somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোন একজন “হৃদয়ের” কথা

১৬ ই নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত কয়েকদিন ধরে বাসায় রঙের কাজ চলছে। গিন্নীর সখ, কোথাও কোথাও একটি করে দেয়াল ভিন্ন রঙের হবে। বেশ কয়েকদিন ধরে বার্জার পেইন্টস এর দোকানে দৌড়াদৌড়ি, ফোন করাকরির পর তিনি সাব্যস্ত করলেন, কোথায় কোন দেয়ালে কোন রঙ লাগানো হবে। আমার এ নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই, তবে ওঁর উৎসাহের মাত্রা দেখে কোন কিছুতে বাধাও দেই না। আমাদের শয়নকক্ষের একটি দেয়ালে অফ হোয়াইটের বদলে অন্য রঙ লাগানো হলো। রঙ শুকানোর পর দেখলাম, বাহ, বেশ ভালই তো লাগছে!

যে রঙমিস্ত্রী রঙের কাজ করছে, তার নাম 'হৃদয়', বয়স হয়তো হবে ২৮-৩০ (ওর ভাষ্য মতে, তবে ওদের জন্মের দিন তারিখ কেউ লিখে রাখেনা)। উজ্জ্বল ফর্সা চেহারা, বড় বড় দুটো চোখ। বেশীরভাগ কথার উত্তর শব্দের চেয়ে মুখের হাসি আর চোখের ভাষা দিয়ে দেয়। বাড়ী তার কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলায়। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। প্রথম দিন যখন ওকে একটা কাগজ কলম দিয়ে কি কি সামগ্রী কিনতে হবে তার একটি তালিকা লিখতে বললাম, সে একটু কাঁচুমাচু করে মুখে একটা লজ্জার হাসি দিয়ে কাগজটি আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, “স্যার আপনে লেহেন, আমি কইতাছি”। আমি একটু অবাক হ’লাম। এরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের আমার পরবর্তী প্রজন্মের নাগরিক। এখনো এই বয়সেও সম্পূর্ণ নিরক্ষর? কিন্তু ও লজ্জা পাবে বলে আর কথা বাড়ালাম না। ও ডিক্টেশন দিতে থাকলো, আমি লিখে চললাম।

এখন ঘরে সম্পূর্ণ বেসামাল অবস্থা। কোথাকার জিনিস কে কোথায় সরিয়ে রেখেছে, আমি কিছুই খুঁজে পাইনা। কোনমতে আমার ল্যাপটপটাকে সামলে রেখে এঘরে ওঘরে স্থানান্তরিত হই। কখনো বিছানায়, কখনো মেঝেতে বসে টুকটাক লেখালেখি করি। সেই সাথে মাঝে মাঝে হৃদয়ের সাথে রঙ বহির্ভূত বিষয়ে এটা সেটা নিয়ে কথাবার্তাও চালিয়ে যাই। আমার মনে সেই প্রথমদিন থেকে একটা প্রশ্ন গেঁথে আছে, যার বাবা মা এত সুন্দর একটা নাম রাখতে পারলেন, তারা কেন তাকে লেখাপড়া শেখালেন না? প্রথম দিনেই ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওর নামটা কে রেখেছিল। সে নীচুস্বরে বলেছিল, বাবা মা-ই রেখেছে। তারপরেই একটু হেসে আমাকে পাল্টা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কেন স্যার’? আমি বলেছিলাম, তোমার নামটা খুব সুন্দর তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম। সে আবার লাজুক হাসি হেসে আমার কমপ্লিমেন্টটা একনলেজ করেছিল।

আজ সকালে আবার এক কাপ চা হাতে 'হৃদয়' এর সাথে টুকটাক আলাপচারিতা হচ্ছিল। গিন্নী আমাকে বারবার সাবধান করে দিচ্ছিলেন, তুমি ওর সাথে এত কথা বললে ওর কাজের গতি কমে যাবে, কাজে মনযোগও থাকবেনা। তাই আমি আমার জিজ্ঞাসাগুলোকে একটু কাটছাঁট করে নিলাম। আলাপচারিতায় সে জানালো, ওর যখন স্কুলে ভর্তির বয়স, তখন ওর বাবা মা পৃথক হয়ে যায়। এতগুলো সন্তান নিয়ে ওর মা সমস্যার অতলান্তে নিমজ্জিত হতে থাকে। তাই আর ওর স্কুলে যাবার সুযোগ হয় নাই। শিশুকাল থেকেই সে কর্মজীবি। প্রথমে এসেছিল পুরান ঢাকার একটি চামড়ার কারখানায়। সেখানে অহরাত্রি অমানুষিক পরিশ্রম করতে হতো। মাস শেষে হাতে পেত মাত্র দু’হাজার টাকা, ব্যস আর কিছুই না। সেটা দিয়েই নিজের অন্ন সংস্থান করতে হতো, কিছুটা বাঁচলে মায়ের কাছে পাঠাতে হতো। এ কাজটা তার মোটেই ভাল লাগতো না। সে তার এলাকার একজন লোকের মাধ্যমে একদিন সুযোগ পেয়ে যায় দেয়ালে রঙের কাজ করার। তখন যমুনা ফিউচার পার্কের নির্মাণ কাজ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। সেখানে একটানা প্রায় দশ বছর কাজ করতে করতেই সে হাত পাকিয়েছে।

'হৃদয়' মাত্র একজন সহকারী নিয়ে নীরবে কাজ করে যায়। দিনশেষে কাজ গুটিয়ে আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে চলে যায়। তার চেহারায় কোন বেদনার ছাপ নেই, মুখে লেগে থাকা হাসিটুকু একজন সুখী, তৃপ্ত মানুষের পরিচয় ধারণ করে রাখে। তার সাথে আলাপচারিতায় বুঝেছি, সে একজন উদার হৃদয়ের মানুষ। তার জীবনে অপ্রাপ্তির কোন খেদ নেই। আমি একটু খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করাতে সে দার্শনিকের মত পাল্টা প্রশ্ন করে বলে, “স্যার, কারো ভাগ্যে কি দুনিয়ার সব সুখ লেহা তাহে? ভাগ্যের উপর কার আত আছে”? তার পিতাকে সে একজন ভাল মানুষ হিসেবেই জানে এবং মা থেকে পৃথক হওয়া সত্তেও তাকে শ্রদ্ধাও করে, কারণ তিনি আর অন্যত্র বিয়ে করেন নি।

যে দেয়ালে অন্য রঙ লাগানো হয়েছিল, তার পাশের দেয়ালটাতে আগের রঙ অফ হোয়াইট পুনঃলেপন করা হয়েছিল। সেটার প্রায় ৮০% পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে। উপরে ২০% এর মত খোলা থাকে। আমি আর গিন্নী বলাবলি করছিলাম, উপরের ওটুকু অংশেও পাশের দেয়ালের ভিন্ন রঙের প্রলেপ দিলে কেমন হবে। আমরা হৃদয়ের পরামর্শ চাইলাম। সে এক কথায় বলে দিল, “ইতায় সুন্দরতা দেহাইতো না”। আমরা অনেকটা জোর করেই তাকে দিয়ে নতুন রঙ করানো শুরু করলাম। কিছুটা করেই বুঝতে পারলাম, হৃদয়ের কথাই ঠিক, এতে “সুন্দরতা” দেখাচ্ছে না। পুনরায় আগের রঙে ফিরে যাবার প্রচেষ্টা শুরু হলো। আমরা হৃদয়ের “হৃদয়ের চোখ” টাকে এ্যাপ্রিশিয়েট করলাম।

ঢাকা
১৬ নভেম্বর ২০১৮
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।


হৃদয় - কাজের ফাঁকে একটুখানি চোখ তুলে এদিকে চাওয়া (চিত্রগ্রাহকের অনুরোধে)।


কাজে মগ্ন হৃদয়।


কাজে মগ্ন হৃদয় এর সহকারী নজরুল।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:২৯
৩৮টি মন্তব্য ৪৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×