২০১৪ সালের প্রহসনের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার সরকার একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়। ইসলামপন্থীদের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে তারা ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগানোর পথ বেছে নেয়। ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনা সরকারকে ভাবিয়ে তোলে—ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন না পেলে ক্ষমতা টেকানো কঠিন হতে পারে। এরই মধ্যে সৌদি আরবের বৈশ্বিক মডেল মসজিদ প্রকল্পের কথা জানতে পারে সরকারের কিছু উপদেষ্টা। এই তথ্যকে কাজে লাগানো হয়।
২০১৬ সালে শেখ হাসিনার সৌদি সফর একটি টার্নিং পয়েন্টে পরিণত হয়। তিনি তৎকালীন বাদশাহর কাছে মডেল মসজিদ নির্মাণের জন্য অনুদানের আবেদন করেন। দেশে ফিরে সরকারি প্রচারযন্ত্র শুরু করে—সৌদি আরব বাংলাদেশকে আট হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে মডেল মসজিদ নির্মাণের জন্য। পরিকল্পনামন্ত্রী আ.হ.ম. মুস্তফা কামাল মিডিয়াকে জানান, সৌদি সরকার ৮০০০ কোটি টাকা দেবে, বাকিটা বাংলাদেশের তরফ থেকে আসবে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৭-২০২০। কিন্তু আন্তর্জাতিক মিডিয়া দ্রুত এই দাবিকে মিথ্যা প্রমাণ করে। ফক্স নিউজ, দ্য ওয়াশিংটন টাইমসের মতো সংবাদ মাধ্যম জানায়, সৌদি আরব এমন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। সৌদি সংস্কৃতি মন্ত্রীও এই দাবি সরাসরি খারিজ করে দেন।
সরকার যখন দেখলো মিথ্যাচার ফাঁস হয়ে গেছে, তখন তারা নিজেদের টাকায় প্রকল্প শুরু করে। মিডিয়ায় অজুহাত দেওয়া হয়—সৌদিতে বাদশাহ পরিবর্তনের কারণে অনুদান বাতিল হয়েছে। প্রকল্পের বাজেট ধরা হয় ৯০০০ কোটি টাকা, যেখানে প্রতিটি মসজিদের জন্য ব্যয় ধরা হয় ১৭ কোটি টাকা। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, ৮-৯ কোটি টাকাই যথেষ্ট ছিল। এই প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। রাজনৈতিকভাবে প্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজের জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মসজিদের স্থান পরিবর্তন করা হয়—একজন মন্ত্রী নিজের রিসোর্টের পাশে মসজিদ বানান, যেটি শহরের মধ্যে হওয়ার কথা ছিল।
বাংলাদেশে ইতিমধ্যে তিন লাখের বেশি মসজিদ রয়েছে। বেশিরভাগই স্থানীয় উদ্যোগে নির্মিত। ঢাকা শহর থেকে গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত মসজিদ নির্মাণে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। এমন একটি দেশে সরকারি অর্থায়নে মডেল মসজিদের প্রকল্প কতটা যৌক্তিক? ইহা ধর্মীয় প্রকল্প কম রাজনৈতিক প্রকল্প বেশি। ধর্মীয় চিন্তাবিদরা এই প্রকল্পকে সতর্কতার সঙ্গে দেখেছিলেন। শেখ হাসিনা ইসলামপন্থীদের কিছু অংশকে নরম করতে পেরেছিলেন এই প্রকল্পের মাধ্যমে। কিন্তু যারা তার স্বৈর শাসনের প্রতিবাদ করেছিলেন, তাদের দমন করা হয়েছে কঠোর হাতে। সমাজের একটি বড় অংশই এই প্রকল্পকে দেখেছে সন্দেহের চোখে।
এই বিপুল অর্থ যদি স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা হতো, তাহলে ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরগুলোতে বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ সম্ভব হতো। চীনের উপর আজ নির্ভর করা লাগতো না । বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য মানুষের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়তো না। অন্য দেশের অর্থায়নে দেশে বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণের প্রয়োজন ছিলো না। দেশের শিক্ষা, গবেষণা ও যোগাযোগ অবকাঠামো—এসব ক্ষেত্রেও এই অর্থ কাজে লাগানো যেত।
মডেল মসজিদ নির্মাণ কোনো ধর্মীয় প্রকল্প ছিলো না , পুরোটাই রাজনৈতিক। জনগণের আবেগকে পুঁজি করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার কৌশল। সতেরো বছর ধরে এমনই নানা কৌশলে শেখ হাসিনার সরকার টিকে ছিলো । মডেল মসজিদ প্রকল্প তারই একটি অধ্যায়—যেখানে ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার চেষ্টা করা হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১০:৩২