somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতিকথা- কাজলা দিদি

২৫ শে অক্টোবর, ২০২২ রাত ১২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘূর্ণিঝড় ‘সি-ত্রাং’ এর প্রভাবে আজ সারাদিন ধরে ঝিরঝিরে ঝরা বৃষ্টির প্রকোপটা বিকেল থেকে যেন বেড়ে গেল। থেকে থেকে দমকা হাওয়াও বইতে শুরু করলো। বিকেল পাঁচটার দিকে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাসার কিছুটা সামনে কয়েকটা বড় বৃক্ষ রয়েছে। সেগুলোর দিকে আমি প্রায়ই তাকিয়ে থেকে পাখিদের আনাগোনা দেখি। ঐসব গাছে প্রচুর টিয়া পাখি বসে। ঘন সবুজ পাতার সাথে মিশে যাওয়া টিয়া পাখিদেরকে শনাক্ত করার চেষ্টা করে চোখের পাওয়ার পরীক্ষা করি। কিন্তু কোন পাখি ওড়াউড়ি না করা পর্যন্ত তাকে চিনতে পারি না। তবে সহজে কাক চেনা যায়। সবুজের বিপরীতে কালো রঙ মিশ খায়না বলে কাক এবং বসন্তকালে কোকিলকেও বেশ চিনতে পারি। আজও সন্ধ্যায় দূর থেকে কয়েকটা ভেজা কাককে শনাক্ত করতে পেরেছি।

রাতে এশার নামায ব্যালকনি’র পাশে দাঁড়িয়েই পড়ে নিলাম। নামাযের পর জায়নামাযে বসেই কিছুক্ষণ আকাশ ও গাছপালার দিকে তাকাচ্ছিলাম। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছিল, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎও চমকাচ্ছিল। বৃষ্টির হাল্কা ঝাপ্টা এসে গায়ে লাগছিল, সেটা বেশ আরামদায়ক ছিল বলে স্লাইডিং ফ্রেমটাকে ইচ্ছে করেই বন্ধ করিনি। এসব দিনে, এমন পরিবেশে আমার মনটা হাল্কা মেঘের মত স্মৃতির আকাশে ভেসে বেড়ায়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। তবে আজ আমার শৈশবের একটি দুঃখজনক স্মৃতির কথা স্মরণ করে ভারাক্রান্ত হ’লাম।

এবারে আমার শৈশবের সেই ছোট্ট গল্পটা বলি। সেটা আজ থেকে প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগের কথা। ছোটবেলায় স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পর আমরা প্রতিবছর নানাবাড়ি-দাদাবাড়ি বেড়াতে যেতাম। রুটে প্রথমে নানাবাড়ি পড়তো, তারপরে দাদাবাড়ি। দুটোই ছিল দশ-বার কি.মি. এর মধ্যে। নানাবাড়ি ছিল লালমনিরহাট জেলার সদর উপজেলার হাড়িভাঙ্গা গ্রামে, দাদাবাড়ি একই জেলার আদিতমারি উপজেলায়। আমি তখন হয়তো বড়জোর পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। সেবার একই সময়ে আমার মেজ খালাও নানাবাড়ি এসেছিলেন। আমার চেয়ে দেড় বছরের ছোট এক খালাতো ভাই ছিল, তার চেয়েও দেড় বছরের ছোট এক খালাতো বোন ছিল, যার নাম ছিল রানী। অর্থাৎ রানী আমার চেয়ে বছর তিনেকের ছোট ছিল। ওরা ছাড়াও নানাবাড়িতে আমার ছোট খালাও এসেছিলেন, তার বড় ছেলেটাও আমার থেকে বছর তিনেকের ছোট ছিল । সেবারে আমরা খুব আনন্দে নানাবাড়িতে কাটিয়েছিলাম। সারাদিন ধরে নানা ধরনের খেলা খেলতাম, গাছের বড়ই পেড়ে খেতাম। পাখির বাসা খুঁজতাম, চড়ুইভাতি খেলতাম। একটা পেয়ারা গাছ ছিল যেটার ডালপালা এমনই সুবিন্যস্ত ছিল যাতে আমরা চার পাঁচজন সহজেই গাছে চড়ে একেকজন একেকটা ডালে বসতে পারতাম। আমরা ডালে বসে পেয়ারা চিবাতাম আর নানা রকমের গল্প করতাম। একদিন এ রকমের গল্প করার সময় নানার বাড়িতে আগন্তুক এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “এই বানরেরা, তোরা সবাই গাছে বসে কী মীটিং করছিস”? গল্প ছাড়াও আমরা যে যার মত গলা ছেড়ে গানও গাইতাম, আবার কবিতাও আবৃত্তি করতাম। তখন 'কাজলা দিদি' কবিতাটা আমাদের সমবয়সী সবারই মুখস্থ ছিল। আমরা সুর করে কবিতাটি আওড়াতাম (‘আমরা’ আবৃত্তি করতাম বললে ভুল হবে, সেজন্যই ‘আওড়াতাম’ বললাম। আমাদের মধ্যে একমাত্র রানীই খুব সুন্দর করে আবৃত্তি করতো। বাকি আমরা যা করতাম, তা আবৃত্তি হতো না।)।

স্কুল খোলার সময় হয়ে যাওয়াতে আমাদের সুখের দিনগুলো খুব দ্রুত পার হয়ে গেল। আমরা ঢাকায় ফিরে এলাম, রানীরা খালুর কর্মস্থল কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারিতে চলে গেল। এর কয়েকমাস পরে নানার চিঠিতে এক ভয়ানক দুঃসংবাদ পেলাম। তখন তো ঢাকা থেকে মফস্বল এলাকার সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি অথবা বড় জোর টেলিগ্রাম। চিঠিতে নানা জানিয়েছিলেন যে রানী হঠাৎ করে সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। আমরা যখন চিঠিটি পেয়েছিলাম, ততদিনে মারা যাওয়ার দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। এই দুঃসংবাদটি আমার বালক মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। আজও মনে পড়ে সেদিন আমি খুব কেঁদেছিলাম। বেশি করে কেঁদেছিলাম নানার চিঠির ঐ অংশটুকু পড়ে, যেখানে তিনি লিখেছিলেন যে মৃত্যুশয্যায় রানী কয়েকদিন ধরে অনবরত, এমনকি ঘুমের মধ্যেও 'কাজলা দিদি' কবিতাটি আওড়াতো। এমনিতেই 'কাজলা দিদি' একটা দুঃখের কবিতা। তার উপর মৃত্যুশয্যায় রানী'র অনবরত এ কবিতাটি আওড়ানোর তথ্যটা আমার অপরিণত মানসে শেলের মত বিঁধেছিল। সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমি আর কখনো এই কবিতাটি পাঠ সম্পূর্ণ করতে পারি নাই। জীবনের এ দীর্ঘ চলার পথে অনেক সময় অনেকবার অনেক জায়গায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কণ্ঠে সুর করে এ কবিতা পাঠের শব্দ শুনে আমি থমকে দাঁড়িয়ে শুনেছি, তারপর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আবার পথ চলা শুরু করেছি। কখনো হয়তো নীরবে দু'ফোঁটা চোখের জলও ফেলে এসেছি।

ঢাকা
২৪ অক্টোবর ২০২২
শব্দসংখ্যাঃ ৬২১

সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০২৩ রাত ১:৩৫
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×