মুসলিম নিধন এবং প্রবৃদ্ধি অর্জনে ও করোনা মোকাবেলায় চরম ব্যর্থতার পরেও দ্বিতীয় মেয়াদের ক্ষমতার এক বছরকে স্বর্ণযুগের একবছর ঘোষণা করে দেশবাসীকে চিঠি দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গত বছর ৩০ মে দ্বিতীয় বারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেন তিনি। দীর্ঘ এক বছর কেটে গিয়েছে তাঁর দ্বিতীয় দফার শাসনকালের। এ দিনটি ছিল ভারতে করোনা শনাক্ত ও মৃত্যুরে রেকর্ডের দিন। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতেই আজ করোনার প্রকোপ বেশি। ভারতের বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা হতে মোদীর কিছু চরম ব্যর্থতা তুলে ধরা হল।
তার চরমব্যর্থতাগুলো হল-
১। রাম জন্মভূমির রায়ঃ প্রধান বিচারক দ্যর্থহীনভাবে বলেছেন, কোনভাবেই অযোধ্যার বাবড়ি মসজিদের নিচে কোন মন্দির ছিল না। কিন্তু মুসলিমদের তিনি অন্যত্র মসজিদ নির্মাণ করে নিতে বলেন আর হিন্দুদের জন্য দিয়ে দেন মসজিদের ভূমি। এটা স্পষ্টতই বিচারককে প্রভাবিত করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটি বিতর্কিত রায়। বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করে বিচার বিভাগের উপর মানুষের আস্থা কমিয়েছেন। তিনি গোধরাকাণ্ডে বিপুল সংখ্যক মুসলিম নিধনের বিচার করেননি এবং নমুনা নষ্ট করে বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ করেছেন।
২। এনআরসি ওদিল্লীর সহিংসতাঃ বিতর্কিত ও মুসলিমদের বিতাড়িত করার জন্য সরকার এই আইনটি পাশ করে। এই আইনের বিরুদ্ধে ভারতের সকল চিন্তাশীল, প্রগতিশীল ও মানবিক মানুষ প্রতিবাদ করেছেন। বিভিন্ন রাজ্য সরকারও এই আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। এটা সংখ্যালঘুদের জন্য একটি অবমাননাকর আইন। এটা আরো বিদ্বেষ বাড়িয়েছে। বিজেপি মুসলিম বিদ্বেষী রাজনীতি করে মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিয়েছে। বিতর্কিত নাররিকত্ব আইনের বিপক্ষে প্রতিবাদ জানাতে গেলে বিজেপির কর্মী ও পুলিশের হামলায় শত শত মুসলিম হতাহত হন। মুসলিমদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়া হয়।
৩। অর্থনীতি ধ্বংসঃ ভারতের অর্থনীতিতে অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে। ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি। গত ৬ বছরের ইতিহাসে তলানিতে এসে ঠেকেছে জিডিপি। দেশটির সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। পরের দুই প্রান্তিকে জিডিপি আরো সংকুচিত হয় যা এক অভূতপূর্ব মন্দার ইঙ্গিত দেয়। এর মধ্য দিয়ে টানা আট প্রান্তিক ধরে নিম্নমুখী রয়েছে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি। এতে আগামী দিনগুলোয় বিশ্বের দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ ভারতের আর্থিক খাতে সংকট আরও জোরালো হতে পারে। গত ১১ বছরের মধ্যে ভারতের সবচেয়ে খারাপ অর্থনীতি ছিল তার বিগত ১ বছর।
৪। কর্মসংস্থান করতে না পারাঃ মোদীর প্রতিশ্রুতি ছিল, তিনি ক্ষমতা পেলে দশ বছরে পঁচিশ কোটি চাকরি হবে। মানে, বছরে গড়ে আড়াই কোটি। গৃহস্থালির সমীক্ষার ভিত্তিতে সিএমআইই ২০১৬ সাল থেকে কর্মসংস্থানের যে হিসাব কষছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সালে দেশে মোট কর্মীর সংখ্যা ছিল ৪০ কোটি ৬৭ লাখ। ২০১৮ সালে সেটা কমে দাঁড়ায় ৪০ কোটি ৬২ লাখ, ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারিতে তা ৪০ কোটিতে ঠেকেছে। ২০১৭ সালে নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে ১৮ লাখ, কিন্তু এটা সেই বছরের নতুন কর্মপ্রার্থীর সংখ্যার ১২ শতাংশ, আর মোদী বছরে যে আড়াই কোটি নতুন কাজ দেওয়ার কথা বলেছিলেন, তার ৭ শতাংশ! সিএমআইই-র অন্য এক রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৪ থেকে ২০১৮, এই চার বছরে দেশে কর্মসংস্থানের বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার ছিল ১.৯ শতাংশ। আগের দশকের চেয়ে এই হার কম। অর্থাৎ, ইউপিএ-র দশ বছরে যে হারে নতুন কাজ তৈরি হয়েছিল, গত চার বছরে কাজ তৈরি হয়েছে তার চেয়ে কম হারে।
৫। বেকারত্বের হার বৃদ্ধিঃ সরকারি পরিসংখ্যান দেখলে, লেবার বুরো-র হিসাবে, ২০১৫-১৬ সালে বেকারত্বের অনুপাত ছিল ৩.৭ শতাংশ। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার (এনএসএসও) তথ্য হিসেবে সংবাদমাধ্যমে যা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখছি, ২০১৭-১৮ সালে বেকারত্বের হার দাঁড়ায় ৬.১ শতাংশ, গত চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশন অনুমোদন করা সত্ত্বেও মোদী সরকার এই রিপোর্টটি প্রকাশ করেনি, এবং সংস্থাটির দু’জন সদস্য এর ফলে পদত্যাগ করেছেন। এই রিপোর্টের আরও উদ্বেগজনক একটি তথ্য: শহরের তরুণদের প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ বেকার! সরকারি নথি থেকে পাওয়া এই পরিসংখ্যান দেখিয়ে দেয়, কর্মসংস্থানে মোদীর রেকর্ড শোচনীয়। শহর ও আধা-শহরে তরুণ কর্মপ্রার্থীর সংখ্যা বছরে গড়ে দেড় কোটি করে বাড়ছে। সেখানে এই ব্যর্থতা বিপুল হতাশা সৃষ্টি করতে বাধ্য।
৬। কৃষকদের আত্মহত্যার হার বৃদ্ধিঃ কৃষির হাল আরও অনেক বেশি খারাপ। লক্ষণীয়, ভারতের কর্মজীবী মানুষের অর্ধেকই এখনও কৃষিনির্ভর। মোদী কৃষকদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, তাঁরা চাষের খরচের উপর ৫০ শতাংশ লাভ পাবেন এবং ২০২২ সালের মধ্যে কৃষির আয় দ্বিগুণ হবে। সে সবের চিহ্নমাত্রও নেই, উল্টে ভারতীয় কৃষি ব্যাপক সঙ্কটে। ২০১৪ থেকে ২০১৭’র মধ্যে কৃষি আয়ের বৃদ্ধি-হার বার্ষিক গড় ২.৫১ শতাংশ। আগের দশকে (২০০৪-১৪) এই হার ছিল ৩.৭ শতাংশ, তার আগের দশকে (১৯৯৪-২০০৪) ২.৮৮ শতাংশ। আট বছরে কৃষির আয় দ্বিগুণ করতে গেলে আয়বৃদ্ধির বার্ষিক হার অন্তত ৯ শতাংশ হওয়া দরকার। সেটা তো অলীক স্বপ্নমাত্র। বাস্তব হল, আগের দুই দশকের চেয়েও মোদী যুগে কৃষির বৃদ্ধি-হার কম! গত ডিসেম্বরেই এক মহারাষ্ট্রেই ৩শ কৃষক আত্মহত্যা করেছে। ভারতে গত বছর ১২৩৬০ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। আগের টার্মে কালোটাকার কথা বলে নোট বাতিল করেও দেশকে ক্ষতিই করেছেন। কালো টাকা বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনার কথা বললেও চুপসে গেছেন। গ্রাম উন্নয়নেও তার ভূমিকা একেবারেই বেহাল।
৭। গত পাঁচ বছরের আর একটা বড় সমস্যা হল শিল্পবাণিজ্যের মন্দগতি এবং নতুন বিনিয়োগে কর্পোরেট সংস্থাগুলির প্রবল অনাগ্রহ। অদ্ভুত ব্যাপার হল, সরকারি পরিসংখ্যানে যখন জিডিপির দ্রুত বৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে, সেই সময়েই, গত চার বছরে, কর্পোরেট মুনাফার হিসাবে মন্দা চলছে! বেশির ভাগ কোম্পানির উৎপাদন ক্ষমতার বিরাট অংশ চাহিদার অভাবে অব্যবহৃত রয়েছে। সেই কারণেই তারা নতুন বিনিয়োগে নারাজ। কলকারখানা, যন্ত্রপাতি ইত্যাদিতে বিনিয়োগের অঙ্ক ২০১৪ সালে ছিল জিডিপির ৩৪.৩ শতাংশ, ২০১৭ সালে সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০.৭ শতাংশ। ইউপিএ আমলে এই অনুপাত ছিল গড়পড়তা ৩৯ শতাংশ, মোদী জমানার গড় হল ৩১.৮ শতাংশ। পাশাপাশি, খাদ্য ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে দেওয়া ব্যাঙ্কঋণের অঙ্কও গত চার বছরে অত্যন্ত কম। সেটাও অর্থনীতির মন্দগতির পরিচয় দেয়। শিল্পক্ষেত্রে প্রদত্ত ব্যাঙ্কঋণের গতিপ্রকৃতি যদি দেখি, তা হলে ছবিটা আরও করুণ।
৮। শিল্পে ব্যর্থতাঃ শিল্পবাণিজ্য সংস্থাগুলি যখন কলকারখানা ও যন্ত্রপাতিতে নতুন বিনিয়োগ করে না, ঋণের ধারা যখন শীর্ণ হয়, তখন কাজের সুযোগ সঙ্কুচিত হওয়াই স্বাভাবিক। এখন ঠিক সেটাই হচ্ছে। বাড়তি চাহিদা আসতে পারত রফতানি থেকে, কিন্তু এই জমানায় সেখানেও ভাটার টান। ২০১৪ সালের আগের দুই দশকে ভারতের রফতানি বছরে গডপড়তা ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ বেড়েছে, গত চার বছরে সেই হার কমে দাঁড়িয়েছে ১.৬ শতাংশ! এর ফলে চলতি খাতে বিদেশি মুদ্রার ঘাটতি অনেকটা বেড়ে ২.৯ শতাংশে পৌঁছেছে। এটাই মার্কিন ডলারের দাম চড়তে চড়তে ৭০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার একটা বড় কারণ।
৯। মারাত্মক বৈষম্য বৃদ্ধিঃ প্রথমত, এটা শোচনীয় ব্যাপার যে, ২০১১-১২ সালের পর থেকে দারিদ্রের কোনও সরকারি তথ্যই নেই। তবে আরও ভয়ঙ্কর হল, কোটি কোটি ভারতবাসী যখন বেঁচে থাকার জন্য কঠিন সংগ্রাম করে চলেছেন, তখন ধনীদের আয় ও সম্পদ হুহু করে স্ফীত হচ্ছে। বিশ্বের অর্থনৈতিক অসাম্য নিয়ে অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি ও তাঁর সতীর্থদের তৈরি ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি ডেটাবেস-এর সাম্প্রতিকতম তথ্য অনুসারে, দেশের গড়পড়তা আয় ও সম্পদ যে হারে বাড়ছে, সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশের আয় ও সম্পদ বাড়ছে তার চেয়ে অনেক বেশি হারে। আর, আয় ও সম্পদে নীচের তলার অর্ধেক মানুষের ভাগ ক্রমশই কমছে। এই বাস্তবের পাশে মোদীর ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’ স্লোগান খুবই হাস্যকর হয়ে উঠেছে।
১০। সর্বদিকে ব্যর্থতাঃ আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়মের দাম অনেক কমেছে সাম্প্রতিক সময়ে কিন্তু ভারতে পেট্রোলিয়মের দাম অনেক কমানো হয়নি। অর্থনীতিকে উদ্ধারে এটাও কাজে লাগাতে পারেনি। তাঁর বহুল প্রচারিত ‘আত্মনির্ভর ভারত’ এবং করোনা মোকাবেলায় ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজের ভিতরটা ফাঁকাই ছিল। ভারত আজ স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি দুইখাতেই ধুকছে। বিরোধীরা তাই যৌক্তিকভাবেই দাবি করছে- অর্থনীতি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, করোনা নিয়ন্ত্রণ— সব ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত ব্যর্থ মোদী সরকার।
১১। অশান্তি যুদ্ধঃ কাশ্মিরীদের সুযোগ সুবিধা কেড়ে নিয়েছেন অযৌক্তিকভাবে। অশান্ত হয়ে উঠেছে কাশ্মির। ভোটের রাজনীতির কারণে পাকিস্তানের সাথে সময়মতো যুদ্ধ বাধিয়েছেন। সে যুদ্ধেও সুবিধা করতে পারার নজির দেখা যায়নি। চীনের সাথে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। নেপালের সাথে সম্পর্ক ঠেকেছে তলানিতে। উল্টো নেপালই হুমকি দিয়ে ভারতের দখলে থাকা জমি উদ্ধারের ঘোষণা দিয়েছে। রাজ্যে রাজ্যেও বিজেপের উগ্রপন্থী সমর্থকদের দিয়ে বিরোধেীদের সাথে সংঘাত চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রথম টার্ম ও দ্বিতীয় টার্মের এক বছরে মোদী সরকার ভারতে ধর্মীয় বিদ্বেষটা চূড়ান্তরকমভাবে বাড়িয়ে দিয়েছেন। হিন্দুত্ববাদের জাগরণ ঘটিয়ে হত্যা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাড়িয়েছেন। মানুষকে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন। তাদের দিয়ে গোমূত্র খাওয়ানোসহ বিজ্ঞানবিরোধী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থেকেছেন। এতো ব্যর্থতার মাঝেও তিনি তার ব্যর্থতার কালকে স্বর্ণযুগ ঘোষণা করেছেন নিজেরা নিজেরা। এতোসব ব্যর্থতা কিভাবে কাটিয়ে উঠবেন সে প্রশ্নই রেখেছেন বিশেষজ্ঞরা।