অবশেষে স্বগৃহে
প্রায় চৌত্রিশ ঘণ্টার উড্ডয়ন ভ্রমণ শেষ করে (ডোর টু ডোর) অবশেষে গত পরশু রাত দেড়টার সময় স্বগৃহে পৌঁছালাম। এতটা দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি ও অবসাদে তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম। বাসায় ফিরে গোসল করার পর কিছুটা ফ্রেশ লাগছিলো। কোনরকমে সামান্য খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়লাম। এর পরের প্রায় দুই দিন ঘুমের কোন টাইম টেবল ছিল না। ঘুমের ফাঁকে ফাঁকে জেগে উঠলে নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু কিছু কাজ সেরে আবার ঘুম। ঘুমের ঘোরে ছিলাম বলেই হয়তো জেগে থাকা সত্ত্বেও গত রাতের ৫.২ মাপের ভূমিকম্পের কাঁপনও অনুভব করতে পারিনি। অথচ এর আগে ৪.২ থেকে ৪.৮ মাত্রার ভূমিকম্পও বেশ ভালো ভাবেই অনুভব করেছিলাম। আজ ভোরে জেগে উঠে মনে হলো ঘুমের ঘোর কেটে গেছে। চিরচেনা স্থানীয় মাসজিদে গেলাম ফজরের নামায পড়তে। নামায শেষে গাড়িতে গ্যাস ভরে আনলাম, সকাল সকাল হওয়াতে লাইনে অপেক্ষা করতে হলো না। কিছু কাঁচাবাজারের ফরমায়েশ ছিল। অত সকালে স্থানীয় কাঁচাবাজার ঠিকমত বসেনি। কেবল দুই একজন বিক্রেতা মাত্র তাদের ঝাঁপি সাজাচ্ছিল। সেখান থেকেই ফরমায়েশি ফর্দের যে কয়টি আইটেম পেলাম, কিনে বাড়ি ফিরে এসে ল্যাপটপ খুলে বসলাম। গত তিনদিনে এটা বন্ধ ছিল। গতরাতে মুঠোফোনে বার্তা পেয়েছি, একজন এলাকাবাসী ইন্তেকাল করেছেন। এখন মাইকিং হচ্ছে, আজ বাদ যোহর আমাদের জামে মাসজিদে তার জানাযা হবে। এ রকম বার্তা পেলে আমি সাধারণতঃ চেনা হোক, অচেনা হোক, কারও জানাযা মিস করি না। আলোচ্য ব্যক্তি আমার অচেনা ছিলেন, তবুও তার জানাযায় আজ উপস্থিত থাকবো বলে মনস্থ করেছি।
চলতি পথের রম্য
১১ অগাস্ট ২০২৩। ভোর চারটার সময় রিজাইনা এয়ারপোর্টে এসে দেখি আমাদের ফ্লাইট দেড় ঘণ্টা বিলম্বে ছাড়বে। বাসা থেকে রওনা হবার সময় তাড়াহুড়ার কারণে সেলফোনে ফ্লাইট স্ট্যাটাসটা দেখার কথা খেয়াল ছিল না। যাহোক বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলোনা। আধ ঘণ্টার মধ্যেই চেক-ইন কাউন্টার খুলে গেল এবং স্টাফরা তাদের কাজ শুরু করলো। নির্বিঘ্নেই চেক-ইন সম্পন্ন হলো এবং যথাসময়ে ওয়েস্ট জেট এর ফ্লাইট WS606 এর বিমানটিতে আসন গ্রহণ করলাম। প্লেনে যাত্রীদের আসন গ্রহণের পর সেফটি সিকিউরিটি বিষয়ক যেসব ঘোষণা আসে, এতদিন দেখেছি পর্দার অন্তরাল থেকে কেউ একজন পাবলিক এ্যানাউন্সমেন্ট ইকুইপমেন্টে (পিএ ইকুইপমেন্ট নামে বহুল পরিচিত, সোজা কথায় 'মাইক'

তিনি টেকোমাথা ছিলেন, মুখে মাস্ক পরিহিত। প্রথমেই তিনি বললেন, "আমি জানি আপনারা এই হ্যান্ডসাম লোকটির পুরো মুখটা না দেখা পর্যন্ত তৃপ্তি পাচ্ছেন না" - এই বলে তিনি মুখের মাস্কটি সরিয়ে ফেলে একটি আকর্ণবিস্তৃত হাসি দিলেন। যাত্রীরাও সহাস্যে করতালি দিয়ে তাকে সম্ভাষণ জানালেন। তারপর তিনি বললেন, "মাঝে মাঝে যাত্রীদের সাথে কথা বলার সময় দুই একটি জোক পরিবেশন করার অনুমতি আমাকে কর্তৃপক্ষ দিয়েছেন, এমনকি হাল্কা এডাল্ট জোকও। তাই আমি আজ একটি জোক দিয়ে আমার বক্তব্য শুরু করবো। তবে আমি লক্ষ্য করেছি আজকের ফ্লাইটে বহু স্কুলছাত্র টরন্টো যাচ্ছে, তাই আমি আজ কোন এ্যাডাল্ট জোক বলবো না"। যাত্রীরা আবারও সহাস্যে করতালি দিলেন। তারপর তিনি সেফটি ইভাকুয়েশন নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত জোক বললেন এবং এর পরেই শুরু হলো ঘোষণার সাথে রুটিন ডেমোন্সট্রেশন। এরপর যতবার তিনি সামনে এসেছেন, যাত্রীদের সাথে হাস্যরসের সাথে কথা বলেছেন। তার শেষ কথার পর যাত্রীগণ পুনর্বার সহাস্যে করতালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানান। প্লেন ত্যাগ করার সময় অনেক যাত্রী তার হাস্যরসের প্রশংসা করে তাকে ধন্যবাদ জানালেন।
এবারে এমিরেটস এর টরন্টো-দুবাই ফ্লাইট EK242 এর একটি ঘটনা। ফ্লাইট সামান্য পরেই দুবাই বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে অবতরণ শুরু করবে বলে পাইলট জানালেন। ঘোষণাটি শুনে মাঝখানে চার আসনের রো'তে বসা এক তরুণী তার আসনের নীচে এবং চারপাশে কী যেন খোঁজাখুজি শুরু করলেন। তার অভিব্যক্তি দেখে বুঝলাম, তিনি তার কাঙ্খিত বস্তুটি খুঁজে পান নি। খানিক পরে তিনি একজন বিমানবালার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। বিমানবালা কোমর বাঁকিয়ে ঝুঁকে পড়ে খানিকক্ষণ খুঁজলেন, কিন্তু তিনিও কোন কিছু পেলেন না। আসনের সামনের স্ক্রীনে মাঝে মাঝে নির্দেশ আসছিল যে কারও সেলফোন নীচে পড়ে গেলে যাত্রীগণ যেন নিজেরাই সেটা খোঁজার চেষ্টা না করে কেবিন ক্রুর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আমি তাই ভেবেছিলাম, হয়তো মেয়েটির সেলফোন নীচে পড়ে গেছে এবং সেটাকে খোঁজা হচ্ছে। সেই বিমানবালা খানিক পরে একজন হ্যান্ডসাম পুরুষ স্টুয়ার্ডকে ডেকে নিয়ে এলেন। সৌভাগ্যক্রমে সে সময়ে মেয়েটির পেছনের সারির চারজনের মধ্যে তিনজন যাত্রীই ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য আসন ত্যাগ করেছিলেন। সেই যুবক তাই একেবারে নীচে হাঁটু গেড়ে বসে জিনিসটি খোঁজার সুযোগ পেয়েছিলেন। মুহূর্তেই তিনি তার হাতে একটি জুতো নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাকে দেখে আমার সে মুহূর্তে মনে পড়েছিলো শরৎ চন্দ্রের গল্পের সেই বিখ্যাত উক্তি – "আমার আরেক পাটি পাম্প"!
ছেলেটি মিষ্টি হেসে সেই মেয়েটির সামনে গিয়ে হাঁটু ভেঙে জুতো ধরা হাতটি প্রসারিত করে বললেন, "ইওর শ্যু"। মেয়েটি স্মিত হেসে তাকে যখন ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন, সেই আরব যুবক তখন আরও মিষ্টি করে হেসে বললেন, "মাদাম, ইতস এ সিন্দ্রেলা স্তোরি"!
ঢাকা
১৫ অগাস্ট ২০২৩
শব্দ সংখ্যাঃ ৭৩৭