পর্ব - ০১-০২
পর্ব ০৩-০৪
পর্ব -০৫
পর্ব-0৬
পর্ব -০৭
পর্ব-0৮
পর্ব-0৯
পর্ব-১0
পর্ব - ১১
পর্ব - ১২- শেষ পর্ব
------------
পৃথিবীর বুকে যত অশান্তির কারণ এদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো মিথ্যা অপবাদ। মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা যেমন প্রয়োজন তেমনি মিথ্যা অপবাদে অপমানিত হয়ে উপযুক্ত বিচার পাওয়াটা তার চেয়ে কোনভাবেই কম নয়। আজকের যুগের আত্নকেন্দ্রীক মানব সম্প্রদায়ের মাঝে যে জিনিসের প্রকট অভাব তা হলো বিশ্বাস।আমার কাছে এ মুহূর্তে সবচেয়ে ভয়ংকর সমস্যা হলো অবিশ্বাস। মুখের কথা কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, এমনকি পিতা তার স্বীয় পুত্রকে, স্বামী - স্ত্রীকে, ভাই - বোনের মধ্যে বিচিত্র কারণে বিশ্বাসের শ্বাস বের হয়ে গেছে। আজকাল সবকিছুতে সবাই দলিল,দস্তখত চায়। নিজের উপর মিথ্যা অপবাদের জ্বালা সইতে না পেরে তার দালিলিক প্রমাণের জন্য নিকটস্থ ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। এবং অনায়াসে একটি লেটার নিয়ে আসি যে আমি সক্ষম পুরুষ।
এদিকে আজও জাহাঙ্গীর ভাইকে মানুষ হিসাবে প্যাচুক নাকি মিশুক তার হিসাব মেলাতে পারলাম না। গত কয়দিন থেকে তিনি অনেকবার আমাকে ফোনকল, মেসেজ দিয়ে প্রায় ক্ষুদ্ধ করেই তুলছে। লোকটির এমন বড়ভাই সুলভ আচরনে আমাকে স্বান্তনার বদলে দ্বিধায় ফেলে দিলো ৷ তার কথা হলো সবকিছু বসে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমিও তার কথায় মনে মনে ভাবলাম আমিতো আর চোর -ডাকাত কেউ না আর কোন অন্যায় যে করিনি সেটা সরাসরি বলে দেওয়াটাই অধিকতর ভালো। তাই জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কথামতো বন্ধের দিন রবিবারে বানেছা বিবির সাথে দেখা করতে যাই।
বানেছা বিবির ঘর যেখানে বহুদিন থেকেছি আজ সেই ঘরটিতে ঢুকে এক বিদঘুটে দমবন্ধকর অবস্থায় অনেকটা বুঁদ আর বধির হয়ে বসে থাকি। আমার বসার কিছুক্ষণ ওর বানেছা বিবি এসে রুমে ঢুকলেন। আমি স্বভাবতই উনাকে সালাম দিই। বানেছা বিবি ও জাহাঙ্গীর ভাই দুজনই আমার মুখোমুখি বসে আছেন ৷কেউ কোন কথা বলছে না। জাহাঙ্গীর ভাই সাহসা আড়মোড়া ভেঙে বলতে থাকেন।
- তুমি কি মনস্থির করছো সেটা বলো?
আমি মেজাজ ঠিক রেখে হাসিমুখে বোকার মতো অভিনয় করতে থাকি। জাহাঙ্গীর ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলি, যা বলার আপনারা বলেন আমার তো কিছুই বলার নাই। আর ডাক্তারের কাছ থেকে আনা এই লেটারটি নেন। আমি কখনো মিথ্যা বলিনি, আমি সক্ষম নাকি অক্ষম পুরুষ তা এখানে বলা আছে। আমার কথা শুনার পরপরই বানেছা বিবি তার পুরানো কাসুন্দি বলতে থাকেন,
- তুমি আমার ছেলের মতো সংসারে কত কিছু হয় আর তারজন্য মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকবে তা কি হয়? রাগের মাথায় তোমার ও আমার মেয়ের ভুলবোঝাবুঝি হতে পারে সেটা আমি বুঝেছি। এবার আমার দিকে চেয়ে সবকিছু বাদ দাও।
বানেছা বিবির বদলে যাওয়া গলার নরম সুরের সাথে আমি নিস্তব্ধ হয়ে যাই!
- মেয়েটা তার ভুল বুঝতে পেরে না খেয়ে শুধু কান্নাকাটি করতেই আছে।এই নাও বাঁধনের সাথে কথা বলো !
কিছু বুঝার আগে দেখলাম মোবাইলে ভিডিও কলের মাধ্যমে বাঁধন কাঁদছে ওর মুখে অনুতাপের চিহ্ন। মেয়েদের কান্না দেখলে আমার মন-মগজে আজানা উৎপাত দানা বেঁধে যায়। কান্না জড়িত কন্ঠে বাঁধন বলতে লাগলো,
- আমাকে মাফ করে দাও,শুধু একটিবার মাফ করে দাও। আর এমন ভূল হবে না। এ জীবন আর কখনো তোমাকে আঘাত করবো না!
- স্ত্রী হিসাবে না হোক অন্তত আমাকে তোমাদের বাড়ির কাজের মেয়ের মর্যদাটুকু দাও!
- প্রবল আবেগপ্রবণ আমিও মৌনব্রত ভেঙে কাঁদলাম..
জাহাঙ্গীর ভাই বললেন, বিয়ে চাইলেই ভাঙা যায় না। এখানে আমরা যারা গার্ডিয়ান আছি তাদের দায়িত্ব হলো ভুল হলে শুধরে দেওয়ার। সবকিছু বাদ দিয়ে নতুন জীবন শুরু করো। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। আমি বিভ্রান্তির বেড়াজালে আচ্ছন্ন নাকি ভালোবাসার ঠিকাদার বুঝতে পারলাম না৷সবার কথামতো দূর্নিবার ভালোবাসার জিন মাথায় চড়ে বসে। আমি তাদের সাথে রাতে খাবারদাবার করে সেদিনের মতো ঘর থেকে বের হয়ে আসি। আমি আবারো আবদ্ধ হবো বাঁধনের জালে!
এদিকে বাবার কথা মনে হতে শরীরের মাঝে অদ্ভুত ভয় কাজ করতে লাগলো, এবার বাবা কিভাবে ফিতা ছাড়া সংসারের বাঁধাটা মেনে নিবেন?
(১৩)
-----------
বাবাকে ভয়মিশ্রিত গলায় বানেছা বিবির সাথে মিটিং ও ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি বলার পর। বাবা বলেন এসব তামাশা মাথা থেকে বাদ দাও নতুবা তোমার মা মারা গেছে এবার আমাকেও পাবেনা। বাবার হার্ড লাইন আমাকে হামাগুড়ি দিয়ে চলা সম্পর্কের যবনিকা ঘটাতে সাহায্য করলো। আমার ঘরবাঁধার অপারগতার কথা জাহাঙ্গীর ভাই ও বানেছা বিবিকে জানিয়ে দেই। দু-দুবার দেশে যাওয়া আসা। মায়ের কুলখানি এইসবের মধ্যে আমার হাতে বিশ হাজারের বেশি টাকা নেই। কিন্তু আমাকে দশলাখ টাকা দিয়ে বিয়েটা দফারফা করতে হবে নইলে কেইস হয়ে গেলে ঝামেলা।
বাবাকে বললাম, এই মুহূর্তে তো টাকা নেই বাবা। কয়েকটা দিন যাক। আমি টাকাপয়সা ব্যবস্হা করছি
- - তোর, মায়ের কাবিনের জায়গাটা বিক্রি করে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলবে। হাজার হোক তোর মা তো ব'লেই গিয়েছে।
মা কি বলে গিয়েছে বাবা? তুমি এর আগেও ঠিক তাই বলেছো কিন্তু ক্লিয়ার করনি।
- প্লিজ বাবা।
- কাঁদছো কেনো বাবা? তুমি কাঁদলে আমি আর শুনতে চাইবে না।
- -তুই মায়ের আদরের এক আদর্শ সন্তান সারাজীবন বিদেশে কাটালো একটুকরো সুখ জোটেনি এটা ছিলো তোর মায়ের দুঃখ।
- তোর মা ---মৃত্যুর দুই মিনিট আগে হু হু, কান্নার শব্দ ...
'- কি বাবা?
- তোর মা বলে গিয়েছে, ইয়া আল্লাহ বাঁধন নামক মেয়েটা যদি আমার ছেলের ভালোর জন্য হয় তবে তুমি তাকে রাখো নতুবা আমার ছেলের কাছ থেকে নিয়ে নাও।
- বাবা
- তোর মা স্পষ্ট দেখতে পারছিলো এ মেয়ে তোর জন্য উপযুক্ত নয় ৷ মৃত্যুর আগে মা - বাবা নিজ চোখে সন্তানের ভবিষ্যৎ দেখতে পায়।
- ঠিক আছে বাবা বুলবুল ,এবার রাখি।
বাবার ফোনটা রাখার পর মনে হলো আমার ছোট্ট পৃথিবীতে এক বিরাট ভুমিকম্প হয়ে গেলো। দশলাখ টাকা কোথায় পাই? এখন সবচেয়ে বড় বোঝা এটাই।
শেষ পর্ব
----------
সমাজিক যোগাযোগ অনেকদিন থেকে নেই। বন্ধুদের সাথে তেমন মিশি না। অনেক দিন পর ফেইসবুক খুললমা। অনেক মেসেজ ইনবক্সে জমা আছে। একে একে বাঁধনের মেসেজগুলি পড়ে কাঁদছি আর ডিলেট বাটনে টিপ দিয়ে চলছি। হঠাৎ একটা মেসেজ দেখলাম রহিমা বেগম। আমার জান্নাতবাসী মায়ের নাম ছিলো রহিমা বেগম তাই বিপুল উৎসাহ ও আগ্রহ নিয়ে মেসেজটি খুললমা। শুধু একটি লাইন প্রায় মাসখানেক আগের, আপনি কি বাঁধনের স্বামী বাদশা বুলবুল? অমি চিন্তা করলাম আমি কি এখনো তার স্বামী কি না? কি জবাব দেবো? প্রোফাইলে তেমন কিছু নেই। দুটি শিশুর ছবি ছাড়া ।
আমি উওর দিলাম - জ্বি, আমি বাঁধনের স্বামী। প্রায় তিনঘণ্টা পরে রেসপন্স পেলাম।
- ভাইয়া, একটু কল করবেন?
- ভাইয়া, রহিমা বেগম ?
আমি কল ব্যাক করলাম, যা শুনলাম তাতে মাথা যেন সাততলা থেকে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায় অবস্থা, রহিমার মা বাবা কেউ ইহজগতে নেই সে এতিম একটি মেয়ে। রহিমার বিয়ে হয়েছে সাত বছর। তার স্বামী একজন বাস ড্রাইভার, তাদের ঘরে দুটি সন্তান আছে। আজ ছয় বছর হলো তার স্বামীর সাথে বাঁধনের অবৈধ সম্পর্ক যা কমবেশি সবাই জানে। আমি বললাম এটা তুমি ভুল বলছো। সে খারাপ হলেও অতটা খারাপ না? সে এমন মেয়ে হতে পারে না?
রহিমা আমাকে প্রায় শখানেক ছবি দিলো। আর বললো আপনি আমার ইহজাগতে একজন ভাই, আমাকে সাহায্য করুন! এই অসহায়ের কাছে আরেক কপালপোড়া সাহায্য চায়! জীবনে কতই না নাটক চলছে! এই নরকের কীটের সাথে আমি যৌবনের জলে স্নান হই। নিজেকে শুধু ধিক্কার দিলাম মা বাবার কথা না শুনে নিজের মতামতের ভিত্তিতে বিয়েটা করার পরিণতি ভেবে শিউরে ওঠি। 'মায়ের ক্লোন হলো তার মেয়ে' সে শ্বাশত সত্য মানসপটে ভেসে উঠলো। একজন মায়ের প্রতিবিম্বই হলো তার মেয়ে। তাহলে বানেছা বিবির সাথে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক শুধু সাহায্যের নয় বরং সঙ্গম সুখের তাতে দ্বিমত করার উপায় নেই ! এসব পাপিষ্ঠাদের থেকে নিরাপদ দুরত্বে থাকাটাই বুঝি শ্রেয়তর।
আমি সিলেক্টেড কয়েকটি ছবি বাঁধনের কনটাক্টে,তার মা,ভাই ও এক আত্নীয়কে দিয়ে বললাম এবার আমিই কেইস করবো। এত বড় নরকের কীট? নিউজপেপার সহ সব মিডিয়ায় দিবো। ভাগ্যের কি এমন অদৃশ্য সহায়তায় কোন টাকা পয়সা ছাড়াই বিয়ের নিস্পতি ঘটে। সমাপ্তি হয় আমার নারকীয় জীবনের যত নাটকীয়তার। আমি এখনও মাঝে মধ্যে কিছু টাকা বোন রহিমাকে দেই।
কিছুদিন পরে শোক কাটিয়ে ওঠে আমি চেস্টার ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসা বাংলাদেশী ছাত্রী মনোয়ার কে বিয়ে করি৷ এটা অবশ্য হলফ করে বলতে পারি এবার ভাগ্যদেবী করুণা করে হলেও আমাকে নিরাশ করেননি। আমার সতী-স্বাধী স্ত্রী মনোয়ারার স্ফটিক হৃদ-পেয়ালায় কোন খাদ নেই, কোনকালেই কোন প্রকার পোকামাকড়ের আক্রমণ ও সংক্রমণ যে ছিলো না সেটা নিদ্বিধায় বলতে পারি। এখন আমাদের সংসারে ছয় মাসের ফুটফুটে একটি মেয়ে আছে। আজও মাঝে মাঝে ভাবি বাঁধন আজ কোন কূলে কি বাসা বেঁধেছে ! নাকি নরকের কীট হয়ে নিজের তৈরি উল্কাপিণ্ডে দগ্ধ হচ্ছে ! কি'ই বা তার নিয়তি ? আর কেমন তার পরিণতি ? তা ভাগ্য বিধাতাই ভালো জানেন।
কৃতজ্ঞতা - যারা গল্পটিকে লেখতে সাহায্য করেছেন সেই সকল গুণী ব্লগারদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা রইলো।।।
দ্যা হিপোক্রেসি সিরিজ ভালো লাগলে আরো পড়ুনঃ দ্যা হিপোক্রেসি - ঠেলা ধাক্কার সংসার
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৩:৪৬