হে মক্কাতুল মোকাররমা, হে পবিত্র নগরী, তুমি সেই তীর্থভূমি, যেখানে বাইতুল্লাহর স্নিগ্ধ সৌন্দর্য হৃদয়কে বিমুগ্ধ করে। হে সু-কুল্লাইল, রাতের নগরী, তোমার প্রতিটি ধূলিকণা আল্লাহর তাওহীদের সুরে গান গায়, প্রতিটি পাথর ফিসফিস করে ইবরাহিম আঃ-এর ত্যাগের অমর কাহিনী। তোমার আকাশ, পাহাড়, মাটি—সবই যেন হৃদয়ের গভীর থেকে ডেকে নিয়ে যায় প্রিয়তম রাসূল সাঃ-এর স্মৃতির কাছে, ইসমাঈল আঃ-এর সমর্পণের পথে, আর সাহাবায়ে কেরামের ভালোবাসার পদচিহ্নে। হে মক্কা, তুমি শুধু শহর নও—তুমি রূহের আশ্রয়, ঈমানের আলোকবর্তিকা, আল্লাহর ঘরের চিরন্তন ঠিকানা।
হজের এই মোবারক মৌসুমে, যখন হাজিরা বাইতুল্লাহর চারপাশে তাওয়াফে মগ্ন, তাদের প্রতিটি ঘূর্ণনে দুনিয়ার সব বাঁধন ছিঁড়ে আল্লাহর দিকে ধাবিত হয়। আমার হৃদয়ও যেন ছুটে চলে সেই পবিত্র কাফেলার সাথে, যেন আমি মিশে যাই তীর্থযাত্রীদের অশ্রুসিক্ত ভিড়ে। প্রতিটি পদক্ষেপে আমার আত্মা কেঁপে ওঠে, যেন বাইতুল্লাহর ছায়ায় আমি আল্লাহর নৈকট্যের স্বাদ পাই। হে মক্কা, তোমার পথ আমাকে ডাকে, আমার হৃদয়কে টেনে নিয়ে যায় সেই পবিত্র ঘরের দিকে, যেখানে ত্যাগ, ভালোবাসা আর ঈমান একাকার হয়ে মিশে আছে।
এই মক্কার মাটি, যেখানে ইবরাহিম আঃ তাঁর পবিত্র হাতে ইসমাঈল আঃ কে সাথে নিয়ে গড়েছিলেন কা’বা শরীফ—সেই ঘর, যার দিকে কোটি মুসলিম প্রতিদিন সিজদায় অবনত হয়। মাকামে ইবরাহিমে দাঁড়ালে হাজিরা অশ্রুসজল নয়নে তাকায়, যেন ইবরাহিম আঃ-এর দোয়া—“রব্বানা তাকাব্বাল মিন্না”, "হে আল্লাহ আমাদেরকে কবুল করুন"—তাদের হৃদয়ে বেজে ওঠে। সেই পাথর, যেখানে ইবরাহিম আঃ দাঁড়িয়েছিলেন, আজও হৃদয়ে ত্যাগের স্মৃতি জাগায়, চোখে অশ্রু এনে দেয়। সাফা-মারওয়ার পথে হাজেরা আঃ-এর অশ্রুসিক্ত কাহিনী জীবন্ত হয়ে ওঠে। এক মায়ের আর্তনাদ, সন্তানের জন্য ছুটে চলা, সেই ত্যাগ জমজমের ধারায় চিরন্তন। প্রতিটি হাজি যখন সাফা থেকে মারওয়ার দিকে ছুটে, তাদের ছুটে চলায় বেজে ওঠে হাজেরার তাওয়াক্কুল আর ভালোবাসার ধ্বনি। জমজমের এক ফোঁটা পানি হৃদয়ে ঈমানের স্রোত বইয়ে দেয়, যেন মায়ের পবিত্রতা আমাদের স্পর্শ করে।
হে মক্কা, তোমার আকাশে ভেসে বেড়ায় রাসূল সাঃ-এর পবিত্র নিঃশ্বাস। এই নগরীতে তিনি জন্মেছিলেন, এই পথে হেঁটেছিলেন, জাবালে আবু কুবাইসের পাদদেশে দাঁড়িয়ে তাওহীদের ডাক দিয়েছিলেন। হেরার গুহায়, নির্জনতার নিস্তব্ধতায়, জিবরাঈল আঃ-এর কণ্ঠে “ইকরা” শব্দে কুরআনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই নীরবতা আজও হৃদয়ে ঝঙ্কার তোলে। মিনার ধূলিময় মাটি, আরাফাতের বিশাল ময়দান, মুজদালিফার তারার নিচে—প্রতিটি স্থানে রাসূল সাঃ-এর স্মৃতি জীবন্ত। আরাফাতে তিনি দিয়েছিলেন বিদায় হজের ভাষণ, মানুষের সমতা আর ঈমানের বাণী ধ্বনিত হয়েছিল। মুজদালিফায় কাঁকর সংগ্রহে হাজিরা যেন হৃদয়ের শক্তি সঞ্চয় করে। জমরাতে শয়তানের বিরুদ্ধে কাঁকর নিক্ষেপে তারা তাদের পাপ ও দুর্বলতা দূরে ঠেলে দেয়।
হে মক্কা, তোমার তাওয়াফে হাজিরা হারিয়ে যায়। বাইতুল্লাহর চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে তাদের হৃদয় দুনিয়ার মায়া ছেড়ে আল্লাহর দিকে ধাবিত হয়। প্রতিটি পদক্ষেপে তারা ইবরাহিম আঃ-এর ত্যাগ, হাজেরার ভালোবাসা, রাসূল সাঃ-এর সুন্নাহর ছোঁয়া পায়। বিলাল রাঃ-এর আজান, উমর রাঃ-এর সাহস, আলী রাঃ-এর ঈমান—এই সবই মক্কার প্রতিটি কোণে মিশে আছে। সু-কুল্লাইলের নিস্তব্ধ রাতে হাজিরা দোয়ায় হাত তুলে, তাদের অশ্রু জমজমের মতো পবিত্র হয়ে আল্লাহর দরবারে পৌঁছে। হে মক্কা, তুমি চিরন্তন তীর্থ, যেখানে ইবরাহিম আঃ-এর তাওহীদ, হাজেরার ত্যাগ, রাসূল সাঃ-এর নূর আর সাহাবাদের ঈমান এক হয়ে গেছে।
হে মদিনা মুনাওয়ারাহ, হে আলোর নগরী, তুমি সেই শান্তির স্পর্শ, যেখানে হৃদয় বিগলিত হয়। তুমি রূহের আশ্রয়, প্রিয়তম রাসূল সাঃ-এর ভালোবাসার চিরন্তন ঠিকানা। তোমার ধূলিকণায় তাঁর পদচিহ্ন, বাতাসে তাঁর দয়ার সুগন্ধ, পাথরে তাঁর ত্যাগের কথা। হে মদিনা, তুমি হৃদয়ের তীর্থ, যেখানে অশ্রু ভালোবাসায় ফোটে, নিঃশ্বাসে আল্লাহর নৈকট্য মেলে।
তোমার আকাশে নূরের ঝলকানি, যেন রাসূল সাঃ-এর করুণাময় হাসির ছায়া। এই নগরীতে তিনি মক্কার নিপীড়ন ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, আনসারদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন। তোমার মাটিতে তিনি গড়েছিলেন মসজিদে নববী, যার প্রতিটি পাথর তাঁর সুন্নাহর সাক্ষী। মিনার থেকে ভেসে আসে আজান, যেন বিলাল রাঃ-এর কণ্ঠে “হাইয়া ‘আলা-সস-সালাহ” হৃদয় কাঁপায়। এই ডাকে চোখ অশ্রুসজল হয়, যেন রাসূল সাঃ-এর দোয়ার ছায়ায় নত হচ্ছি।
হে মদিনা, তোমার বুকে রওজা মোবারক—প্রিয় নবীর পবিত্র কবর। সেখানে দাঁড়ালে হৃদয় থমকে যায়, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়, চোখ ভিজে ওঠে। “আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ”—এই কথায় দুনিয়ার সব চাওয়া তুচ্ছ হয়, শুধু থাকে তাঁর উম্মত হিসেবে কবুল হওয়ার কামনা। সবুজ গম্বুজের দিকে তাকালে মনে হয়, তিনি আমাদের দেখছেন, আমাদের জন্য দোয়া করছেন। মসজিদে নববীর শীতল চত্বরে তিনি সাহাবাদের শিক্ষা দিয়েছেন, দোয়া করেছেন, তাঁর চোখের পানি এই মাটিতে পড়েছে। সেই মাটিতে পা রাখলে হৃদয় বলে, “হে রাসূল, তোমার প্রেমে আমি পাগল হয়ে যাব।”
তোমার বাকি গোরস্থানে শুয়ে আছেন ওমর রাঃ-এর সাহস, ওসমান রাঃ-এর কোমলতা, আয়েশা রাঃ-এর জ্ঞান, ফাতিমা রাঃ-এর পবিত্রতা। এই কবরগুলো যেন বলে, “চলো রাসূল সাঃ-এর পথে।” ওহুদের পাহাড়, যেখানে হামজা রাঃ রক্ত দিয়ে ঈমানের পতাকা উড়িয়েছিলেন, রাসূল সাঃ যাকে ভালোবেসেছিলেন। সেই পাহাড়ের ছায়ায় শহীদদের ত্যাগ হৃদয়ে কাঁপন ধরায়।
হে মদিনা, তোমার পথ ভালোবাসার নদী। এই পথে রাসূল সাঃ হেঁটেছেন, তাঁর হাসি লেগে আছে পাথরে। এই পথে হাঁটলে মনে হয়, তিনি পাশে, বলছেন, “ভয় পেও না, আমি তোমার জন্য দোয়া করছি।” তোমার বাতাসে তাঁর সুন্নাহর সুগন্ধ, হৃদয় বলে, “হে মদিনা, তুমি আমার রূহের আশ্রয়।”
হে মক্কা, হে মদিনা, তোমরা হৃদয়ের পবিত্রতম ঠিকানা। মক্কায় তাওয়াফে ডুবে, মদিনায় রওজার সামনে দাঁড়িয়ে, আমার হৃদয় কাঁদে। আমি যেন ছুটে চলি তোমাদের পথে, বাইতুল্লাহর আঙিনায়, রাসূল সাঃ-এর দরবারে। আমার রূহ তোমাদের বাতাসে মিশে যায়, চোখ অশ্রুসজল হয় তোমাদের প্রেমে। হে আল্লাহ, আমাকে মক্কার তাওয়াফে, মদিনার রওজার ছায়ায় কবুল করো। আমার মৃত্যু দাও রাসূল সাঃ-এর ভালোবাসায়। হে মক্কা, হে মদিনা, তোমরা চিরন্তন তীর্থ, যেখানে প্রতিটি তীর্থযাত্রীর হৃদয় গলে, চোখ ভিজে ওঠে তোমাদের পবিত্র প্রেমে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০২৫ বিকাল ৪:২৯