বাংলাদেশী এক অসহায় বাবা আর তার জাপানি স্ত্রীর চলমান আলোচিত ঘটনাপ্রবাহ আমাদের অনেকেরই জানা। মিডিয়ার কল্যানে এই ঘটনা পরম্পরা এখন শহর গ্রাম ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ কথা খুবই সত্য যে, জাপান আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলোর একটি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর একটি জাপান। জাপানের অনেক কিছুকে আমাদের কাছে ভাল মনে হলেও এই দেশটির পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি আইন কানূন সম্মন্ধে যারা মোটামুটি খোজখবর রাখেন, তারা একবাক্যে স্বীকার করে নিবেন যে, জাপানের আইনে পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে স্পষ্টতই জাপানি নাগরিকদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া হয় বা বড় করে দেখা হয়। পুরুষ কিংবা নারী যিনিই হোন, তিনি যদি জাপানি নাগরিক হয়ে থাকেন, সাধারণতঃ আইনের রায় তার পক্ষেই চলে যায়। শিশু সন্তানের অভিভাবকত্ব প্রশ্নেও এই নিয়মনীতির দেখা সচরাচর মেলে দেশটির বাস্তবতায়। সে দেশের পারিবারিক আইনের কিছু ধারা এমন রয়েছে, যেগুলোকে কালাকানূন হিসেবেই দেখা হয় পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে। এসব আইনকানূন এবং বিধিবিধান নিয়ে বিস্তর সমালোচনা এবং আপত্তিও রয়েছে বহির্বিশ্বে, যদিও অন্যান্য দেশ ও মানবাধিকার সংগঠনের এসব সমালোচনা কিংবা আপত্তিকে তেমন গুরুত্বের সাথে নেয়ার নজির জাপানের সাম্প্রতিক ইতিহাসে তেমন দেখা যায় না।
ঘটনার পেছনের ঘটনাঃ
জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো। পেশায় একজন ডাক্তার। বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক ইমরান শরিফের সাথে। সে ২০০৮ সালের কথা। সে বছরের ১১ জুলাই তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ইমরান শরিফ পড়াশোনা করেছেন আমেরিকায়। চাকরিও করেছেন সে দেশেরই একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। সেই কোম্পানির চাকরি সূত্রেই মূলতঃ তার জাপান গমন। জাপানে সেই কোম্পানিতে চাকরিরত থাকাবস্থায়ই নাকানো এরিকোর সাথে পরিচয় এবং পরবর্তীতে বিবাহ। এরপরে একে একে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। এরিকো-ইমরান দম্পতির ঘর আলোকিত করে এসেছে তিন কণ্যা সন্তান। তিন মেয়ে যথাক্রমে জেসমিন মালিকা (১১), লাইলা লিনা (১০) ও সানিয়া হেনা (৭)।
যা হোক, এরিকো-ইমরান দম্পতির সংসারটি বলা চলে বেশ ভালোই চলছিল। এরিকো-ইমরান দম্পতির মামলার তথ্যাদি এবং গণমাধ্যমে প্রচারিত ইমরান শরিফের বক্তব্য থেকে যতটুকু জানা গেছে, সমস্যা দেখা দেয় রাজধানী টোকিওতে এরিকো তার নিজের এবং পিতার নামে একটি ফ্লাট কেনার পরে সেই ফ্লাটটির মূল্য পরিশোধের বিষয় নিয়ে। ফ্লাটটি এরিকো এবং এরিকোর পিতার নামে কেনা হলেও সেখানে মাসে মাসে অর্থ পরিশোধ করতে হতো ইমরান শরিফকে। ইমরান শরিফের ভাষায়, এটি ছিল তার উপরে চাপিয়ে দেয়া একটি বিপদ। প্রতিমাসে কয়েক লক্ষ টাকার কিস্তি শোধ করতে করতে একপর্যায়ে তার চাকরি জীবনে জমানো অর্থ খরচ করতে করতে প্রায় রিক্তহস্ত হয়ে পড়েন ইমরান শরিফ। তিনি তখন প্রতি মাসে তার দেয়া টাকার অংক কিছুটা কমানোর অনুরোধ করেন স্ত্রী এরিকোকে। কিন্তু স্ত্রী নিজের সিদ্ধান্ত স্বামী ইমরান শরিফকে মানতে বাধ্য করতেই অনড় ছিলেন। অবশেষে যা হবার নয় সে দিকেই এগুতে থাকে পরিস্থিতি। এরিকোর দাবি না মানায় ইমরানকে বারংবার লিগ্যাল নোটিশ দেন এরিকো। বস্তুতঃ একটি সময়ে ইমরান শরিফ বাধ্য হন সেই বাসা হতে বের হয়ে আসতে। পরবর্তীতে জাপানের পারিবারিক আদালতে মামলা করেন এরিকো। সেই মামলা চলমান থাকাবস্থায়ই ইমরান শরিফ বড় এবং মেঝ মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। জাপানের আদালত দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা যেহেতু দেয়নি সেহেতু তিনি আসতেই পারেন। তিনি এসেছিলেন মূলতঃ এই মামলায় জাপানের আদালতের পূর্বাপর ঘটনা পরম্পরা সম্পর্কে তিনি জানার পরেই। কারণ তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, জাপানের আদালত সন্তানের অভিভাবকত্ব প্রশ্নে জাপানি নাগরিকদের স্বার্থ বিবেচনায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। পিতা বা মাতা যিনিই হোন, তিনি যদি অন্য দেশের হয়ে থাকেন, সন্তানের অভিভাবকত্ব তাদের যে দেয়ার নজির নেই, তিনি সেটা ভালোভাবে জেনেশুনেই জাপান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হন। বাংলাদেশে আসার পরের ঘটনা পরম্পরা আমাদের সকলেরই কমবেশি জানা।
কিছু লোক ইমরান শরিফকে এরিকোর ভাষায় সন্তান নিয়ে পালিয়ে আসার অপবাদ দিতেও কার্পণ্য করেননি। কথায় কথায় এরা এরিকোকে মাথায় তুলতেও ভোলেন না। এরা জাপানের পক্ষপাতমূলক সমাজ জীবনের অঘোষিত প্রথাকে সমর্থন করে তাদের স্বরে প্রতিধ্বনি করেই যেন বলতে চান যে, বাবা আবার কে? বাবার প্রসঙ্গ কেন? তারাও যেন স্বীকার করে নিতে চান যে, বাবার কোন অনুষঙ্গ বা প্রসঙ্গই নেই সন্তানের জীবনে। বাবা যেন সন্তানের কেউই নন। বাবার যেন সন্তানের প্রতি কোন ধরনের অধিকারই থাকতে নেই। আমাদের এই অন্ধত্ববোধের অবসান হওয়া উচিত।
যারা নিজেদের পরিবারে, বিশেষ করে আপন আপন বাবার কাছ থেকে আশৈশব দুর্ভাগ্যক্রমে যথাযথ স্নেহ, মমতা এবং আদর যত্ন না পেয়েই বড় হয়েছে, তাদের পক্ষেই বাবাদের অবজ্ঞার চোখে দেখা মানায়। সন্তানের জীবন থেকে যারা বাবাদের মুছে ফেলতে চান, তারা কারা? বাবাকে, বাবার অস্তিত্বকে সন্তানের জীবন থেকে সরিয়ে দেয়ার কৌশল কি আদৌ কোন সুস্থ মানুষের ভাবনায় আসতে পারে? কিছু লোককে দেখা গেছে, যারা জাপানি এক মাকে ফেরেশতার কাতারে তুলে অসহায় বাবাকে নির্মমতা, প্রতিশোধপরায়নতা এবং সর্বোপরি স্ত্রী সন্তানদের প্রতি দায়িত্বহীন অথর্ব হিসেবে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছেন। এটা কেবল উপরে উল্লেখিত বিশেষ লোকদের পক্ষেই হয়তো শোভনীয়।
আর এর বিপরীতে যারা বড় হওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের বাবা এবং মা উভয়ের ভালোবাসা, আদর এবং স্নেহ মমতা অবারিতভাবে লাভ করেছেন, তারা নিঃসন্দেহে বাবা এবং মা উভয়ের প্রতিই একইরকম দায়িত্বশীল এবং ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ শিখেছেন। তারা বাবার প্রতি অবিচার করেন না, মায়ের প্রতিও। তারা বাবাকে তিরষ্কার করেন না, মাকেও ধিক্কার দেন না।
প্রতিটি শিশুর জন্য মায়ের যেমন থাকে অকৃত্রিম ভালোবাসা, অনিঃশেষ মাতৃপ্রেম, মাতৃমমতা; বাবারও কোন অংশে কম নয়, কোনভাবেই বাবার অবদানকে, বাবার স্নেহ বাৎসল্যকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। মাতৃ এবং পিতৃস্নেহকে আলাদা করে ভাবতে যাওয়াটা কঠিন। এর পরিমান এবং পরিমাপ করাও রীতিমত অসম্ভব। তবে, গর্ভে ধারণ এবং প্রসবকালীন সীমাহীন কষ্টসহ শিশু জন্মদান এবং তাকে বড় করে তোলার ক্ষেত্রে মায়ের আত্মত্যাগ যে কোন কোন দিক বিচারে অন্য যে কারোর চেয়ে বেশি সে কথা বুঝা যায়, প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একটি হাদিস থেকে, যেখানে তিনি সন্তানের নিকট সবচেয়ে বেশি অধিকার কার - এমন প্রশ্নের উত্তরে মায়ের কথা তিনবার বলার পরে পিতার অধিকারের কথা বলেছেন।
মা তুলনাবিহীনঃ
মায়ের কথা তিনবার বলার পরে পিতার অধিকারের কথা উল্লেখ করার কারণ রয়েছে। মা জীবনের ঝুকি নিয়ে দশ দশটি মাস সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন। সন্তান মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সময়টা মায়ের জন্য বড়ই স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণও বটে। সেই সময়গুলো মাকে সারাক্ষণই থাকতে হয় এক অজানা ভয় ও শঙ্কার মাঝে। অন্যরকম এক অনুভব-অনুভূতি মাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখে সারাক্ষণ। অকল্পনীয় কষ্টে মা গর্ভে ধারণ করেন একটি শিশুকে। অতঃপর পৃথিবীর আলো-বাতাসের স্পর্শে আসার পরেও তাকে দূরে সরিয়ে দেন না। বুকে আগলে রাখেন সারাক্ষণ। নিজের খেতে ইচ্ছে না করলেও মাকে খেতে হয়। তিনি বাচ্চার জন্য খান। মা না খেলে বাচ্চা দুধ পাবে না যে। বাচ্চার জন্য নিজের সর্বস্ব উজার করে দিতেও কার্পণ্য করেন না মা। এই তো মা। মায়ের কষ্ট বুঝবে কে? অনাগত সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তায় অষ্টপ্রহর স্বপ্ন বুনে চলেন প্রতিটি মা। মা সাবধানে সন্তর্পনে চলেন, প্রতিটি পদক্ষেপে তার থাকে বিশেষ সতর্কতা, যাতে অনাগত সন্তানের সামান্য ক্ষতি না হয়। মা বেছে বেছে দেখে শুনে পা ফেলেন, যাতে সন্তানের কোন ধরণের অকল্যান না হয়। মা বুঝেসুঝে খান এবং পান করেন যাতে তার অনাগত সন্তান সুস্থ থাকে। মায়ের গোটা সময়টাই তখন আবর্তিত হয় সন্তানকে ঘিরে। এরপরে একটি পর্যায় আসে। মাকে আরও বড় ঝুকির ভেতর দিয়ে যেতে হয়। মা জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নিজেকে সমর্পন করেন নির্দ্বিধায়। এই সময়টায় একজন মা যে কেমন অবস্থায় থাকেন, প্রিয়তমা স্ত্রীকে দেখে তার বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করেছি। শত দ্বিধা, শঙ্কা আর ভীতিকাতরতার মাঝেও মা শান্তনা খুজে নিতে চেষ্টা করেন সন্তানের মুখদর্শন করে। এই একটি চিন্তাই মাকে আশ্বস্ত করে তখন। এক বুক ভয়, অপরিমেয় আতঙ্ক আর অদ্ভূত ভীতিকর অনুভূতিগুলোকেও মধুর করে নেন মা। প্রশান্ত চিত্তেই সয়ে যান সন্তান জন্ম দেয়ার অবর্ণনীয় কষ্ট। মায়ের এমন অব্যক্ত হাজারও ব্যাথা বেদনার পরেই তার কোলজুড়ে উকি দেয় নতুন চাদ। নতুন সন্তান জায়গা করে নেয় তার কোলে। সন্তানের মুখ দেখে তিনি ভুলে যান সীমাহীন দুঃখ, কষ্ট এবং জীবন সংহারি সকল যাতনা।
বাবার অবদান অনস্বীকার্য এবং অপরিমেয়ঃ
পক্ষান্তরে আবার বাবা? জ্বি, বাবাও তো এমনই একজন যার তুলনা শুধু তিনিই। বাবাও তো এই মা এবং সন্তানের ভরনপোষন থেকে শুরু করে যাবতীয় দায়দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নেন অবলীলায়। আদর স্নেহের চরম পরাকাষ্ঠায় ডুবে পরম হৃদ্যতা আর আন্তরিকতায় বুকে জড়িয়ে নেন আপন সন্তানকে। কোলে পিঠে করে মানুষ করে তোলেন তাকে। নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আরাম আয়েশ আর স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিয়ে সন্তানের কল্যান চিন্তায় বিভোর হন বাবা। নিজের এত দিনের অভ্যাসগত চেনা জগত তার পাল্টে যেতে থাকে ক্রমশঃ। আপন বিলাসিতাকে ভুলে গিয়ে তখন দৃষ্টি কেবল তার সন্তানের সুখচিন্তার দিকে। মা যেমন সন্তান গর্ভে ধারণ করে বয়ে বেড়ান কলিজার টুকরোকে আপন শরীরে; বাবাও সন্তানের আরেক ধারকই বটে। গভীর রাতে ঘুমের ঘোরে সন্তান যখন সামান্য কেদে ওঠে, মা তখন জেগে ওঠেন, কিন্তু বাবার চোখের ঘুমও তখন কিছুক্ষণের জন্য সরে যায় দূরে; জেগে ওঠেন পাশে থাকা তিনিও। তিনিও নিজের অজান্তেই মন ও মননে, অন্তরের মনিকোঠাকে নির্দিষ্ট করে দেন আপন সন্তানের ঠিকানা হিসেবে। বাবার সাথে, বাবার হাতে না খেলে সন্তানের তৃপ্তি মেটে না, অধিক সংখ্যক সন্তান তো এমনই। সন্তানের আবেগ অনুভূতি, দাবি আবদার, বায়না পূরণ তো বাবাদেরই করতে হয়। সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তার পেছনে অর্থ ব্যয় অধিকাংশ পরিবারে কে করেন? কতটি পরিবারের কতজন মা চাকরি বাকরি করেন? ক'জন মা নিজে উপার্জন করেন? নিঃসন্দেহে এই সংখ্যাটা নগন্য। যা হোক, নগন্য না হয়ে যদি অধিকাংশ মা নিজ হাতে উপার্জন করেও থাকেন, তাতেও কি বাবাদের দায়িত্ব কমে যাবে? মা যদি উপার্জনক্ষম হয়েও থাকেন, তাহলেই বাবারা কি সন্তানের প্রতি, পরিবার-পরিজনের প্রতি নিজেদের দায়িত্ব পালন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন? এমনটা তো সচরাচর দেখা যায় না। কোন বাবারই এমন হওয়া উচিত নয়। বরং প্রত্যেক বাবারই এইসব দায়দায়িত্ব পালনে সচেতন হওয়াই মানবতার দাবি। বাবারা হয়েও থাকেন এমন। বাবাদেরই এইসব গুরুদায়িত্ব পালন করে যেতে হয়। বাবারাই তো করেন। বাবাদের দান-অবদানও সন্তানের প্রতি সীমাহীন। বাবার স্নেহ মমতাও মায়ের মতই মাপ-পরিমাপের উর্ধ্বে। বাবাও সন্তানকে ভালোবাসেন নিঃস্বার্থভাবে। বাবারাও তো সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর জন্যই নিজেদের জীবনের দিকে তাকান না। সন্তানের মুখে নিজের খাবার তুলে দিয়ে প্রশান্তির অন্যরকম পরশ অনুভব করেন হৃদয়ে।
অধিকারকে এড়িয়ে গিয়ে অন্ধ আনুগত্য কাম্য নয়ঃ
মা এবং বাবা দু'জনেরই সন্তানের প্রতি অকৃত্রিম যে ভালোবাসা তা মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন প্রদত্ত। এই ভালোবাসাকে খন্ডিত করার সুযোগ নেই। এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পরিমাপেরও উপায় নেই। মা যেমন সন্তানের জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ করতে কার্পণ্য করেন না, প্রত্যেক বাবাও তেমনই। এই কারণে মা এবং বাবা দু'জনেরই অবদান অপরিসীম, অগনন এবং অকল্পনীয়। দু'জনের একজনকে যখন খাটো করা হয়, একজনের অবদানকে যখন তুচ্ছ করা হয়, একজনের অবদানকে যখন অস্বীকার করার প্রবনতা পরিদৃশ্যমান হয় তখন সেটাকে অবিচার না বলে উপায় থাকে না। কোন দেশের আইন কানূন, নিয়ম নীতি এবং প্রথা ও পদ্ধতি যদি এমন প্রবনতার প্রতি আত্মসমর্পন করে তাহলে সে দেশের আইন এবং বিচার ব্যবস্থাকেও প্রশ্নের উর্ধ্বে মনে করার কোন কারণ নেই। সেটা হোক জাপানের মত উন্নত দেশ কিংবা ইউরোপ আমেরিকার আরও অগ্রসর কোন দেশ জনপদ কিংবা তৃতীয় বিশ্বের আমাদের মত হা-ভাতে মানুষদের বসবাসের অঞ্চল।
সন্তানের অভিভাবকত্বলাভে মা বাবার অচিন্ত্যনীয় লড়াই এবং সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যতঃ
ইমরান শরিফ জানেন, জাপানের পারিবারিক আদালত তার পক্ষে সন্তানের অভিভাবকত্ব প্রদানের রায় দিবে না। তিনি নিজের এবং সন্তানদের পাসপোর্ট ফেরত দিতে এরিকোকে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু এরিকো তা দেননি। এরিকো কেন দেননি, এই প্রশ্ন কি করা যাবে? যারা এরিকোর অন্ধভক্ত তারা হয়তো অন্যের পাসপোর্ট আটকে রাখার বিষয়টিকে এরিকোর অধিকার বলে ধরে নিতে পারেন। যা হোক, এক পর্যায়ে ইমরান শরিফ পাসপোর্ট উদ্ধারে আইনি প্রক্রিয়াও অনুসরণ করেছেন। কিন্তু কোন কিছুতে যখন কাজ হয়নি তখন নিতান্ত দায়ে পড়ে নতুন পাসপোর্ট বানানো ছাড়া তার গত্যন্তর ছিল না। তিনি সেটাই করেন এবং এভাবেই একপর্যায়ে বাংলাদেশে আসতে সক্ষম হন। এই সময়ের অবস্থাটা একটু চিন্তা করলে খুব সহজেই বুঝা যায়, কী ভয়ঙ্কর একটি পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে ইমরান শরিফকে। সেই সময়গুলোতে। একে একে অনেকগুলো হয়রানিমূলক মামলা তার নামে জাপানের আদালতে। অন্য দিকে পাসপোর্ট পর্যন্ত আটকে রাখা হয়েছে, যাতে তিনি দেশত্যাগ করে কোথাও যেতেও না পারেন। কী ভয়ানক কৌশল।
যা হোক, ইমরান শরিফ দুই মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে আসার কয়েক মাস পরে এরিকোও বাংলাদেশে আসেন। ইমরান শরিফের যেমন সন্তানের জন্য মন কাঁদে, অন্তর কাঁদে তারও। তিনি ছুটে এসেছেন সন্তানের মায়ায়। সাত বছরের ছোট মেয়েকে জাপানে রেখেই চলে আসেন এরিকো। বাংলাদেশে থাকেন মাসের পর মাস। কথা হচ্ছে, মেয়েদের জন্য, সন্তানের জন্য যার অন্তরে এত দরদ, এত মায়া, এত ভালোবাসা, এত স্নেহ, এত হৃদ্যতা, এত সন্তান বাৎসল্য যাকে জাপান থেকে সুদূর বাংলাদেশে নিয়ে এল; মাত্র সাত বছরের সন্তানটিকে মাসের পর মাস দূরে রেখে, বুক থেকে সরিয়ে রেখে, কোল থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে রেখে তিনি মাতৃমমতার নতুন দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করলেন কি না, কিছু লোক বুঝতে পারলেও আমাদের মত লোকদের জন্য বুঝা কঠিন বৈকি।
যা হোক, জাপানের হোন আর যে দেশেরই হোন, এরিকো একজন মা। একজন মা হিসেবে তার প্রতি অনেকের মত আমাদের সহমর্মিতা। কিন্তু তার এই লড়াই এবং দুর্বিসহ পরিস্থিতির জন্য প্রথমত দায়ী সন্তানের অভিভাবকত্ব প্রশ্নে জাপানের পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নিয়ম নীতি। সবকিছু দেখে শুনে ইমরান শরিফকে মনে হয়, তিনি অনেকটাই পরিস্থিতির শিকার। ইমরান শরিফের বড় এবং প্রথম ভ্রম, জাপানের আইনকানূন সম্পর্কে অবিহত না হয়ে সেখানে বিয়ে করা। এ পর্যন্ত তার ভাগ্য প্রসন্ন বলতে হবে এই কারণে যে, তাকে সেখানে শেষমেষ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর হেফাজতে যেতে হয়নি। কপাল খারাপ হলে এমনটা হওয়াও সেখানে বিদেশীদের জন্য বলা চলে ডালভাত। জাপান কাউকে পাত্তা দিয়ে চলার দেশ নিশ্চয়ই নয়।
সর্বোপরি কথা হচ্ছে, ইমরান এরিকো বিবাদের ফলে তিন তিনটি শিশুর ভবিষ্যত পড়েছে গভীর উদ্বেগে। যখন তাদের বয়সী শিশুরা বেড়ে উঠছে বাবা মায়ের যৌথ আদর স্নেহে, সেই বয়সে তাদের দেখতে হচ্ছে বাবা মায়ের আইন আদালতে লড়াই করে যাওয়ার এমনসব অনাকাঙ্খিত এবং নেতিবাচক ঘটন অঘটন। এসব ঘটনার ঘনঘটা ছোট ছোট এই বাচ্চাগুলোর অন্তরে যে কতটা দাগ কেটেছে, তাদেরকে কতখানি বিপর্যস্ত করেছে, তা ভাষায় ব্যক্ত করাও রীতিমত কঠিন। কোন মেয়ে কার পক্ষে যাবে, এই এক দুশ্চিন্তা সর্বক্ষণ তাদেরকে কাবু করে রেখেছে। তাদেরকে দেখা গেছে সবসময় তারা ছিল সঙ্কুচিত। নিজেদের গুটিয়ে রাখতে পারলেই যেন তারা ভালো থাকে। তারা কে কার সাথে থাকবে- এতকিছু চিন্তা করার, এত বড় বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার, সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এবং বয়সই তো তাদের হয়নি। তো তাদেরকে কেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে বলা হচ্ছে? কেন তাদেরকে এমন বিপজ্জনক অবস্থায় নিপতিত করা হচ্ছে? তারা বুঝতে পারছে না, বাবার পক্ষে থাকবে, না কি মায়ের পক্ষে কথা বলবে। তারা বুঝতে পারছে না, কার কাছে থাকলে তাদের কল্যান হবে। তারা সিদ্ধান্তহীনতায়, হীনমন্যতায় ভুগতে ভুগতে দ্বিধান্বিত, ভীত এবং আতঙ্কিত। এই আতঙ্ক এবং দ্বিধার ভেতরেই বড় মেয়ে মায়ের সাথে এবং মেঝ মেয়ে বাবার সাথে থাকবে বলে নিজেদের অভিমত জানায়।
আমাদের মতে, সন্তানদের এই অভিমতও কর্তপক্ষের দীর্ঘ মেয়াদের জন্য গ্রহণ করা উচিত নয়। বরং বিজ্ঞ আদালতের উচিত এই মেয়েদের কল্যানে এমন একটি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, যার ফলে বাবা এবং মা দু'জনই সন্তানের দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হন, সন্তানদের অভিভাবকত্ব প্রশ্নে উভয়ের অধিকারই বহাল থাকে। পিতা বা মাতা কাউকেই যেন বঞ্চিত করা না হয়, সন্তানদের জীবন থেকে একেবারে মুছে দেয়া না হয়।
বাবা মা দু'জনই থাকার পরেও এই আতঙ্ক, এই টানাপোড়েন বাচ্চাগুলোকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। এই বাচ্চারা বেড়েও উঠবে হয়তো এই নিঃস্বতাকে সঙ্গী করেই। এরিকো-ইমরান, তোমাদের অতি লোভ, নির্বুদ্ধিতা আর খামখেয়ালিপনার জন্যই বাচ্চাগুলোর আজকের এই অনিশ্চিত যাত্রা। তোমাদের জন্য শুভকামনা।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ সকাল ১০:০৩