলেন। তখনো রুখসানা আর তার পুত্রদ্বয় প্রচন্ড ঘোরের মধ্যে। তাদের অনুমানেও আসছিলনা, আকস্মিক এ ঘটনা তাদের জীবনে কতটা শুন্যতা আর দিকনির্দেশহীনতা নিয়ে আসবে।

পরদিন সকালে রিক্সাযোগে মাইকে যথারীতি ঘোষণা দিয়ে যাওয়া হলো, “….. নিবাসী জনাব অমুক গতরাত নয়টার সময় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেছেন। মরহুমের জানাযার নামায আজ বাদ জুম্মা অমুক মসজিদে অনুষ্ঠিত হবে……”। এ ধরণের ঘোষণা তাদের এলাকায় কিছুদিন পর পরই শোনা যায়। রুখসানা কখনো কান পেতে শোনে, তেমন পরিচিত কেউ না হলে আবার সাথে সাথে ভুলেও যায়। আজও সে কান পেতেই শোনার চেষ্টা করলো, কিন্তু কি আশ্চর্য, আজকের ঘোষণার কোন কথাই তার কানে প্রবেশ করলোনা। আবার অন্য কোনদিন, অন্য কারো ঘোষণা হয়তো সে শুনবে। আর মনে মনে ভাববে- সর্বনাশ! আজ আবার কার ঘরের সব আলো নির্বাপিত হলো? এলাকাবাসীর অনেকেই যে তার অতি আপনজন, অতি প্রিয়, প্রায় সাড়ে তিন যুগের সঙ্গী সাথীদেরই কেউ কেউ……!

(মূল ঘটনা সত্য, আনুষঙ্গিক বর্ণনা কিছুটা কল্পনাশ্রয়ী)

ঢাকা
৩০ ডিসেম্বর ২০১৬
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:১০
২৯টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×