খতমে শেফা, খতমে জালালি, খতমে ইউনুস, খতমে খাজেগান ইত্যাদি খতম পাঠের বিধান নিয়ে কিছু কথা
উপরোক্ত খতমের দোয়াসমুহ কি ইসলামী শরিয়থ সমর্থিত? এসব খতম এবং এতে পঠিত দুআগুলো বিপদাপদে পাঠ করা যাবে কি না, এ নিয়ে অনেকেই দ্বিধান্বিত। মূলতঃ এ বিষয়ে আমাদের পর্যবেক্ষনে আলেম সমাজের দুই ধরণের অভিমত পরিলক্ষিত হয়। পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করছি ইনশাআল্লাহ-
এক. এতদঞ্চলের অর্থাৎ, বাংলাদেশসহ আমাদের সাব কন্টিনেন্টেলের অধিকাংশ আলেম উলামাগণ পূর্ববর্তী আলেম, মনীষী এবং বুযুর্গানে দ্বীন ও আউলিয়ায়ে কেরামের অভিজ্ঞতার আলোকে এসব খতম পাঠকে বৈধ মনে করেন।
তাদের বক্তব্য হলো- অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রমাণিত যে, কোন পার্থিব উদ্দেশ্যে কালেমায়ে তাইয়্যেবা অর্থাৎ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এক লক্ষ বার বা একলক্ষ পঁচিশ হাজার বার পাঠ করলে সে উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে থাকে। এটাকে খতমে জালালী বা লাখ কালেমা পাঠ বলা হয়। একে খতমে শেফা বা খতমে তাহলীলও বলা হয়।
এটা যেহেতু কুরআন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত কোন বিষয় নয় তাই এটাকে সুন্নাত মনে করা যাবে না। সুন্নাত মনে করে পড়লে বিদআত হবে। খতমে ইউনুস ও খতমে খাজেগান সম্পর্কেও একই কথা। বুযুর্গানে দ্বীন ও উলামায়ে কেরামের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে সোয়া লক্ষ বার দুআয়ে ইউনুস পাঠ করে দুআ করা হলে এই ওসীলায় আল্লাহ তাআলা রোগ-ব্যাধি ও বিপদ-আপদ থেকে হেফাজত করেন। তবে বিশেষভাবে জানার বিষয় হচ্ছে, এ পদ্ধতিকে কোন সুন্নাত তরীকা মনে করা যাবে না।
অনুরূপভাবে বুযুর্গানে দ্বীন যে খতম পড়ে দোয়া করতেন সে খতমকে খতমে খাযেগান বলে। 'খাযেগান' শব্দের অর্থ হলো হলো সাহেবগণ। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, মনীষী ও বুযুর্গাণে দ্বীন। সুন্নাত মনে না করে খতমে খাযেগানের আমলও করার অবকাশ রয়েছে। এটি বিদআতের সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হয় না। বিদআত হবার জন্য সেটিকে ধর্মীয় কাজ মনে করা, সওয়াবের কাজ মনে করতে হয়। আর উপরোক্ত কাজগুলো সওয়াবের কাজ হিসেবে নয় বরং প্রতিষেধক হিসেবে আমল করা হয়। যেমন ডাক্তার রোগের চিকিৎসা স্বরূপ পথ্য প্রদান করে থাকেন। সেই উসিলায় আল্লাহ তাআলা রোগমুক্ত করে থাকেন মর্মে ডাক্তারদের অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত। তাই এসব ব্যবহার করা হয় প্রতিষেধক হিসেবে। সওয়াবপ্রাপ্তির আশায় এসব খতমের আমল কেউ করেন- বিষয়টি এমন নয়।
তেমনি উপরোক্ত কাজগুলো দ্বারা কতিপয় কাঙ্খিত বস্তু অর্জিত হয় মর্মে বুযুর্গানে দ্বীনের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রমাণিত। তাই কার্যসিদ্ধির আশায় উক্ত আমলগুলো করা হয়ে থাকে। সওয়াবের জন্য নয়। তাই এসব আমল রোগমুক্তিসহ অন্যান্য জায়েজ উদ্দেশ্যে করার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নেই।
দুই. পক্ষান্তরে আরবপন্থী, নিজেদেরকে নব্য সংস্কারবাদী বলে পরিচয় দেয়া অন্য একটি দল যাদেরকে ইতোপূর্বে আমাদের এতদঞ্চলে তেমন দেখা না গেলেও ইদানিংকালে তাদের পদচারণা লক্ষ্য করা যায়, তারা মনে করে থাকেন, এ সকল খতম ভিত্তিহীন এবং নিছক বিদআতমূলক কাজ। তাদের দাবি, আমাদের দেশসহ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাক্স্তিান, ভারত, মিশর, তুরস্ক, লিবিয়া এবং ইরাকসহ অনেক দেশের মুসলিমগণ এসব খতম যেভাবে পাঠ করে থাকেন, হুবহু এইভাবে খতম পাঠের কোনো পদ্ধতি কুরআন হাদিসে যেহেতু বর্ণিত নেই, তাই এগুলো বিদআতের অন্তর্ভূক্ত। তারা বলেন, 'রাসূল ﷺ তাঁর জীবনে কখনো সাহাবীদেরকে এরূপ খতম নামের কোনো কথা বলেননি বা শিক্ষা দেননি।'
অবশ্য 'ঠগ বাছতে গা উজার' কিংবা 'লোম বাছতে কম্বলের অস্তিত্ব বিনাশ' এর মত অবস্থা যে হয় না তা নয়। ইসলামের সঠিক দিকনির্দেশনায় চলতে সতর্কতার প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু তারও মাত্রা এবং পরিমিতিবোধ থাকা চাই। মধ্যপন্থা বলে একটা কথা আছে। দ্বীন এবং দুনিয়ার সকল বিষয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে চলাকেই আমার কাছে শ্রেয় মনে হয়। না অতি কঠোর-কট্টর, না একেবারে ঢিলেঢালা- লাগামহীন স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়া। এ দু'য়ের মাঝামাঝি থাকা উত্তম। দুঃখজনকভাবে বিদআত থেকে বেঁচে থাকতে গিয়ে অতি সতর্কতা অবলম্বন করার ফলে আমরা অনেককে বিভিন্ন সুসাব্যস্ত সুন্নাত আমল নিয়ে অর্থহীন মতভিন্নতায় লিপ্ত হতে দেখি এবং এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুন্নত, নফল অনেক আমলকে বিদআতের অপবাদ দিয়ে সেগুলো এড়িয়ে চলতে দেখি। সত্যি কথা বলতে, বিদআত বিদআত বলে যারা সুসাব্যস্ত সুন্নাত এবং নফল অনেক আমলকে বিতর্কিত করার প্রয়াসে লিপ্ত, দুঃখজনকভাবে তাদের অনেকের কাছে বিদআতের সঠিক সংজ্ঞাটা পর্যন্তু স্পষ্ট নয়।
মাযহাব তাকলীদ নিয়েও একই কথা। এই অতি উৎসাহী শ্রেণিটি এই বিষয়টিতেও বেশ সরব। তারা মাযহাব অনুসরণ করাকে শিরক বিদআত বলে থাকেন, অথচ, প্রকৃত কথা হলো, তারা নিজেরাও প্রত্যেকেই কোনো না কোনো পূর্ববর্তী মনীষীকে ফলো করেন। চারম ইমামের কোনো একজনকে অনুসরণ করাকে যদি তারা বিদআত বলেন, তাহলে তারা যে ইমাম নাসিরুদ্দিন আলবানি, ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে অনুসরণ করেন, সেক্ষেত্রে বিদআত, শিরক ইত্যাদি হয় না? না কি বিদআত, শিরক এসব বিষয়ের প্রয়োগ তাদের বেলায় নয়, শুধু চার ইমামের অনুসরণকারীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য? সকল কিছুকে পাইকারিভাবে বিদআত বলার ধৃষ্টতা তাদের পরিহার করে দ্বীনের ভেতরে ফিতনা উস্কে দেয়ার অপরিনামদর্শী কাজ হতে বিরত হওয়া উচিত।
সর্বোপরি আপনার জন্য পরামর্শ হলো, এগুলো যেহেতু নফল আমল, সে কারণে সুন্নাত না ভেবে ইচ্ছে করলে আমল করতে পারেন, অথবা না-ও করতে পারেন। সমাজে বিতর্ক সৃষ্টির অনেক উপাদান রয়েছে। বিতর্ক উস্কে দেয়ার মত লোকও অনেক। বিতর্ক পরিহার করে চলাই আমাদের কাজ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা আমাদের সহিহ পথে আমল করার তাওফিক দান করুন।
ব্লগার সন্ধ্যা রাতের ঝিঁঝিঁ ইসলামী শরিয়তে খতমে শেফার বৈধতার বিষয়ে জানানোর অনুরোধ করেছিলেন আমার নবী চরিত্রের এক ঝলক; তিনি ছিলেন উত্তম আদর্শের মূর্ত প্রতীক... পোস্টে। মূলতঃ তার জ্ঞানার্জনের ঐকান্তিক আগ্রহ লক্ষ্য করেই এই পোস্ট। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশ্নটি করায় অসংখ্য শুভকামনা এবং দুআ তার জন্য। লেখাটি উৎসর্গ করছি তাকেই।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০২০ সকাল ৯:৪২