somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার দীপুদা- ৪

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কানাঘুষায় শুনতে পাই, বিয়ের পর থেকেই নাকি দীপুদাদের সংসারে অশান্তি লেগেই আছে। মা চাচী ফুফুরা প্রায়ই তাদেরকে নিয়ে মুখরোচক গল্প তোলে। বউ নাকি রাগ করে প্রায়ই তার বাবার বাড়ি চলে যায়। গন্ডগোলটা মূলত মেজো ফুপুর সাথেই। দীপুদা মায়ের অন্ধ সমর্থক তাই এত সমস্যা। এমনিতেই মেজ ফুপুর মাঝে চরম ডমিনেটিং স্বভাব রয়েছে সেটা আমাদের সকলেরই জানা। কাজেই এইসব গল্পে বউ এর থেকে মা চাচীরা মেজো ফুপুর একরোখা বদরাগী স্বভাবকেই দায়ী করে। আমি শুনবো না শুনবো না করেও কানে এসে যায় এসব। আসলে একটা সময় দীপুদার কথা উঠলেই আমি কান খাড়া করে ফেলতাম। তার প্রতি এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষন আমাকে নিজের অজান্তেও তার নামের আদ্যাক্ষরেও মনোযোগী করে তুলতো। সেই সুতীব্র আকর্ষনটা আমার আজও আছে কিনা আমি যাচাই করে দেখতে যাই না তবে কোথাও একটি তার ছিঁড়ে গেছে তেমনটাই মনে হয় আমার।

আমার ঢাকা ভার্সিটির ভর্তি ফলাফল বের হয়। আমি অর্থনীতিতে ভর্তি হয়ে যাই। আমার সামনে তখন নতুন দিন, নতুন জগৎ, নতুন নতুন আবির্ভাব ও আবিষ্কার। আমার হলের সিনিয়র রুমমেটকে দেখে আমি অবাক হই। এতটুকু পুচকে পাচকে মেয়েটার সে কি মানষিক শক্তি। সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত মেয়েটি যখন এক মাঠ জনসন্মুখে শ্লোগান দেয় আমি ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখি। ওর শ্লোগানগুলো যেন এক একটি অজর কবিতা, অবিনাষী গান। আমি সদা সর্বদা একটু মুখচোরা স্বভাবের কাজেই এসব আমার কাছে স্বপ্নের মত লাগে। টি এস সির কবিতা সমাবেশ, গানের আসর রোজ বিকেলের আড্ডা নতুন এক জীবনের দ্বার খুলে যায় আমার চোখের সামনে। ঘনিষ্ঠ বসে থাকা জুটিদেরকে দেখে কখনও কখনও হঠাৎ হঠাৎ আমার দীপুদাকে মনে পড়ে। দীপুদার পাশে কখনও এইভাবে বসে থাকা হলো না আমার। একটাবারও হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া হলো না। নিজের অজান্তেই বুকের মাঝে জমে থাকে দীর্ঘশ্বাসের ঝাঁপি। তবে দীপুদাকে এসব মুহুর্তে মনে পড়লেও দীপুদার জন্য লুকানো সেই অসহ্য কষ্টটাকে আমি বেশ চাঁপা দিয়ে ফেলেছি বলেই মনে হয় আমার।

হল, ভার্সিটি, ক্লাস, চটপটি ফুচকা, মধুর ক্যান্টিন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এই গতীময় চলমান দিনগুলিতে আমি মিশে যাই দিনে দিনে। বন্ধু নির্বাচনে আমি বরাবর খুব বেশি সিলেকটিভ ছিলাম এখনও আছি। তবুও এক দল হৈ হুল্লোড় বন্ধুদের দলে আমি ভিড়ে যাই।ভার্সিটি লাইফ আমাকে আমার অতীত জীবন থেকে অনেক অনেক দূরে নিয়ে যায় যেন।আমার অতীতের সকল অভিজ্ঞতা, নানা রকম ভালো লাগা মন্দ লাগারাও বদলে গিয়ে নিত্য নতুন আবিষ্কারে মগ্ন হয়ে উঠি আমি। হল জীবনে নিজের দায়িত্ব নিজে নেওয়া, বাজার করা, রান্না করে খাওয়া বা ক্যান্টিনে খাওয়া সবই আমি উৎসাহ নিয়ে করি। মাঝে মাঝেই বাড়ির জন্য সেই প্রথম দিককার মত মন খারাপ করা ভাবটাও চলে গেছে আমার। হলের ট্যালটেলে পানি ডাল আর মোটা চালের বিস্বাদ ভাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি বেশ। এখানে এই বিদ্যাপীঠে পড়ালেখা করতে আসলেও আমার সবকিছুই কেমন উৎসব ঊৎসব লাগে। ফাল্গুনে বইমেলা, বসন্ত উৎসব, পহেলা বৈশাখ বা বিজয় দিবসে বা প্রতিটা উৎসবেই যেন প্রাণ পেয়ে ওঠে এই ভার্সিটি চত্বর। জীবনের জয়গান যেন প্রতিনিয়ত গেয়ে চলেছে এক ঝাঁক সবুজ প্রাণ......

ঈদের ছুটিতে বাড়ি গিয়ে শুনি দীপুদারা সেপারেশনে আছে। বউ নাকি ডিভোর্স চেয়েছে। দু এক মাসের মধ্যেই তাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে। জানিনা কেনো যেন এ সংবাদে ভীষন মন খারাপ হয় আমার। আরও শুনি, মেজো ফুপু তার নামে উল্টা মামলা করেছে বাড়ি থেকে গহনা ও অর্থকড়ি আত্মসাতের। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয় মেজো ফুপুর এটা বানানো গল্প। ঐ মেয়েটার উপরে প্রতিশোধ নিতেই ফুপু এই মামলা সাজিয়েছে। বউটাকে যতটুকু দেখেছি একজন দৃঢ় চরিত্রের মানুষ বলেই মনে হয়েছে আমার। মেজো ফুপুর প্রতি আমার মন ঘৃনায় ভরে ওঠে কিন্তু এরপর একদিন মেজো ফুপু এক আশ্চর্য্য প্রস্তাব নিয়ে আসে। সে বউকে ডিভোর্স করিয়ে দিয়ে দুই মাসের মাঝে ছেলেকে বিয়ে করাতে চায় এবং বউ হিসাবে সে আমাকে দেবার জন্য বাবা মাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরে। মা রাজী ছিলেন না তার অবিবাহিতা মেয়েটার সাথে এই রকম একবার বিয়ে হওয়া ছেলেকে বিয়ে দিতে কিন্তু মেজো ফুপু নাছোড় বান্দা। বাবাকে রাজী করিয়েই ছাড়ে। বাবা আমার সন্মতি নিতে আসেন। আমি স্থবির বসে থাকি।

মেজোফুপু আমাকে নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন। হাউ মাউ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। মেজোফুপুর কান্ড দেখে আমি চরম বিস্মিত হয়ে পড়ি। তিনি আমার হাত দুটো ধরে বার বার আমার কাছে ক্ষমা চান। তিনি বলেন সৃষ্টিকর্তা তাকে শাস্তি দিয়েছেন। এই মেয়েকে ফুপু নিজে পছন্দ করে বিয়ে দিয়েছিলেন এবং দীপুদা তখন এই বিয়েতে রাজী হননি এবং রাজী না হবার কারণ হিসাবে উনি আমাকেই উনার পছন্দের কথা জানিয়েওছিলেন কিন্তু ফুপু তখন রাজী হননি। আত্মীয়ের মাঝে বিয়ে চাননি উনি আর তাই তিনি তখন সে কথা চেপে গিয়ে এই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে এনেছিলেন, যার ফল ভালো হলো না। এই পরিনতি নিয়ে এলো। উনি আমাকে বার বার রিকোয়েস্ট করেন আমি যেন সব ভুলে গিয়ে এই বিয়েতে রাজী হই। আমি হতবাক বসে রইলাম। ফুপু অধৈর্য্য হয়ে উঠছিলেন। আমাকে বার বার তাগাদা দিচ্ছিলেন উনাকে কথা দিতে,
- তুই আজই আমাকে কথা দে। প্লিজ আমাকে ফিরাবি না বল প্লিজ.....
আমি দীর্ঘশ্বাস চেপে বললাম,
- তার আগে আমি দীপুদার সাথে একবার কথা বলতে চাই ফুপু .....


অনেক রাতে দীপুদার ফোন এলো। আমি এই ফোনটার অপেক্ষাতেই ছিলাম। এতক্ষন দু চোখের পাতা এক করিনি আমি। বহুদিনের বহু প্রতিক্ষীত এই ফোন। অপর প্রান্তে দীপুদার গলা।
- হ্যালো, হ্যালো
আমি নিশ্চুপ বসে রইলাম। আমার বুকের মাঝে কথার পাহাড় কিন্তু কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি। অথচ দীপুদাকে আমার অনেক কথা বলার ছিলো, আছে এবং থাকবেও বাকী জীবন...
দীপুদা বললেন,
- আমাকে ক্ষমা করবি না শিখা?
আমার চোখে নিশব্দ জলের ধারা.....
সে জলধারায় ভেসে যায় সকল অপ্রাপ্তি, জমানো দুঃখ, শোক তাপ.....

জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট আসছিলো সাথে সোদা মাটির গন্ধ......
বেশ কয়েক সপ্তাহ তীব্র দাবদাহের পরে অন্ধকারের বুক চিরে শুস্ক মাটির বুকে অঝর বর্ষন.....

না থাকে অন্ধকার, না থাকে মোহপাপ,

না থাকে শোকপরিতাপ।

হৃদয় বিমল হোক, প্রাণ সবল হোক,

বিঘ্ন দাও অপসারি ॥

সমাপ্ত



আমার দীপুদা - ১ আমার দীপুদা- ২
আমার দীপুদা-৩
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:৪৮
৩২টি মন্তব্য ৩২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×