somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়

০৫ ই অক্টোবর, ২০২৩ রাত ৮:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অসময়ে কদম ফোটা, বৃষ্টিধোয়া শরত সময়! এমন’ই একটা দিনে আপনার প্রয়াণের খবর এলো! সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই বেলায় আপনাকে নিয়ে লিখছি মেঘভার নত হৃদয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আপনাকে আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে পাওয়ার পরম মুহূর্তটুকু যে কতটা যত্নে লালন করি সেটুকু লেখায় তুলে আনার ঋদ্ধতা হয়ত কখনোই অর্জন করতে পারবো না। আমাদের বেড়ে উঠা আমাদের আমি হয়ে উঠার সময়টুকু যে আপনারা প্রভাবিত করতে পেরেছেন সেটুকু সমস্ত জীবন উন্নত চিত্তে স্মরণ করবো।

আপনার কবিতা যতটা পড়েছি, শুনেছি তার চাইতে অধিক, মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে যখন দেশে গণহত্যা চলছিলো সেই কঠিন সময়ে লেখা " বারবারা বিডলার কে " কবিতা আমাদের কণ্ঠ ছুঁয়ে বিপ্লব স্পন্দন এনেছে হৃদয়ে। একজন বিপ্লবী ! একজন পরিপূর্ণ আধুনিক মানুষ ! যাদের হৃদয়ের সুবাতাস অনুরণিত করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

আপনাদের কবিতা লেখালিখির তবক দেয়া যে পান আমার অমৃত ভেবে আত্মস্থ করেছি, হয়ত সেটুকুর জন্যেই জলের মাঝে লেখাজোখা করার সাহসটুকু পেয়েছি। নাহ, যার লেখা অমরত্ব লাভ করে, তাদের মৃত্যু নেই। আপনার লেখালিখি আপনার হাসিমাখা মুখটুকু মনে করিয়ে দেবে। আপনাকে আল্লাহ জান্নাতবাসী করুন এইটুকু দোয়া !


আসাদ চৌধুরী (জন্ম: ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩- মৃত্যু: ৫ অক্টোবর ২০২৩) বাংলাদেশের একজন কবি ও সাহিত্যিক ছিলেন। কবিতা ছাড়াও তিনি বেশ কিছু শিশুতোষ গ্রন্থ, ছড়া, জীবনী ইত্যাদি রচনা করেছেন। কিছু অনুবাদকর্মও তিনি সম্পাদন করেছেন। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে তার রচিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শীর্ষক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০১৩ সালে একুশে পদক লাভ করেন। তার কবিতা গীতিময় এবং ছন্দোদ্ভাসিত। তার ব্যঙ্গার্থক কবিতা 'কোথায় পালালো সত্য' একটি জনপ্রিয় পদ্য। সভ্যতার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি গত কয়েক দশকে মানবিক মূল্যবোধের যে করুণ অধোগতি, তারই প্রেক্ষাপটে একটি কবিতায় তিনি আক্ষেপ করেছেন[১] -
তখন সত্যি মানুষ ছিলাম
এখন আছি অল্প ( তথ্যসূত্রঃ উইকি পিডিয়া)

কবি আসাদ চৌধুরীর লেখা তিনটা কবিতা




তখন সত্যি মানুষ ছিলাম
– আসাদ চৌধুরী

নদীর জলে আগুন ছিলো
আগুন ছিলো বৃষ্টিতে
আগুন ছিলো বীরাঙ্গনার
উদাস-করা দৃষ্টিতে।
আগুন ছিলো গানের সুরে
আগুন ছিলো কাব্যে,
মরার চোখে আগুন ছিলো
এ-কথা কে ভাববে?
কুকুর-বেড়াল থাবা হাঁকায়
ফোসে সাপের ফণা
শিং কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায়
জ্বলে বালির কণা।
আগুন ছিলো মুক্তি সেনার
স্বপ্ন-ঢলের বন্যায়-
প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে
কাঁপছিলো সব-অন্যায়।
এখন এ-সব স্বপ্নকথা
দূরের শোনা গল্প,
তখন সত্যি মানুষ ছিলাম
এখন আছি অল্প।


রিপোর্ট ১৯৭১
- আসাদ চৌধুরী


প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল
বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম
আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।
এ—সব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে
বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায়—
বেড়ার ফোঁকড় দিয়ে নিজের রন্ধনে
তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে
শুধু মুখ টিপে হাসে।
প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হ’য়ে
কোঁচরে ভরেন অনুজের সংগৃহীত কাঁচা আম, পেয়ারা, চালিতা—
সূর্য্যকেও পর্দা করে এ—সব রমণী।
অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার
সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা
সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে—
আমি তার সুরকার— তার রক্তে স্বরলিপি লিখি।
মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী
গরীবের চৌমুহনী বেথেলহেম নয়
মগরেবের নামাজের শেষে মায়ে—ঝিয়ে
খোদার কালামে শান্তি খুঁজেছিলো,
অস্ফুট গোলাপ—কলি লহুতে রঞ্জিত হ’লে
কার কী বা আসে যায়।
বিপন্ন বিস্ময়ে কোরানের বাঁকা—বাঁকা পবিত্র হরফ
বোবা হ’য়ে চেয়ে দ্যাখে লম্পটেরক্ষুধা,
মায়ের স্নেহার্ত দেহ ঢেকে রাখে পশুদের পাপ।
পোষা বেড়ালের বাচ্চা চেয়ে—চেয়ে নিবিড় আদর
সারারাত কেঁদেছিলো তাহাদের লাশের ওপর।
এদেশে যে ঈশ্বর আছেন তিনি নাকি
অন্ধ আর বোবা
এই ব’লে তিন কোটি মহিলারা বেচারাকে গালাগালি করে।
জনাব ফ্রয়েড,
এমন কি খোয়াবেও প্রেমিকারা আসে না সহজ পায়ে চপল চরণে।
জনাব ফ্রয়েড, মহিলারা
কামুকের, প্রেমিকের, শৃঙ্গারের সংজ্ঞা ভুলে গ্যাছে।
রকেটের প্রেমে পড়ে ঝ’রে গ্যাছে
ভিক্টোরিয়া পার্কের গীর্জার ঘড়ি,
মুসল্লীর সেজদায় আনত মাথা
নিরপেক্ষ বুলেটের অন্তিম আজানে স্থবির হয়েছে।
বুদ্ধের ক্ষমার মূর্তি ভাঁড়ের মতন
ভ্যাবাচেকা খেয়ে প’ড়ে আছে, তাঁর
মাথার ওপরে
এক ডজন শকুন মৈত্রী মৈত্রী ক’রে
হয়তো বা উঠেছিলো কেঁদে।


বারবারা বিডলারকে
- আসাদ চৌধুরী


বারবারা
ভিয়েতনামের উপর তোমার অনুভূতির তরজমা আমি পড়েছি—
তোমার হৃদয়ের সুবাতাস
আমার গিলে—করা পাঞ্জাবিকে মিছিলে নামিয়েছিল
প্রাচ্যের নির্যাতিত মানুষগুলোরজন্যে অসীম দরদ ছিল সে লেখায়
আমি তোমার ওই একটি লেখাই পড়েছি
আশীর্বাদ করেছিলাম, তোমার সোনার দোয়াত কলম হোক।
আমার বড়ো জানতে ইচ্ছে করে বারবারা, তুমি এখন কেমন আছ ?
নিশ্চয়ই তুমি ডেট করতে শিখে গেছ।
গাউনের রঙ আর হ্যাট নিয়ে কি চায়ের টেবিলে মার সঙ্গে ঝগড়া হয়?
অনভ্যস্ত ব্রেসিয়ারের নিচে তোমার হৃদয়কে কি চিরদিন ঢেকে দিলে।
আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে বারবারা।
তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়—
বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো
ওটা একটা জল্লাদের ছবি
পনেরো লক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠাণ্ডা মাথায় সে হ্ত্যা করেছে
মানুষের কষ্টার্জিত সভ্যতাকে সেগলা টিপে হত্যা করেছে
অদ্ভুত জাদুকরকে দেখ
বিংশ শতাব্দীকে সে কৌশলে টেনে হিঁচড়ে মধ্যযুগে নিয়ে যায়।
দেশলাইয়ের বাক্সর মতো সহজে ভাঙে
গ্রন্থাগার, উপাসনালয়, ছাত্রাবাস,
মানুষের সাধ্যমত ঘরবাড়ি
সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ফুলকে সে বুট জুতোয়
থেতলে দেয়।

টু উইমেন ছবিটা দেখেছ বারবারা ?
গির্জার ধর্ষিতা সোফিয়া লোরেনকেদেখে নিশ্চয়ই কেঁদেছিলে
আমি কাঁদিনি, বুকটা শুধু খাঁ খাঁ করেছিল—
সোফিয়া লোরেনকে পাঠিয়ে দিয়ো বাংলাদেশে
তিরিশ হাজার রমণীর নির্মম অভিজ্ঞতা শুনে
তিনি শিউরে উঠবেন।
অভিধান থেকে নয়
আশি লক্ষ শরণার্থীর কাছে জেনে নাও, নির্বাসনের অর্থ কী ?
জর্জ ওয়াশিংটনের ছবিওলা ডাকটিকেটে খোঁজ থাকবে না স্বাধীনতার
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাছে এসো—
সাধু অ্যাবের মর্মর মূর্তিকে গণতন্ত্র আর মানবতার জন্য
মালির ঘামে ভেজা ফুলের তোড়া দিয়োনা—
নিহত লোকটি লজ্জায় ঘৃণায় আবার আত্মহত্যা করবে।
বারবারা এসো,
রবিশঙ্করের সুরে সুরে মুমূর্ষু মানবতাকে গাই
বিবেকের জংধরা দরোজায় প্রবল করাঘাত করি
অন্যায়ের বিপুল হিমালয় দেখে এসে ক্রুদ্ধ হই, সংগঠিত হই
জল্লাদের শাণিত অস্ত্র
সভ্যতার নির্মল পুষ্পকে আহত করার পূর্বে,
দর্শন ও সাহিত্যকে হত্যা করার পূর্বে
এসো বারবারা বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি তাকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০২৩ রাত ৮:৩৫
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতীয় দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থা : অরাজকতার পালে নতুন হাওয়া!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১:০৩


বাংলাদেশে আজকাল দাবি না জানালে কেউ আর মানুষ থাকে না—ছাত্র, শিক্ষক, গৃহিণী, পুলিশ, পিয়ন, কবি, কুস্তিগির, সবাই 'অধিকার' চায়। তবে অধিকার মানে এখানে মোটেই দায় বা কর্তব্য নয়, বরং ছিনিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্পা এবং দেহ ব্যবসায়ীদের কথা শুনলে রেগে যাবেন না

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৬:৪৯



পুরো পৃথিবীতে স্পা এর সংখ্যা ১ লক্ষ ৮১ হাজার। এইসব স্পা-গুলোর বেশির ভাগই গড়ে উঠেছে ইউরোপে। এশিয়া - প্যাসিফিকের দেশগুলোতেও স্পা-এর সংখ্যা কম নয়। ৫১ হাজারেরও বেশি। বাংলাদেশে স্পা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাটির রঙভঙ্গ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১১:৫০


হ হ আজ কাল মানুষগুলো
হাসলেও মারে, ভাত চাইলোও মারে-
এমন কি চেয়ে থাকলোও মারে;
কি অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে খারাপ-
মারার বিকল্প কিছু খুঁজে পায় না
যত রাগ বাবা এখন রক্তাক্ত সাপ
ক্ষমতায় দেখে শুধু... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম বিহীন বিশ্ব গড়ার চেষ্টা বিশ্ব জনসংখ্যা অনেক কমিয়ে দিবে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:৫০



নেতানিয়াহু বলেছে তাদের সাথে অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্র আছে। সে মুসলিম বিশ্বকে বড় রকমের হুমকি দিয়েছে। সে গণহত্যা চালাচ্ছে। আত্মরক্ষায় মরিয়া মুসলিমরাও গণহত্যা চালাবে। তখন আর সভ্যতার বাণীতে কাজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার মিরর ডোল, নিজের মনের অশান্তি অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে ফ্যাসিস্টের মতো আচরণ করবেন না

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ২:৩৫

ব্লগার মিরর দৌলাকে বলছি।
আপনাকে কিছু কড়া কথা আজ বলবো। ব্লগে বর্তমানে আপনার কোন অবদান নেই। সামুর যে ব্লগপেইজটা আপনি চালান, সেখান থেকে সব পোষ্ট আপনি ড্রাফটে নিয়েছেন। সেটা আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×