জান মহম্মদের চোখ এড়ায়নি। মাথার উপর চকচকে সাইনবোর্ড। রয়েল বেকারি এন্ড ফুডস। নিচে তার দৃষ্টিও ঝকঝকে। মধ্যদুপুর। সবকিছু রোদের আলোয় উজ্জ্বল। তবু তারমধ্যে অন্ধকার খুঁজে পায় তার মন। উন্মন অস্থির করে সবসময়। আরও অনেককিছু দেখে যায় নিশ্চুপ। এই ফাঁকে দুচোখ চারপাশ ঘুরে আসে। বাঁ-হাত তেল কুচকুচে কালো ভুড়ি।
ছেলেটি অবশেষে সিকি কয়েনটি বয়ামের উপর রাখে। অস্থির দৃষ্টি। গুমট আকাশের মতো মুখ। ম্লান। বিষণ্ন। রাস্তার ওপাশে দুল-চুড়ি-খেলনার দোকান থেকে নেইলপলিশের গন্ধ দমকা বাতাসের মতো ছুটে আসে।
‘নিমকি বিস্কুট দেন।’
‘চার আনার?’
মাথা কাত করে জবাব দেয় সে। তার চোখ-মুখ বসে গেছে। সকাল থেকে মুখে কিছু দিতে পারেনি। কী দেবে? ভারি করুণ মুখছবি। একটু কি ঘাবড়ানো? জান মহম্মদের দৃষ্টিতে মটরবাইকের কালো ধোঁয়া উড়ে আসে। এখন রাস্তায় তেমন ভিড় নেই। আকস্মিক দু-একটি রিকশা সাইকেল ঠ্যালা কিংবা মটরবাইক দেখা যায়। কখনো কখনো রাস্তা কাঁপিয়ে মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ি। সেটির পেছনে জলের ফোয়ারা। রাস্তা ভিজিয়ে দেয়। মানুষের মন ভেজে না।
জান মহম্মদের হাতে কয়েন। অচল পয়সা। স্পর্শ করেই টের পায়। অভিজ্ঞতা কম হলো না। এখন হাতের তালুতে দুটি চোখ গজিয়ে গেছে। তবু কিছু বলে না। ক্যাশবাক্সে কয়েন ফেলে কাগজের ঠোঙায় বিস্কুট তোলে। বিস্কুটের তেলে ঠোঙা ভিজে উঠে। কেউ নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে সেখানে।
ছেলেটি রাস্তা পেরিয়ে পুবে চলে যায়। সেখানে একটি স্কুল। আজ রোববার। স্কুল বন্ধ। সে আমগাছের ছায়ায় সিমেন্টের বেঞ্চে বসে। তার চোখে-মুখে রোদ। পাতার ছায়ায় সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। সে একটি একটি করে বিস্কুট খেতে থাকে। বিষণ্ন দৃষ্টিতে উত্তরে তাকায়। কতকিছু ভাবে। মা-বাবার কথা। হয়তো পুরোনো দিনের ছোট ছোট ঘটনা। তারপর বিষণ্ন দৃষ্টিতে মানুষ দেখে। মানুষের ভিড়ে নিজেকে তার খুব একলা মনে হয়। কেউ নেই তার। আমগাছের আলোছায়ার মধ্যে মাথার উপর দু-একটি কাক মুখ হাঁ করে বাতাস গেলে। প্রচণ্ড রোদ। তাপদাহ।
জান মহম্মদ ক্যাশবাক্স খোলে। হাতড়ে তুলে আনে কয়েন। গোল। শীতল। রুপোলি। যা অনুমান করেছিল সঠিক। অচল পয়সা। দুই পয়সার চারকোণা কয়েন কেটে ঘষে সিকি করা হয়েছে। ছেলেটি কি জানে? জেনে বুঝেই ঠকিয়ে গেল? হয়তো জানে অথবা জানে না। আট-দশ বছর বয়সি ছেলে জানবে না ঠিক নয়। ভেজাল মানুষ। সে তবে কেন জেনে-শুনে প্রশ্রয় দিলো? এই প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। আচ্ছা সে নিজে কি আসল মানুষ? তার বাঁ-হাত আবার ভুড়ির উপর একপাক ঘুরে আসে। সে নিজে ভেজাল ময়দা, পচা ডিম আর পুরোনো বাতিল তেলে মণ্ড করে। চাকু আর ডাইস দিয়ে কেটে কেটে তোলে বিস্কুট। লম্বা হাতায় টিনের ট্রে বসিয়ে তন্দুরে রেখে দেয়। সেগুলো গনগনে আগুনে ঝলসে উঠে। সেঁকা হয় বিস্কুট। ফুলে ফেঁপে উঠে পাউরুটি। বাতাসে ছড়ায় লোভাতুর সুবাস। মানুষের রসনা ফুলে ফেঁপে উঠে। ফুলে ফেঁপে উঠে তার ক্যাশবাক্স। ফুলে ফেঁপে উঠে তার ভুড়ি। বছর বছর বদলে যায় তার দোকানের সাইবোর্ডের রং। ঝিক ঝিক করে উঠে তার আঙিনা। ছেলেমেয়ের পোশাক। জীবন আর বেঁচে থাকা। অথচ কখনো কখনো মনের ভেতর জেগে উঠে অন্ধকার।
মন্দ আর ভেজাল জিনিসের স্বাদ বেশি। পচা ময়দা পচা ডিম পচা তেলে তৈরি বিস্কুটে শান্তি বেশি। সে তৈরি করে। মানুষ খায়। খেয়ে মজা পায়। মজা পায় বলে দাম দেয়। তাকেও দাম দিতে হবে। তার দুচোখে কোত্থেকে কেমন উপলব্ধি এসে জমা হতে থাকে। সেই যেমন ছেলেটি কয়েন বয়ামের উপর রাখে আর বলে বসে, সে কী চায়? তার চোখ-মুখ বিষণ্ন। ভয় ভয় দৃষ্টি। ঘাবড়ানো অস্থির। তেমন করে কি তার চেহারা বদলে যায়? সে কী চাইবে? অচল পয়সার ভেজাল মানুষ সে।
___
(অনলাইন 'নতুন কাগজ' এ প্রকাশিত)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৪:২৭