ফেসবুকে অনেকে অনেক লিংক পাঠায়।কোনোটা পড়ে আনন্দ মিলে, কোনোটা পড়লে মেজাজ গরম হয়ে যায়।একদিন একটা লিংক পেলাম।বিষয়ঃপর্দা: নারীর দুর্গ ও রক্ষাকারী ঢাল
ধর্মীয় বিধিবিধান নিয়ে যুক্তি-টুক্তি দিয়ে কোনো লাভ নাই জানি।কিন্তু সিদ্ধান্তে যাওয়ার জন্য যে গাঠনিক যুক্তি দেখি এ ধরণের লেখায় কেমন যেনো বিবমিষার উদ্রেক করে।সেই বিবমিষা থেকেই ওই লেখা নিয়ে এই সমালোচনাটা লিখলামঃ
লেখক(সায়ীদ) লিখেছেন, “বেপর্দা আর নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশা সমাজে কেমন বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে এবং নারীকে কীভাবে ভোগ্য-পণ্যের বস্তুতে পরিণত করেছে তা আমরা আমাদের চারদিকে লক্ষ্য করলেই দেখতে পাই”।
সমস্যা হচ্ছে,পর্দা আছে আর নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশা নেই কিন্তু প্রবল পুরুষতান্ত্রিক এমন যেকোনো সমাজেও নারী শেষ পর্যন্ত অন এভারেজ ভোগ্যপণ্যই।
“পারিবারিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা, অশান্তি, দাম্পত্য-কলহ ও পারস্পরিক অবিশ্বাস, বিবাহ-বিচ্ছেদ, নারী-নির্যাতন ইত্যাদি সবকিছুর পেছনেই একটি প্রধান কারণ হলো পর্দাহীনতা এবং নর-নারীর অবাধ মেলা-মেশা”।সায়ীদ সাব কয় কী!
“একজন খ্রীষ্টান 'নান' বা ধর্মজাজিকা যখন লম্বা গাউন আর মাথা-ঢাকা পোশাক পড়ে থাকেন তখন তা আর পশ্চাৎপদতা, উন্নয়নের অন্তরায় বা নারীকে শৃঙ্খলিতকরণের প্রয়াস বলে বিবেচিত হয় না। বরং তা শ্রদ্ধা, ভক্তি বা মাতৃত্বের প্রতীক রূপেই বিবেচিত হয়।”
পর্দা সব মুসলিম নারীকে করতে বলা হয়।কিন্তু নান হয়ে লম্বা গাউন আর মাথা-ঢাকা পোশাক পড়ে কতজন খ্রীষ্টান নারী? সবাই নয় নিশ্চয়ই?তাহলে তুলনাটা কি জমলো?
“বর্তমান যুগে, বিশেষত পাশ্চাত্য-বিশ্বে নারীকে তাঁর নিজের ভাগ্যনিয়ন্তা রূপে আখ্যায়িত করা হয়। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সাথে তাল-মিলিয়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের তুলনায় অধিকতর যোগ্য বা efficient বলেও চিহ্নিত করা হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সত্যিই কি নারী লিঙ্গ-বৈষম্যকে অতিক্রম করে পুরুষের সমান মর্যাদা লাভ করতে পেরেছে? 'কলঙ্কময় অতীতের' নিগ্রহ ও দমন-নিপীড়ন থেকে রক্ষা পেয়েছে? তথাকথিত নারী-স্বাধীনতা কি নৈতিকতা সম্বৃদ্ধ শান্তিপূর্ণ একটি নতুন সমাজ-ব্যবস্থার ইঙ্গিত প্রদান করে? সত্যিই কি নারী প্রকৃত সামাজিক ন্যায়-বিচার লাভে সমর্থ হয়েছে? আমরা যদি বর্তমান পাশ্চাত্য-সমাজের দিকে তাকাই তাহলে এর উত্তর হবে : 'না'।” এতো বড়ো সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারার ক্ষমতা থাকা কৃতিত্বের কিন্তু ব্যাখ্যা লাগবো না? তা কই গেলো?
“অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারী তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হলেও পাশ্চাত্যের সমাজ-ব্যবস্থা আজ এক ভয়াবহ সঙ্কটের সম্মুখীন।নারী-নির্যাতন, শিশুহত্যা, পতিতাবৃত্তি, ধর্ষণ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, লিভিংটুগেদার, মাদকাসক্তি, কুমারী-মাতৃত্ব বা single mother, ইত্যাদি সমস্যা আজ পাশ্চাত্য-সমাজকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে”।
লিভিং টুগেদার আমাদের চোখে সমস্যা, পশ্চিম একে সমস্যা মনে করেনা।বিবাহ-বিচ্ছেদ সমস্যা নিয়ে তারা সচেতন এবং পদক্ষেপমুখর।কুমারী-মাতৃত্ব আবার কী জিনিস!এটা তো কয়েকজন মহাপুরুষ(যেমন যিশু)দের মা্যের বেলায় প্রযোজ্য।পশ্চিমে বিয়ে না করে সন্তান নেয়, কিন্তু কুমারী-মাতৃত্বের কথা শুনলে হাসবে!তবে সিঙ্গল মা/বাবা সমস্যা নিয়ে তারা চিন্তিত।কিন্তু পশ্চিম নিজেকে ভয়াবহ সঙ্কটের সম্মুখীন বলে মনে করে না।এটা সায়ীদ সাহেবের মত স্যাডিস্টিকদের আপ্লুত কল্পনা। আর নারী-নির্যাতন, শিশুহত্যা, পতিতাবৃত্তি, ধর্ষণ পশ্চিমে থাকলেও এগুলো বাংলাদেশ, পাকিস্থান,ভারতের মত দেশের সমস্যা।
“প্রচলিত সাধারণ ধারণায় বিংশ শতাব্দি, বিশেষ করে দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত সময়কে নারী স্বাধীনতার স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করা হলেও এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, এই সময়ে বিশ্বে নারী-নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা পঁচিশ ভাগ”
- সমীক্ষার রেফারেন্স না হয় নাই চাইলাম, কিন্তু নারী-নির্যাতন বৃদ্ধির দায় পশ্চিমের ঘারে(আগে পরের বাক্য দেখে এমনই মনে হচ্ছে) কিভাবে ফেলা সম্ভব?নারী-নির্যাতন পশ্চিমের না, বর্তমানে আমাদের কলংকতিলক।
“ধর্ষণের প্রকৃত সংখ্যা জানা সহজ নয়। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী এ-বিষয়ে রিপোর্ট করে না”-কথা সত্য।কিন্তু পশ্চিমের বেলায় যথেষ্ঠ মিথ্যা।বাংলাদেশ, পাকিস্থান,ভারতের মত ওখানে সমাজ ধর্ষণের দায় উলটো মেয়েদের ঘারে চাপানোর তালে থাকেনা।ফলে রিপোর্টিংয়ের ঝামেলা সেখানে কম এবং স্বামী/সঙ্গী কর্তৃক জোর পূর্বক সঙ্গমও ধর্ষণ হিসাবে দেখা হয়।এবার যদি আমাদের পাক-বাংলা-ভারতীয় সমাজের দিকে তাকাই তাহলে কেমন চিত্র পাই?সবচে ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে ভারত-পাকিস্থানের মতো মারাত্মক ধর্ষণপ্রবণ দেশ নিয়ে সায়ীদ সাব একটা শব্দও ব্যয় করেননি।
তৃতীয় বিশ্বের নানাদেশ(বাংলাদেশসহ) থেকে পুরুষের পাশাপাশি নারীকর্মী যায় মধ্যপ্রাচ্যে।অনেকেই সেখানে আরব বাবা-ছেলেদের কাছ থেকে ব্যাপক সম্মান ও আদর(!!) পায়।পত্রপত্রিকায় এমন খবর যথেষ্টই আসে।খোজ করলে আশেপাশে এমন ভুক্তভোগীদের দেখাও মিলে।এমন একজনের একটা সাক্ষাতকার নিছিলাম বছরখানেক আগে।অনেক অনুনয় বিনয় এবং পরিচয় গোপন রাখার আশ্বাসের পর যা শুনেছিলাম মনে হলে আজও চোখে জল আসে।
“গর্ভপাতঃ প্রকৃত সংখ্যা আরো ভয়াবহ।” ইউরোপ জাপান ইত্যাদি দেশে এটা বৈধীবং সামাজিকভাবে স্বীকৃত এবং কোনো প্রকারের লুকোচাপা অপ্রয়োজনীয়।ফলে প্রকৃত সংখ্যা ঘোষিত সংখ্যার কাছাকাছি এবং এখানে “আরো ভয়াবহ”ও সায়ীদ সাবের উর্বর কল্পনা।
“বর্বরযুগে' কন্যা-সন্তানদের হত্যা করা হতো অর্থনৈতিক কারণে।” এধরনের কারণের কথা এই প্রথম শুনলাম।(আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি।জাষ্ট ইন্টারেস্ট।বর্বরযুগে পাইকারী হারে শিশুকন্যা নিধনের অভিযোগ আছে।কিন্তু ইসলামের একেবারে শুরুর সময়ে এত ইহুদি পুরুষ, এদের এবং বিশেষত সর্দারদের এত এত স্ত্রী কই থাইক্যা আসলো।আমি আজ পর্যন্ত এর কোনো মীমাংসা করতে পারি নি।)
“The Sunday Times - এর এক রিপোর্টে দেখা যায় যে, নারীরা "নির্দ্ধারিত মাত্রার" চাইতে অধিক পরিমাণে মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে”- এ ধরণের ক্ষেত্রে লিংক দেয়া অনলাইনযুগে খুবই সম্ভব ও উচিত।"নির্দ্ধারিত মাত্রার"কথা পড়ে বিয়াপক বিনুদন পেলাম।
“একজন নারী, যিনি তাঁর পোশাক ও চলা-ফেরায় পর্দার নিয়মাবলী বা 'হিজাব' পালন করে থাকেন, তিনি সাধারণত অন্য পুরুষ দ্বারা অসম্মানিত ও লাঞ্ছিত হন না। এভাবে একজন মুসলিম নারী 'হিজাব' বা পর্দা-পালনের মাধ্যমে অনেক সমস্যা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেন, যা আজ পশ্চিমা জগতের নারীরা অহরহ মোকাবিলা করছেন”।“আমরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবো যে, পর্দা বা হিজাব পালনকারী একজন নারী অধিকতর নিরুদ্বেগ ও স্বাচ্ছন্দপূর্ণ জীবন যাপন করে থাকেন। এটা এই কারণে যে, আত্ম-মর্যাদাশীল নারী হওয়ার জন্য ইসলাম দৈহিক অবয়বের গুরুত্বকে কমিয়ে দিয়েছে”।এর সঙ্গে মিলালাম একই জনের দেয়া আরেকটা লিংকের একটা পয়েন্টঃ Myth: Women incite men to rape.
Fact: Research has found that the vast majority of rapes are planned. Rape is the responsibility of the rapist alone. Women, children and men of every age, physical type and demeanor are raped. Opportunity is the most important factor determining when a given rapist will rape
আলুর দোষগ্রস্ত পুরুষপুঙ্গবে ঠাসা সমাজে পর্দা বা হিজাব পালন করেই যদি একজন নারী অধিকতর নিরুদ্বেগ ও স্বাচ্ছন্দপূর্ণ জীবন যাপন করা শুরু করে তাকে আমি বোকা এবং বাস্তবচিন্তা বর্জিত একজন ঊনমানুষই শুধু ভাববো।কারণ পর্দা বা হিজাব এধরনের সমাজে তাকে একজন সম্ভাব্য ধর্ষকের হাত থেকে বাচাতে যথেষ্ট না।আমার মতে ওই অপরচুনিটি ঠেকানোর জন্যে পুরুষপুঙ্গবদের চোখ আর আলুর দোষ নিয়ে কাজ করাটা বেশি জরুরী।এটা নিশ্চয়ই মানতে হবে যে আমাদের দেশে মেয়েরা অন্তত বুক-নিতম্ব-প্রজননাঙ্গ উদোম করে বাইরে চলাফেরা করেনা।
পশ্চিমের ব্যাপারে আমার অনেক অভিযোগ আছে।এরা উপনিবেশগুলোকে শুষে এত সম্পদ গড়ে এখন ভাব মারে,নিজের দেশে গণতন্ত্র মানলেও অন্য দেশে নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটায়(৫২ তে ইরানের মসাদ্দেক সরকার, ৭৫ এ চিলির আয়েন্দে, সৌদির ফয়সাল ইত্যাদি), সামরিক শাসন উস্কে দেয়।ইসরাইলুকে কোলে নিয়ে নাচে ইত্যাদি।কিন্তু যে দোষ তাদের না , তা তাদের ঘারে চাপাতে গেলে আমাকে ভন্ড ছাড়া আর কী বলা যাবে?
নিজের মত-পথকে শ্রেয় প্রমাণ করার জন্য অন্যের যুক্তিভিত্তিক নিন্দা করা যায়।কিন্তু তা করতে গিয়ে যারা অন্যের সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দেয়,ভুল মূল্যায়ন করে তাদেরকে আমি শুধু ভন্ড বলি না, গর্দভও বলি।
স্যরি,সব মিলিয়ে লেখাটা ইয়াব্বড়ো হয়ে গেলো!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



