মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক (১৮৮১-১৯৩৮) তুরস্কের ইতিহাসে এক প্রভাবশালী ও বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। তিনি তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং আধুনিক তুরস্কের স্থপতি হিসেবে পরিচিত। তবে তার নীতি ও কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। কেউ তাকে আধুনিকায়নের পথিকৃৎ হিসেবে দেখেন, আবার কেউ তাকে ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন ও তুর্কি স্বকীয়তা ধ্বংসকারী স্বৈরশাসক হিসেবে বিবেচনা করেন।
আতাতুর্কের পরিচয় ও তার আদর্শ
কামাল আতাতুর্কের জন্ম এক সামরিক পরিবারে হলেও, তার পরিচয় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিছু সূত্র তাকে স্পেন থেকে বিতাড়িত ইহুদি বংশোদ্ভূত সাবাতাই সম্প্রদায়ের বলে দাবি করে। তার মা ছিলেন আলবেনীয় বংশোদ্ভূত। জাতিগতভাবে তিনি পুরোপুরি তুর্কি নন, তথাপি তিনি নিজেকে তুর্কি জাতির পিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
তিনি ছিলেন একজন ফ্রী-মেসন এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি, যিনি অটোমান খিলাফত ধ্বংসে বড় ভূমিকা রাখেন। ইসলামী চিন্তাবিদ নাসিরুদ্দীন আলবানী তাকে ইসলাম ত্যাগকারী বা মুরতাদ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
তুরস্কে ইসলামের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি
কামাল আতাতুর্কের শাসনামলে তুরস্কের হাজার বছরের ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও তাহযীব-তামাদ্দুন ধ্বংস করা হয়। তার অপশাসনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:
মসজিদ ও মাদ্রাসা বন্ধ ও ধ্বংস করা।
কুরআন পাঠ, শিক্ষা ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ করা।
আরবি লিপির পরিবর্তে ল্যাটিন লিপি প্রবর্তন।
ইসলামি পোশাক, বিশেষ করে হিজাব ও দাড়ি নিষিদ্ধ করা।
হাজার হাজার আলেমকে হত্যা, গুম ও কারাবন্দি করা।
আজানকে তুর্কি ভাষায় পরিবর্তন করা এবং ইসলামি রীতিনীতি কঠোরভাবে দমন করা।
তার এই পদক্ষেপের ফলে তুরস্কের হাজার বছরের ইসলামী ঐতিহ্য বিপর্যস্ত হয় এবং বহু ধর্মপ্রাণ মুসলিম দেশত্যাগে বাধ্য হন। কারাগারগুলো দ্বীনদার মুসলিমদের জন্য এক ভয়াবহ নির্যাতনকেন্দ্রে পরিণত হয়।
এমনকি, মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের সভাপতিত্বে তুর্কি সরকার ১৯৩৪ সালে তুরষ্কের বিখ্যাত হাজিয়া সোফিয়া বা আয়া সোফিয়া মসজিদকে ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেয়, যেটি ১৪৫৩ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্তু মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছিল। কিন্তু কামাল পাশার হাতে অপহৃত আয়া সোফিয়া মসজিদকে অবশেষে পুনরুদ্ধার করেন তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়িপ এরদোগান। ২০২০ সালে তিনি এটিকে আবারও মসজিদ হিসেবে ঘোষণা করেন।
আধুনিকায়নের নামে ধর্মহীনতা প্রতিষ্ঠা
কামাল আতাতুর্ক নিজেকে আধুনিকতার প্রবক্তা হিসেবে তুলে ধরলেও তার নীতি ছিল পশ্চিমা সভ্যতা অনুকরণের মাধ্যমে তুরস্ককে সম্পূর্ণরূপে ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন করা। তার শাসনামলে:
শরীয়াহ আইন বাতিল করে পাশ্চাত্য আইন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।
ইসলামী পোশাকের পরিবর্তে পাশ্চাত্য পোশাক বাধ্যতামূলক করা হয়।
ধর্মীয় শিক্ষাকে নিষিদ্ধ করে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়।
তুর্কি ভাষায় আজান বাধ্যতামূলক করা হয়, যা পরবর্তীতে ইসলামী আন্দোলনের মাধ্যমে বাতিল করা হয়।
আতাতুর্কের পরিণতি ও ইসলামের পুনরুত্থান
ইতিহাস সাক্ষী, আতাতুর্ক চেয়েছিলেন ইসলামের চিহ্ন তুরস্ক থেকে মুছে ফেলতে, কিন্তু তিনি সফল হতে পারেননি। সময়ের পরিক্রমায় তুরস্কে ইসলামের পুনর্জাগরণ ঘটে। আজ তুরস্কে পুনরায় মসজিদগুলোতে আজান ধ্বনিত হচ্ছে, কুরআনের শিক্ষা চালু হয়েছে এবং ইসলামী চেতনা নতুন করে প্রসারিত হচ্ছে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন:
"তারা (কাফের-মুশরিকরা) চায় তাদের মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে, কিন্তু আল্লাহ তাঁর আলোকে সম্পূর্ণ করবেন, যদিও তারা তা অপছন্দ করে।" (সূরা আস-সাফ)
এককথায় বলতে গেলে, আধুনিক তুরস্কের জনক বলে পরিচিত, কামাল পাশা গোটা বিস্তীর্ন তুর্কী ভূখন্ডকে একটি বৃহত কারাগারে পরিনত করেছিলেন। জুলূম, অত্যাচার, অবিচার আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের এমন ঘোর কৃষ্ণ অমা রাত তুরস্কের আকাশ আগে কল্পনা করেনি! আর গোয়েবলসের এমন নজিরবিহীন তান্ডব তুরস্কের মাটি ইতিপূর্বে কখনও প্রত্যক্ষ করেনি!
কামাল পাশা! হায়রে কামাল পাশা!! এই কামাল পাশা সেই জালিম অত্যাচারী ব্যক্তিটির নাম, যিনি তুরস্কের মাটি থেকে মহান আল্লাহর নামের উচ্চকিত আওয়াজকে চির দিনের জন্য মিটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন! আযানের মহিমাময় শব্দগুলোও তিনি সহ্য করেননি! এশিয়া ইউরোপ আর আফ্রিকা মহাদেশের মিলনস্থলে গর্ব আর গৌরবের মিনার মহান তুরস্ক সাম্রাজ্যের আকাশ বাতাস মুখরিত করে দিত যে আজান, তিনি তা বন্ধ করে দেন! একদা ইথারে ভেসে ভেসে যে আজানের মধুর সুরলহরী ছড়িয়ে পরতো তুরস্কের গোটা প্রান্তরে প্রান্তরে, তিনি তা স্তব্দ করে দেন। ইতিহাস বড়ই নির্মম, তুরষ্কে পাশা আজ বেঁচে নেই। কিন্তু, আবার আজানের সুমধুর ধ্বনি ফিরে এসেছে তুরস্কের আকাশে বাতাসে। পাষন্ড পাশার পাশা খেলার অবসান হয়েছে। আবার তুরস্কে ফিরে এসেছে ঐশি বানী আল কুরআন। কুরআনের তা'লীম তাআ'ল্লুমে মুখরিত আজ তুরষ্কের নগর প্রান্তর। সেখানে তৈরি হচ্ছে হাজারও হাফেজে কুরআন। তৈরি হচ্ছে কুরআনের হাজারো লাখো খাদেম। আলহামদুলিল্লাহ।
উপসংহার
আজ মুসলিম উম্মাহ বিশ্বজুড়ে অপমানিত, নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত। এর মূল কারণ আমাদের দ্বীন থেকে দূরে সরে যাওয়া। আমরা যদি কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে আসি, তাহলে আমাদের বিজয় নিশ্চিত। ইতিহাস সাক্ষী, যে জাতি কুরআনের আদর্শ গ্রহণ করেছে, তারা বিশ্ব নেতৃত্বে এসেছে। আর যে জাতি তা ছেড়ে দিয়েছে, তারা পতনের শিকার হয়েছে।
আল্লাহ আমাদের সঠিক পথের দিশা দিন এবং ইসলামের আলোতে আমাদের জীবন পরিচালিত করার তৌফিক দিন। আমীন।
তথ্যসূত্র
১. Mango, Andrew. Atatürk: The Biography of the Founder of Modern Turkey. Overlook Press, 1999.
২. Zürcher, Erik J. Turkey: A Modern History. I.B. Tauris, 2004.
৩. Kinzer, Stephen. Crescent and Star: Turkey Between Two Worlds. Farrar, Straus and Giroux, 2001.
৪. Ahmad, Feroz. The Making of Modern Turkey. Routledge, 1993.
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১২:৪২