ক্ষুদ্র মানবজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে অদ্ভূত কিছু সাযুজ্য যা ভাবনার খোড়াক যোগায়
একটি নবজাতক যখন জম্মগ্রহণ করে, পৃথিবীর আলো-বাতাসের মুখ প্রথম দেখে, তখন তার কানে আযান দেয়া হয়। আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে, আযান দেয়া হলেও তখন কোন সালাত আদায় করা হয় না। কিন্তু সেই নবজাতকই তার পার্থিব জীবনের পরিসমাপ্তিতে একটি সময়ে এসে যখন মৃত্যুবরণ করে, তখন একটি সালাত (জানাযা) ঠিকই আদায় করা হয় যে সালাতের পূর্বে দেয়া হয় না কোন আযান। -কি অসাধারণ একটি বিষয়! ভাবনার খোড়াক নয় কি?
নবজাতকের কানে আযান দেওয়া সুন্নাত। একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ عُبَيْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي رَافِعٍ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «أَذَّنَ فِي أُذُنِ الْحَسَنِ بْنِ عَلِيٍّ حِينَ وَلَدَتْهُ فَاطِمَةُ بِالصَّلَاةِ
হযরত উবায়দুল্লাহ বিন আবী রাফে তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ফাতিম রাঃ যখন হাসান বিন আলী রাঃ কে প্রসব করলেন, তখন আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হযরত হাসান বিন আলীর কানে সালাতের আজানের মত আজান দিতে দেখেছি। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৫১০৫, সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-১৫১৪
আবার, একজন নবজাতক মানবশিশু যখন মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসার পরে পৃথিবীতে প্রথম চোখ তুলে তাকায়, তার আদৌ জানা থাকে না, মাতৃগর্ভের ভিন্ন এক জগত থেকে কে তাকে বের করে এনেছে এবং কেইবা তাকে তুলে দিয়েছে স্নেহময়ী মায়ের কোলে। ঠিক একইরকমভাবে তার এ বিষয়টিও অজানাই থেকে যায় যে, মৃত্যুর পরে কে/ কারা আলগোছে এবং অতি সন্তর্পনে তাকে শুইয়ে রেখ যায় কবর নামক নতুন গৃহাভ্যন্তরে। -মানব জীবনের কি আজব এক নিরন্তর চলমানতা! চিন্তার বিষয় নয় কি?
আমাদের আশ্চর্যজনক জীবন পরিক্রমার বর্ণনা উঠে এসেছে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে। এক স্থানে ইরশাদ হয়েছে-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِن كُنتُمْ فِي رَيْبٍ مِّنَ الْبَعْثِ فَإِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن تُرَابٍ ثُمَّ مِن نُّطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ مِن مُّضْغَةٍ مُّخَلَّقَةٍ وَغَيْرِ مُخَلَّقَةٍ لِّنُبَيِّنَ لَكُمْ ۚ وَنُقِرُّ فِي الْأَرْحَامِ مَا نَشَاءُ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى ثُمَّ نُخْرِجُكُمْ طِفْلًا ثُمَّ لِتَبْلُغُوا أَشُدَّكُمْ ۖ وَمِنكُم مَّن يُتَوَفَّىٰ وَمِنكُم مَّن يُرَدُّ إِلَىٰ أَرْذَلِ الْعُمُرِ لِكَيْلَا يَعْلَمَ مِن بَعْدِ عِلْمٍ شَيْئًا ۚ وَتَرَى الْأَرْضَ هَامِدَةً فَإِذَا أَنزَلْنَا عَلَيْهَا الْمَاءَ اهْتَزَّتْ وَرَبَتْ وَأَنبَتَتْ مِن كُلِّ زَوْجٍ بَهِيجٍ
হে লোকসকল! যদি তোমরা পুনরুত্থানের ব্যাপারে সন্দিগ্ধ হও, তবে (ভেবে দেখ-) আমি তোমাদেরকে মৃত্তিকা থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর বীর্য থেকে, এরপর জমাট রক্ত থেকে, এরপর পূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট ও অপূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট মাংসপিন্ড থেকে, তোমাদের কাছে ব্যক্ত করার জন্যে। আর আমি এক নির্দিষ্ট কালের জন্যে মাতৃগর্ভে যা ইচ্ছা রেখে দেই, এরপর আমি তোমাদেরকে শিশু অবস্থায় বের করি; তারপর যাতে তোমরা যৌবনে পদার্পণ কর। তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ মৃত্যুমুখে পতিত হয় এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে নিষ্কর্মা বয়স পর্যন্ত পৌছানো হয়, যাতে সে জানার পর জ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে সজ্ঞান থাকে না। তুমি ভূমিকে পতিত দেখতে পাও, অতঃপর আমি যখন তাতে বৃষ্টি বর্ষণ করি, তখন তা সতেজ ও স্ফীত হয়ে যায় এবং সর্বপ্রকার সুদৃশ্য উদ্ভিদ উৎপন্ন করে। -সূরাহ আল হাজ্জ, আয়াত ০৫
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
مِنْهَا خَلَقْنَاكُمْ وَفِيهَا نُعِيدُكُمْ وَمِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً أُخْرَىٰ
এ মাটি থেকেই আমি তোমাদেরকে সৃজন করেছি, এতেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে দিব এবং পুনরায় এ থেকেই আমি তোমাদেরকে উত্থিত করব। -সূরাহ ত্ব-হা-, আয়াত ৫৫
একজন নবজাতক যখন জম্মগ্রহণ করে, সে জানে না, তার আগমনে কে খুশি হয়েছে এবং কে তাকে স্বাগত জানিয়েছে। আবার সে যখন মৃত্যুবরণ করে, তখনও তার জানা থাকে না, কে তার জন্যে কেঁদে অশ্রু ঝড়ায় কিংবা কে তার বিদায়ে দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে শোকের সাগরে ভাসতে থাকে। -শুরু এবং শেষে কি আশ্চর্য্যরকম মিল! শিক্ষার বিষয় নয় কি?
কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে-
وَأَنَّهُ هُوَ أَضْحَكَ وَأَبْكَىٰ
এবং তিনিই হাসান ও কাঁদান
وَأَنَّهُ هُوَ أَمَاتَ وَأَحْيَا
এবং তিনিই মারেন ও বাঁচান,
وَأَنَّهُ خَلَقَ الزَّوْجَيْنِ الذَّكَرَ وَالْأُنثَىٰ
এবং তিনিই সৃষ্টি করেন যুগল-পুরুষ ও নারী। -সূরাহ আননাজম, আয়াত ৪৩-৪৫
জন্মের পরে নবজাতককে গা-গোসল ইত্যাদির মাধ্যমে উত্তমরূপে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করানো হয়। ঠিক একইরকমভাবে মৃত্যুর পরেও আবার তাকে গোসল দিয়ে উত্তমরূপে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করানো হয়। -কি অদ্ভূত সাযুজ্য! ভাববার বিষয় নয় কি?
হযরত উম্মে আতিয়্যা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা হতে বর্ণিত যে, রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর কন্যা যয়নব রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা -এর ইনতিকালের পরে রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছু মহিলাকে হুকুম করলেন, তোমরা তাকে গোসল করাও, তিনবার অথবা পাঁচবার অর্থাৎ বেজোড় সংখ্যায় শরীরে পানি ঢালবে এবং তাকে বরই পাতা মিশ্রিত গরম পানি দ্বারা গোসল দিবে।
বরই পাতা দ্বারা গরমকৃত পানি দিয়ে মৃত ব্যক্তিকে গোসল করানো মুস্তাহাব। এর দ্বারা উপকার হচ্ছে- এর দ্বারা ময়লা দূর হয় এবং মৃত ব্যক্তির লাশ দেরীতে নষ্ট হয়। -তিরমিযী শরীফ, খন্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১৯৩, রদ্দুল মুহতার, খন্ড: ২, পৃষ্ঠা: ১৯৬, বাদায়িউস সানায়ে, খন্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৩০১
একজন মানুষ, সে এই পৃথিবীর যত বড় বিখ্যাত কেউ হোন অথবা, অজানা অচেনা পথের ফকিরই হোন, মাতৃগর্ভ নামক একটি জগত পেরিয়েই প্রত্যেককে এই পৃথিবীর আলো বাতাসে আসতে হয়েছে। পৃথিবীতে এসে রাজা বাদশাহ হয়ে রাজসিংহাসনে বসলেও যখন সে মাতৃগর্ভে ছিল, তাকে থাকতে হয়েছিল নিতান্ত সংকীর্ণ ও অন্ধকার একটি স্থানেই। আবার পার্থিব জীবনের পরিসমাপ্তিতে মৃত্যুর যবনিকা পেরিয়ে যখন তাকে কবরে রাখা হয়, রাখা হয়ে থাকে ঠিক সংকীর্ণ ও অন্ধকার একটি স্থানেই। তার মানে, বেশি জায়গা দখল করে বিলাসী জীবনের সুযোগ শুরু এবং শেষ - কোনটাতেই নেই। -কি আশ্চর্য্য সামঞ্জস্য আদি এবং অন্তে! উপদেশ গ্রহণের বিষয় নয় কি?
একটি নবজাতকের জন্মগ্রহণের পরে তাকে সদ্য কিনে আনা উত্তম কাপড়ে জড়িয়ে নেয়া হয়। আবার যখন সে মৃত্যুবরণ করে, তার শরীরেও জড়িয়ে দেয়া হয় অনুরূপই ধবধবে সাদা উত্তম কাপড়। -কি অদ্ভূত মিল! শেখার কিছু থাকে তো কেবলমাত্র জ্ঞানবানদের জন্যই!
নবজাতকের জন্মলাভের পরে ধীরে ধীরে সে বড় হয়। এখানকার লোকেরা তাকে তার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে প্রশ্ন করে। নানান স্থানে নানানজনকে এই প্রশ্নের উত্তর জীবনে বহুবার তাকে দিতে হয়। ঠিক একইরকমভাবে জীবনের পাট চুকিয়ে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহনের ভেতর দিয়ে ঐ পাড়ে চলে যাওয়ার পরে তাকে যখন কবরে রেখে আসা হয় ফেরেশতাগণ এসে তাকে প্রশ্ন করেন তার জীবনে কৃত আমলগুলো সম্পর্কে জেনে নেয়ার জন্য। -দুই জীবনের মাঝে কি অসাধারণ মিল! প্রিয় বন্ধু, বিষয়গুলো শিক্ষনীয় নয় কি? সুতরাং, প্রস্তুতি নেয়ার এখনই সময় নয় কি?
পরকালের প্রথম ধাপ কবর। কবরে বান্দাকে তিনটি বিশেষ প্রশ্ন করা হবে। বিখ্যাত সাহাবি হযরত বারা বিন আজেব রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কবরে মানুষকে তিনটি প্রশ্ন করা হবে— এক. তোমার রব কে? দুই. তোমার দ্বিন কী? তিন. এই ব্যক্তি কে ছিলেন, যাঁকে তোমাদের কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল? কবরবাসী যদি মুমিন হয়, তাহলে এসব প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিতে পারবে। আর যদি কাফির হয়, তাহলে বলবে, আফসোস! আমি কিছুই জানি না। -আবু দাউদ, হাদিস : ৪৪৫৩; তিরমিজি, হাদিস : ৩১২০
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০২২ সকাল ১১:২৯