শীত শুধু একটা ঋতু নয়, অনেকগুলো আবেগ আর স্মৃতির জননী। প্রতিটি শীত আমাদের নতুন নতুন কিছু উপহার দেয়। কেড়েও নেয় অনেকের জীবন। আমাদের দেশের গরিব অসহায় মানুষদের শীতকালে কষ্টের কোনো অন্ত থাকে না। শীতকে ঘিরে কিছু স্মৃতি আজ লিখছি। হয়ত আমার সাথে অনেকের স্মৃতির মিল হয়ে যাবে।
যখন খুব ছোট ছিলাম, সালটা হবে ১৯৯৫ বা ১৯৯৬, বয়স ৪- ৫ বছর হবে তখন ঘুম থেকে উঠতাম ভোরবেলা। চারিদিকে কনকনে শীত। সেই ভোরবেলা পায়ে স্পঞ্জের সেন্ডেল, কাপড়ের ইংলিশ প্যান্ট, গায়ে সোয়েটার, কানে মাথায় মাফলার পেঁচিয়ে বাবার সাথে বেরিয়ে যেতাম বাড়ির পাশের পার্কে। পার্কের এক কোনায় একটা অনেক বড় কাঠবাদাম গাছ ছিল। সারারাত বাদুড় পাকা কাঠবাদামগুলোর ওপরের ছাল খেয়ে গাছ থেকে কাঠ বাদামগুলোকে নিচে ফেলে দিতো। গাছের নিচে অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিল ঘন সবুজ ঘাস। আমরা সেই পড়ে থাকা কাঠবাদামগুলো কুড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে আসতাম। এরপর হাতুড়ি বা বড় পাথর দিয়ে ভেঙে ভিতর থেকে বাদাম বের করে খেতাম। অনেক সময় হাতে হাতুড়ির বা পাথরের আঘাত লেগে যেত। শীতের ভোরে এই কাঠবাদাম কুড়ানোটা আমাদের পাড়ায় একটা নেশা এবং প্রতিযোগিতা ছিল। আমি আর বাবাই সবচেয়ে বেশি কাঠবাদাম কুড়িয়ে নিয়ে আসতাম।এখন সেই শিশির ভেজা ঘাসকে খুব মিস করি।
কাঠবাদাম কুড়িয়ে এনে একটু সকাল হলেই পাড়ার ছেলেরা চলে আসতাম স্কুল মাঠে। তখন শীত কালীন ছুটি থাকতো। সে সময় এতো আধুনিক ক্রিকেট খেলার ব্যাট আমাদের মতো ছেলেদের থাকতো না। এলাকার বড়োলোকের ছেলেদের কাছে থাকতো। তাদেরকে তাদের বাবা মা আমাদের সাথে মিশতে দিতো না তারা খারাপ হয়ে যাবে সেই ভয়ে। তাই আমরা নিজেরাই নারিকেল গাছের ডাল (ঢেঁজ্ঞা) কেটে ব্যাট বানাতাম। কোনো কোনো সময় কোনো নির্মানাধীন বিল্ডিঙের নিচে পড়ে থাকা সমান কাঠ কুড়িয়ে নিয়ে দা দিয়ে কেটে ব্যাট বানাতাম। আট আনা বা চার আনা যাই থাকতো সেটাই একত্র করে তিন টাকা দিয়ে বেঙ্গল বিস্কুট কিনে সেটা খেলার প্রাইজ বানাইতাম। যারা জিতবে তারা সেই বেঙ্গল বিস্কুট খেত। তিন টাকার প্যাকেটে নয়টি বিস্কুট থাকতো।
সকাল এবং বিকেলে দুই বেলাতেই ভাপা পিঠার দোকান বসতো। এলাকার মহিলারা দোকান দিতেন। মাটির চুলো আর পাতা খড়ি দিয়ে আগুন জ্বালাতো সেই চুলায়। চার আনার পিঠাগুলো ছিল গুড় ছাড়া আর আট আনার পিঠাগুলো ছিল গুড় আর নারিকেল কুড়া দিয়ে বানানো।এখন অনেক পিঠা খাই কিন্তু সেই আবেগ আর স্বাদ কোথাও পাইনা।
শীতের রাতে পিকনিক খাওয়ার মজা মনে হয় লিখে বা বলে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সবার বাড়ি থেকে মানুষ অনুযায়ী হিসেবে করে চাউল, একটা করে ডিম, আর সর্বোচ্চ ১০ টাকা করে চাঁদা। আমাদের পাড়ার সবাই মোটামুটি পিকনিকে অংশগ্রহণ করতো শুধুমাত্র কয়েকঘর ছাড়া। তারা সেই সময়েই অনেক বৈষম্য নিয়ে বসবাস করতেন।
পাড়ার সব মহিলারা একসাথে বসে কাটাকুটার কাজ করতেন,পুরুষেরা একপাশে বসে আড্ডা দিতেন, কয়েকজন ছিলেন যারা বাজার করায় পটু, তারা বাজারে যেতেন গোস্ত, মশলা এবং অন্যান্য কেনাকাটা করার জন্য। যারা একদম বয়স্ক ছিলেন তারা ঢোসকাতে (একধরণের মাটির পাত্র ) চুলোর গরম কয়লা নিয়ে বসে তাপ পোহাতেন। আমরা ছোটরা দুস্টুমি করতাম অনেক, নাচানাচি, বৌচি খেলা, কানা মাছি ভোঁ ভোঁ খেলা খেলতাম। আমাদের পাড়াতেই এক সুনাম ধন্য বাবুর্চি থাকতেন। পিকনিকের রান্না বান্নার প্রধান কাজ উনিই করে দিতেন। রান্না শেষ হলে সবার যার যার নিজের থালা আর গ্লাস নিয়ে চলে আসতাম। পিকনিকের জন্য ডেকোরেটর থেকে ছামিয়ানার কাপড় নিয়ে আসতো, সেটা মাটিতে পেতে সবাই বসে গরম গরম খাবার খেতাম। প্রথমে ছোটরা বসে পড়তাম,আমাদের খাওয়া শেষ হলে বড়রা বসে পড়তেন। কত আনন্দঘন দিনই না ছিল তখন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



