
গতকাল টিভির খবরে বিজ্ঞজনেদের আলোচনা দেখলাম ভূমিকম্প বিষয়ক। একজন উপদেষ্টা অমূল্য কথা বললেন, "আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য আমাদের এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।"
ঢাকাবাসী ব্যক্তিগতভাবে কীভাবে সচেতন হবেন ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে, সে বিষয়ে উপদেষ্টা ম্যাডাম কিছু বলেন নি।! তিনি বললেন, "পুরানো ঢাকার শতকরা ৯০ ভাগ বাড়ি বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি করা হয়নি। এগুলো ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যাবার ঝুঁকিতে আছে।"
এটা আমরা জানি। আরও জানি, কেবল পুরানো ঢাকা না, পুরো ঢাকাতেই অধিকাংশ ভবন ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে। নির্মাতারা ভূমিকম্প সহনশীল করে বাড়ি তৈরি করেন না অর্থ বাঁচানোর জন্য, আবার রাজউক এইসব অবৈধ বাড়ি অনুমোদন করে অর্থের বিনিময়ে। তাই ঢাকা শহরের আমরা প্রায় সবাই ঝুঁকিতে আছি, কেবল মিন্টো রোডের দোতলা বাড়ির অধিবাসীরা ছাড়া। গতকালের পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্পে ক্ষতি তেমন হয়নি, এটা দেখে স্বস্তি পাবার কিছু নেই!! এমন ছোট ছোট ভূমিকম্প এখন প্রায়ই হচ্ছে, এগুলো সঙ্কেত দেয় যে একটা বড় ভূমিকম্প আসছে! বিগত বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছরে ঘটা এমন ভূমিকম্পের সংখ্যা তার আগের বছরের সংখ্যার চাইতে বেড়ে যাচ্ছে। রিখটার স্কেলে ১ মাত্রা বাড়লে ভূমিকম্পের শক্তি প্রায় ৩২ গুণ বাড়ে, আর ২ মাত্রা বাড়লে শক্তি প্রায় ১০০০ গুণ বাড়ে! তাই কেবলমাত্র সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলেই সেটা হবে অনেক শক্তিশালী আর অনেক ধ্বংসাত্মক।
বুয়েটের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেছেন, ঢাকা থেকে একশো কিলোমিটার দূরত্বের এপিসেন্টারে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ঢাকার এক তৃতীয়াংশ বাড়ি সম্পূর্ণ ধসে পড়বে। ক্ষয়ক্ষতি কমাতে তিনি কিছু ব্যবস্থা নেবার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রথমে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা ভবন চিহ্নিত করা, তারপর সেগুলোকে ভূমিকম্প সহনশীল করা। এই ধরণের কাজ করার অভিজ্ঞতাও আছে আমাদের, রানা প্লাজা ধ্বংসের পর নিরাপদ ভবন চিহ্নিতকরণে পঞ্চাশটা কোম্পানির কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। ভবনের নিরাপত্তা পরীক্ষার পর পুরো নিরাপদ ভবনকে সবুজ, মোটামুটি নিরাপদ ভবনকে হলুদ এবং ও নিরাপদ ভবনকে লাল রঙের প্লাকার্ড দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। লাল চিহ্নিত ভবনগুলোর বসবাসরতদের ভবন থেকে সরিয়ে ভবনগুলোর কাঠামো উন্নয়ন করা হয় যাতে সেগুলো ভূমিকম্পে নিরাপত্তা দিতে পারে। ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য সারা বিশ্বে এটা একটা স্বীকৃত পদ্ধতি। ২০১৫ সালে বিশ্ব ব্যাংক রাজউককে অর্থায়ন করে এই বিষয়ে কাজ করার জন্য। এ কাজ করার জন্য রাজউক নয়, বরং আলাদা একটা ইনস্টিটিউট স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়। সেই ইনস্টিটিউটের জন্য দশতলা একটি ভবনও নির্মিত হয়, ৮০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতিও কেনা হয়, কিন্তু তারপর সবকিছু স্থবির হয়ে যায়। গত দশ বছরে এই ব্যাপারে কোন কাজ হয়নি। অদ্ভুত ব্যাপার।
অধ্যাপক আনসারী বলছেন, অবিলম্বে তিনটি কাজ শুরু করতে হবে যেন ভবিষ্যতে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়:
১) ভূমিকম্পের ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারণ করে তিন ক্যাটাগরির ভবন চিহ্নিতকরণ, যেটা করার প্রশিক্ষিত লোকবল আছে আমাদের।
২) রাজউক নয়, বিশ্ব ব্যাংকের সুপারিশ করা ইনস্টিটিউট চালু করা, যাতে তারা ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর লক্ষ্যে সুষ্ঠু ভাবে কাজ করতে পারে।
৩) ভূমিকম্প সহনশীল ভবন নির্মাণ করতে দেশের স্থপতি এবং প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করতে হবে।
আরেকটা জিনিস উল্লেখ করি, প্রতিবছর ঢাকার ভূমি ৩.৫ মিলিমিটার করে দেবে যাচ্ছে (তথ্যসূত্র দিয়ে আমার একটা পোস্ট আছে)view this link। কারণ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন বেড়ে চলেছে, আবার এই বাড়তি জনগোষ্ঠীর জন্য বেশি বেশি ভবন নির্মাণের ফলে উন্মুক্ত ভুমি ঢেকে যাচ্ছে কংক্রিটে, ফলে বৃষ্টির পানি দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর রিচার্জ হচ্ছে না, তাই ভূমির অবনমন হয়ে চলেছে। এটা ভূমিকম্পের সময় ক্ষয়ক্ষতি বাড়িয়ে দেবে। জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ এবং ভূমি যেন আরও কংক্রিটে না ঢাকে তেমন ব্যবস্থা নিলেই ভূমির অবনমন ঠেকানো যায়, কিন্তু এমন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। বরং ঢাকার জনঘনত্ব বাড়ানোর এবং আরও দালান নির্মাণ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে সম্প্রতি।
বলা হয়, ঢাকায় বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলেই town in inferno হয়ে যাবে (Towering inferno সিনেমাটা যারা দেখেছেন তারা বুঝতে পারবেন)। কারণ ঢাকার মাটির নিচে দিয়ে জালের মতো ছড়িয়ে আছে গ্যাস পাইপলাইন, এগুলো ফেটে একজায়গায় আগুন ধরলেই মূহুর্তে ছড়িয়ে যাবে পুরো শহরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এটাও নিরোধ করার উপায় আছে। এজন্য একধরনের মেশিন ব্যবহার করা যায়, যা মাটির নির্দিষ্ট কম্পাঙ্ক অনুসরণ করতে পারে এবং কম্পাঙ্ক নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করলেই গ্যাস সারবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। এর ফলে আগুনের থেকে শহর বাঁচবে। সমস্যা হচ্ছে, যাঁরা এটা বাস্তবায়ন করতে পারেন তাঁরা এটা করছেন না!!
আমার দুটো পোস্ট আছে ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি নিয়ে। সেখানে বলা হয়েছে যে ঢাকায় এমন অপরিকল্পিত ভাবে দালানকোঠা তৈরি করা হয় যে অনেক ভবনেই অগ্নিকাণ্ড হলে নির্বাপক গাড়ি পৌঁছাতে পারবে না।

এমন ভূমিকম্পের ঝুঁকিময়তা এবং অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিময়তা যাতে আর না বাড়ে সেজন্য রাজউক ২০১০ সালে ড্যাপ নামে এমন একটি পরিকল্পনা করে যাতে বলা হয়েছিল ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা যেমন পুরনো ঢাকায় নাগরিক সুবিধা বজায় রাখার জন্য জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পুরোনো ঢাকার মতো এরকম নির্দিষ্ট কিছু এলাকার জন্য ভবনের উচ্চতা নির্দিষ্ট করে দেয়া ছিল, যেমন পুরনো ঢাকার সাত ফিট রাস্তা সংলগ্ন বাড়ির উচ্চতা হতে পারতো বড় জোর পাঁচ তলা। অথচ সম্প্রতি (১৯ অক্টোবর, ২০২৫) ড্যাপ সংশোধন করে ভবনের উচ্চতার এই বাধ্যবাধকতা তুলে নেয়া হয়েছে, এখন পুরানো ঢাকার সরু গলিতেও ১০/১১ তলা ভবন তৈরি করা যাবে। বলা হচ্ছে, বেশি মানুষকে আবাসন সুবিধা দেবার জন্য এখন ঢাকা নগরীকে উপর দিকে বাড়ানো হবে। মূলত আবাসন ব্যবসায়ীদের চাপে রাজউক এই নিয়ম করেছে। পরিবেশবাদীরা বলছেন এর ফলে যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের দুর্ভোগ সীমাহীন হয়ে যাবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা বাদ দিলেও, রাজউকের এই পরিকল্পনার ফলে বেড়ে যাবে যানজট, বায়ুদূষণ, জলাবদ্ধতা। এরপর ভূমিকম্প এবং সাথে অগ্নিকাণ্ড হলে কী হতে পারে তা অনুমান করা কঠিন!
ড্যাপ বা ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানিং নামক উদ্ভট পরিকল্পনা সম্পর্কে ডিটেইলে বলতে পারলাম না লেখা বড় হয়ে গেছে দেখে। এটুকুই বলি, আমি অবাক হলাম দেখে যে রাজধানীকে দুর্যোগের মধ্যে ফেলে দেবার এই সংশোধিত ড্যাপকে অনুমোদন দিলেন আমাদের পরিবেশ উপদেষ্টা!!!

তথ্য সূত্র: ১) দ্বিগুণেরও বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণের সুযোগ দিয়ে ড্যাপ সংশোধন, ঢাকার বাসযোগ্যতা নিয়ে শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের
বাংলাদেশ view this link
২) আকাশছোঁয়া ভবনে ছেয়ে যাবে ঢাকা। view this link
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৩৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


