না, সেদিন সন্ধ্যায় জাকির মাস্তান আমাকে তুলি নিতে আসেনি। বরং সেদিন তার উপকারের কথা ভুলবার মত নয়। বাবা মদ খেয়ে বাড়ী ফিরছিলেন। বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে ডান হাত ভঙ্গে নেন। জাকির মাস্তান তাকে দেখে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে মোটর সাইকেলে বাড়ীতে নিয়ে আসেন। তাই সেদিন দরজায় দাঁড়িয়ে জাকির মাস্তানকে দেখে যতটা ভয় পেয়েছি তার চেয়ে বেশী আতংকিত হয়েছি বাবার ভাঙ্গা হাত দেখে। ভাঙ্গা হাত নিয়ে বাবা ঘরে ঢুকতেই চেঁচাতে লাগলেন-কই মরছিলি? দরজা খুলতে এতক্ষন লাগে? ঘরে বসে বসে কি করিস? পিড়িত করিস? বেশী পিড়িত ভাল না। একটা পিড়িত করে পালিয়েছে। আরেকটার সুর উঠেছে। আমার খেয়াল রাখিস? আজ জাকির না থাকলে কি হত সে চিন্তা আছে? জাকিরকে ঘরে নিয়ে যা, বসতে দে, চা, পানির ব্যবস্থা কর। আমি আসছি বলেই বাবা চিলেকোঠার দিকে রওনা হলেন। তার রোগ-কষ্ট এখন একটি মানুষ ঠিক করতে পারবেন সে হল মোতালেব আংকেল। বাবার কাছে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এক পাশে এবং মোতালেব আংকেল অন্যপাশে। তার হোমিও বিদ্যার যাদু না পেলে বাবা এখন ঠিক হবেন না।
আমি জাকির মাস্তানের দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বললাম-জাকির ভাই, ভেতরে আসুন। একটা গামছা দিচ্ছি মাথা মুছে ফেলুন। এ কথা শুনে সে মাথা নিচু করে বললো-আমি ঠিক আছি ইরা, আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।
-জাকির ভাই, আপনাকে নিয়ে কেউ ভাবছে না। বাবা আপনাকে বসতে বলেছে তাই ভেতরে এসে বসুন আমি চা নিয়ে আসছি। আমার কথা শুনে জাকির মাস্তান বাধ্য ছেলের মত ঘরে এসে বসলেন। ইনিয়ে বিনয়ে বলতে লাগলেন-আমি খুব লজ্জিত ইরা, সেদিনের কাজটি আমার মোটেও উচিৎ হয়নি। আমি কিছুক্ষন তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, না বুঝার ভঙ্গিতে বললাম কোন কাজটির জন্য লজ্জিত?
জাকির মাস্তান কিছুক্ষন চুপ থেকে বলেলেন-ওই যে, সেদিন তোমাকে একটা চিঠি দিয়েছি! বিশ্বাস করো আমার কোন বাজে উদ্দেশ্য ছিল না। মজা করতেই চিঠিটা দেয়া।
-আচ্ছা, তার মানে আপনি আমাকে ভালবাসেন না ! মজা করতেই চিঠি দিয়েছেন?
-না, তা নয়। তুমি ভুল বুঝছো!
-আপনি কি ঠিক বুঝছেন? আপনার এই ঠিক বুঝার জন্য আমার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?
-আমি না হয় তোমার বাবাকে বুঝিয়ে বলবো।
-আপনাকে কিছুই করতে হবে না। আমার মনে হয় না সে এসব কিছু মনে রেখেছেন! নেশাগ্রস্থ মানুষ কোন কিছু মনে রাখেন না। যে কাউকে যখন তখন বন্ধু বানিয়ে ফেলে। যাই হোক, আপনার চায়ে কয় চামচ চিনি দিব?
আমার কথা শুনে জাকির মাস্তান আরো কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু বললেন না, নিরিহের মত তাকিয়ে রইলেন। আমিও আর কোনকথা না বলে রান্না ঘরে চলে এলাম।
মানুষ বড়ই অদ্ভুদ প্রাণী। উপরে দেখতে যেমন ভেতরে তেমন নয়। কয়েক বছর আগে দোকানদার বাচ্চু মারা যাবার পর কিছু মানুষ বাচ্চুর দোকানে লুট চালায়। মানুষ দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতে থাকে, সেদিন কেউ এগিয়ে না আসলেও এগিয়ে আসে জাকির মাস্তান, পিটিয়ে ব্যাঙ বানিয়ে দেয় সব গুলোকে। মার খেয়ে লোক গুলো কোয়াক কোয়াক শব্দ করতে থাকে। সেদিনের পর থেকে জাকিরের নামের পাশে মাস্তান টাইটেল বসে যায়। তাছাড়া জাকির মাস্তান সম্পর্কে আরো কিছু শোনা যায়। লোকে বলে নির্বাচনের দিন জাকির মাস্তান নাকি চেয়ারম্যানকে থাপ্পর দিয়ে মুখে থেকে পান ফেলে দিয়েছে। সে নিয়ে অবশ্য চেয়ারম্যান কিছু বলেনি। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে চেয়ারম্যান বলে জাকির নটি বয়, ভেরি নটি বয়!
প্রেমে পড়ার কিছু লক্ষন থাকে। জাকির মাস্তান যে আমার প্রেমে ডুবে যাচ্ছে এটা তার চোখ থেকে বুঝা যায়। শুধু মজা করে মানুষ কাউকে প্রেমপত্র দেয় না, প্রেমপত্রে লিখে না 'ইরা, তোমাকে দেখলে আমার বুকে ব্যাথা হয়' হয়তো এই ব্যাথা সারাতে জাকির মাস্তান প্রতিদিন আমাদের বাড়ীর সামনে দাড়িয়ে থাকতো, কলেজের যাবার সময় পিছু নিত। তার সিগারেটের উচ্চ ধৌঁয়া জানান দিত আমাকে ঘিরে তার কতো হতাশা! আমি সব কিছু বুঝতাম কিন্তু কিছু করার ছিল না। মীরা আপা যে কাজ করেছে তার পুনরাবৃত্তি ঘটা সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার জীবনের এক অন্ধকার অধ্যায় আছে, আমি চাই না সে অন্ধকারে কেউ হারিয়ে যাক।
(চলবে)
পড়ুন- হঠাৎ সন্ধ্যা (৩য় পর্ব )
পড়ুন-হঠাৎ সন্ধ্যা (২য় পর্ব )
পড়ুন-হঠাৎ সন্ধ্যা (১ম পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০২২ বিকাল ৫:৩২