ভারতের দিল্লি যখন ইসলামাবাদের দিকে ক্ষোভের তীর ছুঁড়ছে, তখন সেই ধূলিঝড়ে ঢাকা তেমন দৃশ্যমান নয়—তবে নিঃশব্দে এক অস্থির আগুন ছড়িয়ে পড়ছে সীমান্তের ঘাসে। সাম্প্রতিক ভারত-পাক উত্তেজনার ছায়ায়, বাংলাদেশ সীমান্তে শুরু হয়েছে পুরনো এক নিষ্ঠুর খেলা—পুশইন। তবে এবার এর ভাষা নীরব, কৌশল নিপুণ, আর লক্ষ্যে স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা।
সাতক্ষীরা, কুড়িগ্রাম, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার—এই চারটি জেলার সীমান্ত দিয়ে গত কদিনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে শত শত মানুষকে। শূন্যরেখা পেরিয়ে কেউ বিজিবির হাতে ধরা, কেউ জনমানবহীন বনে, কেউ হয়তো নিখোঁজ। মানবাধিকারের নামে প্রদীপ জ্বালিয়ে যে বিশ্ব সভ্যতা আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে রাখে, তাদের নীরবতা আজ বুঝিয়ে দেয়—“বাংলাদেশি” নামটি হয়ে উঠেছে বৈধ অন্যায় চালানোর বৈধ ছদ্মনাম।
‘পুশইন’ নতুন কোনও নীতি নয়—বরং এটি ভারতের একটি পুরনো রাষ্ট্রীয় অভ্যাস, যার সূচনা আমরা দেখি ১৯৯৮ সালের পর এনডিএ সরকারের আমলে। ২০০২-০৩ সালে এর ভয়াবহতা রীতিমতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের রাডারে এসেছিল। নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউ রেহাই পায়নি। আজ ২০২৫-এ সেই একই কৌশল ফিরেছে আরও নিঃশব্দে—মিডিয়া নির্বিকার, নাগরিক সমাজ নিষ্ক্রিয়।
২০০৪ সালে কংগ্রেস সরকার একে কিছুটা লাগাম দিলেও মোদীর ২০১৪’র বিজয়ের পর তা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখন যদিও ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের মোড়কে “ তথাকথিত সোনালী অধ্যায়” শোভা পেত, ২০২৪-এ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদলের পর এই সম্পর্কের মোড় ঘুরে গেছে। দিল্লি বুঝতে পারছে —ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকার শরণার্থী ইস্যুতে বিভ্রান্ত এবং চাপে। এই সুযোগে ভারতীয় কূটনীতি এখন আরও বেপরোয়া।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো—এইবার ঠেলাঠেলির শিকার হচ্ছেন রোহিঙ্গারাও । দ্য ডেইলি স্টারের তথ্যমতে, কুড়িগ্রামের রৌমারী ও ভুরুঙ্গামারীতে ঠেলে দেওয়া ৪৪ জনের মধ্যে ৩৫ জনই আরাকানি রোহিঙ্গা। এটি কেবল সীমান্ত সমস্যাই নয়, বরং বাংলাদেশে নতুন সংকট আমদানি। মিয়ানমারের দায়ভার ঢালাওভাবে বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপানোর কৌশল এখন ভারতের হাতেও।
গুজরাট, আসাম বা বেঙ্গালুরুতে যাদের ‘বাংলাদেশি’ বলে আটকানো হচ্ছে, তারা অনেকেই ভারতের মুসলিম নাগরিক। আধার কার্ড বা ভোটার তালিকা সত্ত্বেও তারা হয়ে পড়ছে উদ্বাস্তু, যাদের গন্তব্য বানানো হচ্ছে ত্রিপুরা সীমান্ত। বিবিসি বাংলার তথ্যে, পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম থেকে আনা এসব মানুষকে বিমানে করে এনে সীমান্তে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। নাগরিকত্ব যাচাই নয়, বরং ধর্মীয় প্রোফাইলিংই হচ্ছে নতুন পরিচয়পত্র।
২০০২ সালে পুশইন ইস্যুতে ভারতের গণমাধ্যম গর্জে উঠেছিল। আজ? টাইমস অব ইন্ডিয়া কেবল ‘হাই অ্যালার্ট’ বলেই দায় শেষ করেছে। “সেই দ্য ডে স্পিক” বলে গর্ব করা সমাজ আজ কথা বলতেও ভয় পায়। উল্টো, বাংলাদেশের মিডিয়া হয় কূটনৈতিক ভাষায় চুপ থাকে, নয়তো সিকিউরিটি ফোর্সের বিবৃতি তুলে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলছেন—“যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি, আমরা যোগাযোগ করছি।” এই ভাষা রাজনৈতিক নয়, আত্মসমর্পণমূলক। এই বাস্তবতায় নোট ভার্বাল আর চিঠিপত্রে কাজ হবে না। দরকার একটি কৌশলগত পাল্টা প্রস্তুতি:
* সীমান্তে সেনা, ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে।
* আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি সর্বোচ্চ মাত্রায় তুলে ধরতে হবে।
* জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা জরুরি।
* রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে ।
যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশ তার সার্বভৌম মর্যাদা বিষয়ে দ্ব্যর্থহীন বার্তা না দেয়, ততক্ষণ এই ঠেলাঠেলির শেষ নেই। পুশইন এখন কেবল সীমান্ত সমস্যাই নয়—এটি এক ধরনের “সফট অ্যাগ্রেশন”। ভারতে ও মিয়ানমারে আজ মুসলমান পরিচয় মানেই ‘বিদেশি’ আর বাংলাদেশ মানেই সেই দায়ভার বইবার ঘাড়। এ যেন রাষ্ট্রীয় বুলডোজারে ঠেলে ঠেলে তৈরি করা এক মানবিক মাইনফিল্ড। যদি এখনই ঢাকা নিজের কূটনৈতিক কণ্ঠকে শাণিত না করে, তবে একদিন হয়তো “ঢাকা”ই হয়ে উঠবে এক ঠেলাঠেলির পরবর্তী গন্তব্য—এই উপমহাদেশে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৮