somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চাইনিজ

২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ দুপুর ২:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

-সকালে উঠে কি করো ?
-চা পরোটা খাই।
-এইভাবে উত্তর দেয়না, বলো সকালে উঠে দাঁত মাজি, হাত মুখ ধুয়ে প্রার্থনা করে নাস্তা খাই, তারপর স্কুলে আসি।
- না, সকালে উঠে চা পরোটা খাই।
জীবনে প্রথম যেদিন স্কুলে গিয়েছিলাম সেদিনের প্রথম ক্লাসের কথোপকথন শিক্ষিকার সাথে। উনি আমাদের এলাকার হওয়ায় উনাকে নানী বলেই সম্বোধন করেছিলাম। উনি বলেছিলেন স্কুলে তো নানী করে বলা যাবে না, আপা ডাকবা আপা। আমি দৌড়ে বাড়িতে এসে মাকে বললাম,
- পরাগ মামার মা আমার কে হয় ?
- কেন ?
-অরে কউ আগে
-নানি হয়
আর কথা না বাড়িয়ে আবার দৌড় দিয়ে স্কুলে যেয়ে উনাকে বললাম আপনি তো আমার নানি ই হন।
১৯৯৭ এর কথা বললাম। আমার বাড়ি প্রধান শহরে হলেও বাড়ির পাশে যে বাংলা স্কুল ছিল সেটাতেই লেখাপড়ার হাতে খড়ি হয়। তখন এতো সাজানো গোছানো স্কুল ছিল না।কয়েকটা ক্লাসে বসার জন্য বেঞ্চ ছিল আর বাকিগুলোতে কোনো বেঞ্চ ছিল না। আমরা সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় নিজ দায়িত্বে মাদুর বা সপ নিয়ে যেতাম বসার জন্য। ক্লাসের মেঝে পাকা ছিলো,সেখানে মাদুর পেরে লেটা মেরে বসে যেতাম। আপা নাম ধরে ধরে ডাকতো আর আমরা যথেষ্ট জোরে চিৎকার দিয়ে বলতাম ''উপস্থিত''। ক্লাসে নতুন কেউ আসলে ওই নাম ডাকার খাতায় আপা নাম লিখে নিতেন। এখনকার মতো অতটা ঝামেলা পোহাতে হতো না।
সেসময় আমাদের বাড়িতে সকালে নাস্তা ছিলো চা দিয়ে পরোটা ভিজিয়ে রেখে তারপর চামুচ দিয়ে খাওয়া। হয়তো মাসে দুই একদিন এর ব্যতিক্রম হতো। আর এই ব্যতিক্রম খাবারের ভেতর ছিলো আগা দিনের বাশি ভাত পরের দিনে সকালে ভাজা শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ কুচি, রসুন আর লবন একত্রে ডলে নিয়ে তারপর সেটা দিয়ে মেখে খাওয়া। আঞ্চলিক ভাষায় আমরা এটাকে বলি ''কড়কড়া মাখা''। এখন ও হয়তো অনেকেই খেয়ে থাকেন এইভাবে।
স্কুল যাওয়া শুরু করলাম। নানীকে আপা ডাকতে কয়েকদিন সময় লেগে গেলো।স্কুলে যাওয়ার সময় চার আনা নিতাম কখনো আট আনা। লক্ষ্য ছিলো একটাই স্কুল থেকে আসার সময় পাইপ আইসক্রিম খাওয়া। লাল আর সবুজ রঙের ভিন্ন ভিন্ন দুটি রঙের আইসক্রিম পাওয়া যেত।
ক্লাসে পড়াতো শিশু শিক্ষা বই। মদন মোহন তর্কালংকার প্রণীত শিশু শিক্ষা বই। তখন পরীক্ষা ছিলো তিনটা। প্রথম সাময়িক,দ্বিতীয় সাময়িক আর বার্ষিক পরীক্ষা। এখনকার মতো এতো ঘন ঘন পরীক্ষা হতো না। পরীক্ষার সময় এক টাকা দামের খাতা কিনে নিয়ে যাওয়া লাগতো,আর ক্লাসে নরমাল নিউজ প্রিন্ট খাতায় সব বিষয়ের লেখা শিখতাম লাইন টেনে টেনে। সব বিষয় বলতে সে স্কুলে বিষয় ছিলো তিনটা। বাংলা, ইংলিশ আর অংক। আর একটা বিষয় ছিলো সেটা ড্রইং। আম আঁকতাম সেসময়। মাটি দিয়ে আম বানিয়ে স্কুলে নিয়ে যেতাম।
আমাদের পাড়ায় কয়েকঘর মানূষ ছিলেন যারা আর্থিক ভাবে একটু বিত্তবান ছিলেন। তাদের ছেলে মেয়েরা আমাদের সামনে দিয়ে ভালো স্কুলে পড়তে যেত। সেসময় স্কুল ভ্যান নামে কিছু খাঁচার মতো ভ্যান ছিলো ওরা কয়েকজন ওই খাঁচার ভেতর করে স্কুলে যেতো আবার আসতো। সুলতান কাকা সেই ভ্যান চালাতো। আমারও ইচ্ছে করতো সেই ভ্যানে করে ওদের মতো স্কুলে যেতে। ওদের স্কুলের সুন্দর ড্রেস ছিলো আর আমাদের স্কুলে রাতে যা পরে ঘুমাতাম সকালে উঠে ওটা পরেই স্কুলে চলে যেতাম।
একদিন বিকেলে খেলছিলাম স্কুলের মাঠে। বিয়ারিং দিয়ে ত্রিভুজ আকৃতির গাড়ি বানিয়ে নিয়েছিলাম। শিশু গাছের ডাল কেটে তার মধ্যে বিয়ারিং সেট করে গাড়ি বানাতাম আমরা ছোট বেলায়। একজন গাড়িতে বসতো আর একজন পিছন থেকে ঠেলা দিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতো।সেই গাড়ি নিয়েই খেলছিলাম। এর মধ্যেই একজন এসে বললো ওরা আজকে চাইনিজ খেতে যাবে। ওরা মোটামুটি ভালোই বিত্তবান ছিলো এবং ও ভালো একটা স্কুলে পড়তো। আমরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম সেটা আবার কি ? খেতে কেমন? সে বললো এর আগেও নাকি একবার খেয়েছে সে। অনেক মজা। জিজ্ঞেস করলাম কোথায় থেকে খেয়েছে? ও বললো চ্যাং পাই হোটেল থেকে খেয়ে এসেছে। ওই যে মাথার মধ্যে ঢুকলো চ্যাং পাই হোটেল তখন থেকে ওর নাম দিয়ে দিলাম চ্যাং-পাই। কিন্তু চাইনিজ খাওয়ার ইচ্ছেটা মনের মধ্যে গভীর ভাবে ঢুকে গেলো।
বাড়িতে এসে মাকে জিজ্ঞেস করলাম মা চাইনিজ কি? মা বললো জানেনা। আমিও নাছোড় বান্দা। অনেক জোরাজুরির পর মা বললো তোর নতুন যে মামী আসছে ওই মামীকে যেয়ে জিজ্ঞেস কর চাইনিজ কি। আমি দেরি না করেই মামীকে যেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ও মামী তুমি নাকি জানো চাইনিজ কি ?
-হুম জানিতো,খাবা তুমি?
- হুম খামু।
-আচ্ছা আমি বানায় দিবোনি।
-এক্ষনি দাও।
-তাহলে একটা কলার গাছ কেটে নিয়ে আসো আমি বানায়ে দিচ্ছি।
আমি চলে গেলাম স্কুলের পেছনে কিসলুদের বাড়ির কোনায়।ওখানে কয়েকটা কলা গাছ ছিলো। ঘর থেকে একটা ভোঁতা দা নিয়ে গিয়েছিলাম,ওটা দিয়েই একদম গাছের গোড়া থেকে কেটে ফেললাম। একা টেনে আনা সম্ভব হচ্ছিলো না, তখন অন্য বাড়ির আমার খেলার সাথী তপুকে ডাক দিলাম,বললাম চাইনিজ খামু আজকে আয় আমার সাথে।ওকে সাথে নিয়ে কলাগাছটা টেনেটুনে বাড়ির আঙিনায় নিয়ে এলাম। বাড়ির সবাই আমার কান্ড দেখে হাসতে লাগলো। আমার নতুন মামী একটা বটি নিয়ে এলেন আর কলাগাছ থেকে উপরের ঢেঙাগুলো ছাড়ায়ে ভেতর থেকে একদম সাদা অংশ বের করে নিলেন। মামীর কান্ড দেখে আশেপাশের কয়েক বাড়ি থেকে আরো কয়েকজন আমাদের বাড়িতে এসে বসলেন। মামী কলার গাছের ভেতরের অংশগুলোকে কেটে ছোট ছোট টুকরো করে একটা বড় সিলভারের গামলার ভেতরে নিলেন।এরপর তার ভেতর ভাজা শুকনো মরিচ,লবন,আখের গুড়,জিরার গুঁড়া, তেতুল আরো কিছু কিছু দিয়ে শেষে দিলেন সরিষার তেল।তারপর শুরু হলো মাখানো। প্রায় ২০ মিনিট মাখানোর পর কলার পাতায় সবাইকে এক মুঠো করে দিলেন খাওয়ার জন্য। মুখে দেওয়া মাত্র মনে হলো এ যেন অমৃত। ছেলে বুড়ো সবাই মহা আনন্দে খেতে থাকলেন সেই চাইনিজ।
এর মাঝখানে পার হয়ে গেলো ২৮ বছর। শৈশব কৈশোর পার করে এখন পরিণত যুবক। কোথাও ''চাইনিজ '' নাম শুনলেই সেই কলার ''কাগনা'' মাখার কথা মনে হয় আর হেসে উঠি আনমনে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বস্তিবাসী সেই অগ্নিকন্যাকে নিয়ে লেখা একটি কাব্যগাথা

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৫৫


ঢাকার আকাশ তখন ধুলোমাখা সন্ধ্যার রঙে ছিল ডেকে
বস্তির সরু গলিতে শিশুদের কান্না
নর্দমার স্রোতের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে
সেই অন্ধকার জন্মঘরে প্রথম আলো দেখেছিল
এক বস্তিবাসী কন্যা শিরিন
এখনো এক অচেনা নাম
যার ভেতর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাবুল আলীই আমাদের বাংলাদেশের প্রতীক

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৩৭



আপনাদের কি এই ছবিটার কথা মনে আছে? এই বছরের শুরুতে চলতি বছরের জানুয়ারীতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে বেআইনিভাবে বাংলাদেশের জমিতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

=মানুষ মানুষকে কীভাবে এত অপদস্ত করে এই ব্লগে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৪

আমি তো কারও সাতেও নাই পাঁচেও নাই। এত সময়ও নাই মানুষকে ঘাঁটার। ব্লগের ব্লগারদের সম্পর্কেও তেমন কিছু জানি না। তবে পোস্ট পড়ে কিছুটা আন্দাজ করা যায় -কে কী রকম। আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগ কি শিখিয়েছে?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:০৬






অপমান, অপদস্থ থেকে বাঁচার উপায় শিখাইনি? ওস্তাদ মগা শ্যামী পাহাড়ে বসেও এসবের সমাধান করতে পারে, আপনি সামান্য অসুস্থতার জন্যও ব্লগে মিলাদ দেননি, দোয়া করেছেন কার জন্য? খালেদা জিয়ার জন্য এয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ওরা দেশের শত্রু; শত্রু দেশের মানুষেরও...

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৮

ওরা দেশের শত্রু; শত্রু দেশের মানুষেরও...

অন্তর্জাল থেকে নেওয়া সূর্যোদয়ের ছবিটি এআই দ্বারা উন্নত করা হয়েছে।

ইসলামের পবিত্র আলো ওদের চোখে যেন চিরন্তন গাত্রদাহের কারণ। এই মাটি আর মানুষের উন্নয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×