বয়সজনিত কারণে অন্ধদের চোখে আলো ফেরাবে বিজ্ঞানের যুগান্তকারী নতুন আবিষ্কার
বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে যখন চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, জীবন যেন ধীরে ধীরে অন্ধকারে ডুবে যায়। ছোট ছোট অক্ষর, প্রিয় মুখ, রাস্তার বাঁক-সবকিছু যেন হারিয়ে যায় কুয়াশার ভেতরে। একটা সময় দেখার পুরো ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলে চোখ। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫০ লাখ বয়োবৃদ্ধ মানুষ এই যন্ত্রণার শিকার, যাদের চোখে ধরা পড়েছে ড্রাই এএমডি বা জিওগ্রাফিক অ্যাট্রোফি। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণায় এমন একটি ক্ষুদ্র চিপ আবিষ্কার হয়েছে যেটি দৃষ্টিহীন চোখে আবার ফিরিয়ে আনছে আলো।
‘প্রিমা বিসি আই রেটিনাল ইমপ্ল্যান্ট’ নামের এই চিপটি এতটাই ক্ষুদ্র যে চুলের চেয়েও পাতলা। এটি চোখের রেটিনার নিচে বসানো হয়, তার ছাড়াই, সূর্যের আলো থেকে শক্তি নিয়ে কাজ করে। রোগী একটি বিশেষ চশমা পরেন, যার মধ্যে লুকিয়ে থাকে একটি ক্যামেরা আর পকেটে বহন করা যায় এমন একটি ছোট প্রসেসর। এই ক্যামেরা চারপাশের দৃশ্য ধরে, ইনফ্রারেড আলোর মাধ্যমে চিপে পাঠায়। তারপর চিপ সেই দৃশ্যকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তর করে মস্তিষ্কের কাছে পৌঁছে দেয়। আর তখনই ঘটে অবাক করা বিষয়, যিনি অন্ধকারে ডুবে ছিলেন, তিনি আবার দেখতে শুরু করেন। অক্ষর, শব্দ, জীবনের ছোট ছোট সৌন্দর্য, সবই ফিরে আসে তাঁর চোখে।
ইউরোপের পাঁচটি দেশের ১৭টি কেন্দ্রে ৩৮ জন রোগীর ওপর পরীক্ষায় এই চিপের অসাধারণ ক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছে। ৮৪ শতাংশ রোগী চিপ বসানোর পর অক্ষর আর সংখ্যা চিনতে পেরেছেন। ৩২ জনের চোখে চিপ স্থাপন করা হয়েছে, আর ২৭ জন পড়তে শুরু করেছেন। এক বছর পর তারা দৃষ্টি-পরীক্ষার চার্টে ২৫টি অক্ষর বা পাঁচটি লাইন পড়তে পেরেছেন, যা এই রোগের কাছে একদিন অসম্ভব মনে হতো।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ইউসিএল) এবং মুরফিল্ডস আই হাসপাতালের বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা, ক্যালিফোর্নিয়ার সায়েন্স কর্পোরেশনের সহযোগিতায়, এই বিপ্লব এনেছে। জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্র্যাঙ্ক হোলৎস এই গবেষণার পথপ্রদর্শক। ইউসিএলের অধ্যাপক মাহি মুকিতের কথায় আশার আলো: “এই চিপ শুধু দৃষ্টি ফেরায়নি, মানুষের জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে। তারা এখন প্রিয়জনের মুখ দেখতে পারছেন, বই পড়তে পারছেন, নিজের পায়ে হাঁটতে পারছেন।”
এই গল্পের সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্ত শিলা আরভিনের। ৬৮ বছর বয়সী এই নারী, মুরফিল্ডস হাসপাতালে চিপ বসানোর পর, প্রথমবার অক্ষর দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। “আমার জীবন ফিরে এসেছে,” বলেন তিনি, চোখে জল আর হৃদয়ে আনন্দ নিয়ে। এখন তিনি ক্রসওয়ার্ড পড়ে সময় কাটান, একটি সাধারণ মুহূর্ত, যা তার কাছে একদিন স্বপ্নের মতো ছিল। দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ প্রকাশিত এই গবেষণা কেবল এএমডি রোগীদের জন্য নয়, অন্যান্য দৃষ্টিহীনতায় ভোগা মানুষের জন্যও নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে।
এই ক্ষুদ্র চিপটি কেবল একটি যন্ত্র নয়, এ হলো হৃদয়ের ধুকপুকানি, আশার স্পন্দন। যারা অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের হাত ধরে এটি আলোর পথ দেখাচ্ছে। যখন বিজ্ঞান চোখে দৃষ্টি ফেরায়, তখন তা শুধু দৃশ্য নয়, জীবনের হারানো রঙ ফিরিয়ে আনে। এই চিপ হলো মানুষের অদম্য চেতনার প্রতীক, যা অন্ধকারকে জয় করে আলোর গান গায়। তবে বিজ্ঞানের অসাধারণ এই আবিষ্কারের সুফল আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের মানুষ ঠিক কবে নাগাদ পেতে পারেন সেটা এখনো নিশ্চিত করে বলার সময় এখনো আসেনি।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


