অতিকথন অনেকের মুদ্রাদোষে পরিণত হয়। বিশেষ করে বয়স যত বাড়তে থাকে, এ প্রবণতাও মানুষের মাঝে পাল্লা দিয়ে ততই বাড়তে থাকে। আমার এক বাল্যবন্ধু আছে, জীবনের দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কেটে যাচ্ছে তার প্রবাস জীবন। অতিশয় সজ্জন, তুখোড় মেধাবী এবং পরিশ্রমীও বটে, তাই সাফল্য তাকে অলংকৃত করতে কার্পণ্য করেনি। কম বয়সে পিএইচডি করেছে, অনেক বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত থেকে প্রবাস জীবন কাটিয়েছে, কাটাচ্ছে! আমাকে নিয়মিত না হলেও বছরে কয়েকবার ফোন করে, হোয়াটসএ্যাপে মাঝে মাঝেই বার্তা পাঠায়, আমার কোন কোন পোস্টের পিঠে মন্তব্য করে এবং মাঝে মাঝেই তার নিবাসস্থলে বেড়িয়ে যাবার আমন্ত্রণ জানায়। কিছুদিন আগে হোয়াটসএ্যাপে ফোন করেছিল, আমি ধরতে পারিনি। বার্তা পাঠালো, কখন ফোন করলে আমি কথা বলতে পারবো তা জানতে চেয়ে।
উত্তর দিব দিব ভাবছিলাম, ইতোমধ্যে ‘স্পেস শর্টেজ’ এর কারণে আমাকে কয়েকবার সতর্ক করে একসময় আমার ফোন থেকে হোয়াটসএ্যাপ ‘বসে গেল’! প্রায় দু’দিন ফোন থেকে হোয়াটসএ্যাপ নিরুদ্দেশ ছিল। ফোন থেকে একটা বড় এ্যাপ ডিলিট করাতে স্পেসের কিছুটা সাশ্রয় হলো, আর সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হোয়াটসএ্যাপ ফিরে এলো, সেই সাথে ক্রিং ক্রিং শব্দ করে হাজির হয়ে গেল শতাধিক বার্তা, ছবি, ভিডিওক্লিপ আর ‘শুভসকাল এবং শুভসন্ধ্যা’র এবং পাল্টা জবাবের শুভেচ্ছাবাণী। তার মধ্যে সেই বন্ধুর উষ্মা মিশ্রিত বাণীও ছিল, অনেকটা “তোমার হয়েছে টা কী? এতবার ফোন করছি, মেসেজ পাঠাচ্ছি, উত্তর দিচ্ছ না কেন” টাইপের। হোয়াটসএ্যাপ ফিরে আসার পর গতকাল বিকেলে আমি তাকে একটা বার্তা পাঠালামঃ “আমার ফোন থেকে হোয়াটসএ্যাপ ‘বসে গিয়েছিল’। এখন ঠিক হয়েছে। মাগরিব এর নামাজের পর তোমাকে কল করবো”। কথা অনুযায়ী কল করলাম, এবারে সে ধরতে পারলো না। তবে মেসেজ দিয়ে জানালো, আজ একই সময়ে সে আমাকে কল করবে। কিন্তু এতটা সময় (অর্থাৎ আজ মাগরিবের পর) পর্যন্ত তার তর সয়নি। আজ সকালে একটা লেখা শুরু করেছি, এমন সময় তার কল এলো। এমনিতেই সে রাগ করে আছে, তাই আর যেন সে না চটে সেইজন্য আমি লেখা বন্ধ করে তাড়াতাড়ি ফোন ধরলাম।
ভেবেছিলাম, হয়তো কোন জরুরী কথা আছে তার। ‘কেমন আছো, ভালো আছো?’ এর পর সে নানা বিষয়ে কথা বলা শুরু করল, প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে। এমনিতেই সে যেসব প্রসঙ্গে কথা বলে চলেছিল, তাতে আমার তেমন আগ্রহ নেই, থাকলেও তা দু’চার কথাতেই সারা যায়। কিন্তু তার কথায় শ্রোতার কোন আগ্রহ আছে কিনা, সেটা গ্রাহ্য করার ব্যাপারে সে বরাবরই উদাসীন। আমি মনে করি সেটা তার নিছক উদাসীনতাই, কারণ অন্যান্য সব মাপকাঠিতে সে একজন নিপাট ভদ্রলোক। কথা একবার বলা শুরু করলে তার কথামালা ব্রেকফেইল গাড়ির মত চলতেই থাকে, তার উপরে আবার সে খুব আস্তে আস্তে কথা বলে। অধুনা বোধকরি আমার কানে কিছুটা সমস্যা হওয়ার কারণে আমি পাশে বসা মানুষের আস্তে বলা কথাও ভালভাবে বুঝতে পারি না, আর ফোনে আস্তে বলা কথা তো আরও পারি না। তথাপি আমি অনুমানের উপর ভর করে আস্তে আস্তে হুঁ হাঁ করে আমার মনযোগের প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তবে মনযোগ ধরে রাখতে খুবই বেগ পেতে হচ্ছিল। একটা সময় আমি ফোন কানে ধরে রেখে ল্যাপটপে কয়েকটা কবিতা পড়ছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, একসাথে দুটো কাজের কোনটাই ঠিকমত হচ্ছে না। তাই ফোনটা কানে চেপে ধরেই লেখার টেবিল ছেড়ে বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিলাম। একটা সময় পাঠক্লান্ত আমি নিজেই নিজের নাক ডাকার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু সে বলেই যাচ্ছিল। ‘নিশ্চুপ’ আমি এতক্ষণ ধরে লাইনে আছি কিনা, সেটাও সে যাচাই করার প্রয়োজন বোধ করছিল না। আমি ধড়ফড় করে উঠে বসলাম, কারণ আমার নাক ডাকার শব্দটা যদি সে শুনতে পায়, তবে সেটা হবে চরম অভদ্রতা।
একসময় ফোনে তাকিয়ে দেখলাম, কথোপকথন চল্লিশ মিনিট অতিক্রম করেছে। ভাবলাম, এবারে তা সাঙ্গ করার উদ্যোগ আমাকেই নিতে হবে। কিন্তু যখন কেউ নিজে থেকে ফোন করে, তাকে বিদায় জানানোর উদ্যোগ তো শ্রোতা নিতে পারে না, এটাই ভদ্রতা বলে জেনে এসেছি। তথাপি আমি একটু উসখুস করে তার প্রসঙ্গ থেকে দূরে সরে গিয়ে অন্য একটা প্রসঙ্গ উল্থাপন করলাম। সে বুঝলো না। অগত্যা অস্বস্তি সত্ত্বেও নীরব শ্রোতা হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। আবার একটু বেশি করে উসখুস করা শুরু করলাম। সে বুঝলো কিনা তা জানিনা, তবে এবারে সে বিদায়ী সম্ভাষণের প্রাথমিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো। সেটাও চললো প্রায় তিন চার মিনিট ধরে। তারপর এক শুভক্ষণে আমাদের কথোপকথনের (নাকি শুধু তার কথনের?) অবসান ঘটলো। হাতে ধরা ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি, ইতোমধ্যে আটচল্লিশ মিনিট কয়েক সেকেণ্ড আমার আজকের দিনপঞ্জী থেকে ক্ষয়ে গেল! তা যাক, বাল্যবন্ধু বলে কথা!
পোস্টের শিরোনামের সাথে একটু অপ্রাসঙ্গিক হলেও এই সুযোগে দুটো কথা বলে যেতে চাই। ডিজিটাল এই যুগে আমরা অনেকেই শুধু ফেসবুকেই নয়, হোয়াটসএ্যাপ, ভাইবারসহ আরও অনেক ভার্চুয়াল গ্রুপে হয়তো সংযুক্ত আছি। সেখানে প্রতিদিন বহু অনাকাঙ্খিত শুভসকাল, শুভসন্ধ্যা, শুভরাত্রি ইত্যাদির শুভেচ্ছাবাণী, মনীষীদের জ্ঞানগর্ভ বাণী, ‘ফরোওয়ার্ডেড এ্যাজ রিসিভড' মেসেজ, টিকটক ভিডিও ক্লিপ, দার্শনিক উদ্ধৃতি (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চুরি করা কিংবা উহ্য সূত্রের) পেতেই থাকি এবং কেউ কেউ হয়তো পাঠাতেও থাকি। এ বিষয়ে সবাই একটু সংযত হলে ভালো হয়। যদি জানা থাকে যে কেউ এসব পেতে বিশেষভাবে আগ্রহী, তবে তাকে ব্যক্তিগতভাবে পাঠানো যায়। অন্যথায়, এসব পাঠিয়ে গ্রুপসদস্যদের সবার স্টোরেজ স্পেস ক্লাটার (clutter) করা সংগত নয়। আর আমরা যারা ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে থাকি, নিজের প্রোফাইল লকড রেখে কখনও তা পাঠানো সমীচীন নয়। এবং চুপিসারে ছোট্ট একটি ক্লিক বা টাচের মাধ্যমে তা না পাঠিয়ে একটু 'হ্যালো হাই' বলে পাঠালে অনুরোধটা একটু বেশি গ্রহণযোগ্য হয়।
ঢাকা
২৯ অগাস্ট ২০২২
শব্দ সংখ্যাঃ ৭৯০
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০২২ রাত ১০:৪৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




