somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গুড ওল্ড নাইন্টিজ

২৭ শে মে, ২০২০ বিকাল ৪:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমরা গল্প করছিলাম সাত্তার মিয়ার চায়ের দোকানে বসে। সাত্তার মিয়া জঘন্য চা বানায়। আমার বন্ধু সোবহানের মতে এই চা ঘোড়ার মুতের সমতূল্য। সাত্তার মিয়ার সামনেই এসব আলোচনা করা হয়। আলোচনার উদ্দেশ্য এই না, যে সে আমাদের সমালোচনায় দংশিত হয়ে নিজেকে সংশোধন করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে আগামীকাল থেকে চমৎকার চা পরিবেশন করবে। আমরা জানি, সাত্তার মিয়ার এসবে কিছু যায় আসে না। সে দিনের পর দিন ঘোড়ার মুতই বানিয়ে যাবে। আমাদের সাথে আজ আজ আলোচনায় যোগ দিয়েছেন দুই প্রজন্ম আগের একজন প্রবীণ। তাকে আমরা বাহার ভাই বলে ডাকি। তিনি তার বয়সোচিত গাম্ভীর্য নিয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ করছেন, এবং মাঝেমধ্যে জীবন এবং যৌবন বিষয়ক বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন, যদিও ভালোভাবেই জানেন, চায়ের কেটলির বাষ্পের মত এই টোটকাগুলিও কিছুক্ষণের মধ্যেই পথ হারাবে অনির্দিষ্ট গন্তব্যে। আলোচনাটা বেশ ঝিমিয়ে পড়েছে। কেউ ভালো কোন প্রসঙ্গ আনতে পারছে না। বাহার ভাইও কিছুটা অস্বস্তিতে আছেন মনে হচ্ছে। মহল্লায় তার প্রজন্মের লোকজন সাত্তারের দোকানে এলে তরুণ প্রজন্মের ওপর যতটা কর্তৃত্ব আরোপ করে ফেলেন মুহূর্তের মধ্যেই, সেখানে তার খানিকটা ঘাটতি আছে বলে মনে হচ্ছে। আর কিছুক্ষণ পরে তার কোন কাজের অজুহাত দেখিয়ে চলে যাবার কতটা সম্ভাবনা আছে এ নিয়ে সোবহান অথবা মিন্টুর সাথে আমার একটা বাজী ধরতে ইচ্ছে করছে।
-অবস্থা দেখছোস? বরিশালে একটা পোলারে কুপায়া মাইরা ফেলছে। ভিডিও বাইর হইছে কুপানির। তার প্রেমিকাও নাকি জড়িত এর সাথে।
প্রেমিককে কুপিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, এর ভিডিও বের হয়েছে এবং এতে প্রেমিকাও জড়িত, এমন প্রসঙ্গের অবতারণায় আমাদের ঝিমিয়ে পড়া বৈকালিক আড্ডায় আশার আলো জ্বলে ওঠে। আমরা সবাই গোল হয়ে বসে ভিডিওটি দেখি, এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মেয়েটির জড়িত থাকার সম্ভাবনা কতটুকু এ নিয়ে মতামত দিতে থাকি। পাশের বেঞ্চে বাহার ভাই চুপচাপ বসে আছেন, তাকে এখানে সম্পৃক্ত না করাটা সোবহানের কাছে অভদ্রতা মনে হয়। সে তাকে সাধে, “দেখবেন নাকি বাহার ভাই? দেখেন কী অবস্থা দেশের! এইভাবে তো আসলে চলতে পারে না!”।
-আইচ্ছা, দেও দেহি।
নিতান্তই অনিচ্ছা আর অবহেলা নিয়ে তিনি সাড়া দিলেন। এমন একট চাঞ্চল্যকর বিষয়ে তার এহেন নির্লিপ্ততা আমাদের আহত করে। আগ্রহ করে একটা জিনিস তাকে দেখতে দেয়া হচ্ছে, তার এই মূল্য? কিছুক্ষণ দেখে তিনি হাই তুলতে তুলতে নিজের বেঞ্চে ফিরে গিয়ে আরেক কাপ ঘোড়ার মুত এবং পাঁচটা বেনসন সিগারেট অর্ডার করলেন। ঘোড়ার মুতে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করে আমাদের উদ্দেশ্যে তিনি এমন এক বিশেষ ভঙ্গিমায় বক্তব্য দেয়া শুরু করলেন, যা তার বয়স এবং অভিজ্ঞতাকে মহিমান্বিত করে, যেরকমটা তরুণ সমাজ শোনার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকে।
-আমাদের সময়ে, মানে ইন দ্যা নাইন্টিজ একেকটা খুন হইলে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এইটা নিয়া আলোচনা চলতো। পত্রিকাগুলা বিশেষ সংখ্যা বাইর করতো। লঞ্চে-বাসে চটি বই পাওয়া যাইতো ঘটনা নিয়া। আর এখন? ভিডিও, শেয়ার, ফেসবুক, দুইদিন মাতামাতি, শ্যাষ! এই যে তোমরা বরিশালের ঘটনার ভিডিও দেখতাছো, দুইদিন পর আরেকটা খুন হবে, আরেকটা ভিডিও বাইর হবে, ঐডা নিয়া মাতামাতি করবা। সোসাইটিতে আসলে আগের স্ট্যাবিলিটি নাই। সবার বড় তাড়াহুড়া। আহারে, কীসব দিন ছিলো আগে!
-আপনের কথা পুরাপুরি ঠিক না বাহার ভাই। কিছুদিন আগে নারায়নগঞ্জের সেভেন মার্ডার নিয়াই তো অনেকদিন আলোচনা চললো।
প্রতিবাদী স্বভাবের মিন্টু পালটা জবাব দিলো।
-আরে পলিটিক্যাল মার্ডার আর পার্সোনাল ঘটনা দুইটারে এক পাল্লায় মাপলে তো হবে না! তোমরা মুনির-রিমা মার্ডারের ঘটনা শুনছো?
আমরা সসংকোচে আমাদের অজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। সাথে এই বুঝতে পারলাম যে চমৎকার একটা গল্প আসতে যাচ্ছে। মিন্টুকে চোখ মটকে সংকেত দিলাম, যেন আর খামোখা তর্ক করে পরিবেশটা মাটি করে না দেয়। বিকেলটা রঙ ফিরে পেতে শুরু করেছে।
-রিমা মার্ডার কেসটা ছিলো পরকীয়ার। মুনির আর রিমার বিয়ার বয়স ছিলো মাত্র ৩ মাস। এর মধ্যে মুনিরের সাথে সম্পর্ক হয় খুকু নামের এক নার্সের। মুনিরের মা ছিলো ডাক্তার,গাইনির। তার সাথেই কাজ করতো। মজার ব্যাপার হইলো গিয়া খুকু ছিলো মুনিরের চেয়ে বয়সে মেলা বড়। মুনিরের বয়স ছিলো ত্রিশ, আর খুকুর পঞ্চাশ। রীমা সুন্দরী আর ভদ্র মাইয়া হইলেও মুনিরের কেন যেন তাকে পছন্দ হয় নাই। বিয়ার এক মাসের মাথায় সে বুঝতে পারে যে রিমার সাথে তার চলবে না। মুনিরের বয়স্ক মহিলার প্রতি ফেটিশ ছিলো, বুঝলা? ফেটিশ মানে বোঝো তো, না? হ, তা তো বুঝবাই! বড়লোকের পোলা মুনিরের এক নারীতে চলতো না। রিমা বেচারি যতই সুন্দর আর ভদ্র হোক না কেন ঐ হারামজাদার মন গলে নাই। এইদিকে খুকুর সাথে ঘটনা একদিন রিমা টের পায়া যায়। মুনিরের শার্টে লিপস্টিকের দাগ দেখে। এ নিয়াই দুইজনের ঝগড়া…
ত্রিশ বছর আগের ঘটনা নিখুত ডিটেইলস সহ বাহার ভাই বলতে থাকেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে থাকি। কীভাবে খুন করা হয়েছিলো, কীভাবে মুনির ধরা পড়লো, কীভাবে মুনিরের বড়লোক বাবা আর মা তাকে রক্ষার চেষ্টা করলো, এবং অবশেষে যে মুনিরকে আর রক্ষা করা গেলো না, সমস্ত বর্ণনায় সুস্পষ্ট অনুরাগের ছাপ পাওয়া যায়।
ঘটনা বলা শেষ হলে তিনি তার সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন আমাদের সবাইকে এক কাপ করে ঘোড়ার মুত এবং সিগারেট সেধে। আমরা সবাই ঘোড়ার মুত মুখে দিয়ে মুখ বিকৃত করলাম। বাহার ভাই শব্দ করে চা খাচ্ছেন। আমরা নীরব। কিছুটা বিব্রতও বলা যায়। সেই খুনের ঘটনা নিয়ে যে পরিমাণ আলোড়নের গল্প শুনলাম, আমাদের সময়ে আসলেই তো সেরকম কিছু হচ্ছে না। খুন হচ্ছে ঠিকই, প্রচুর খুন হচ্ছে, কিন্তু মনে রাখার মত এমন একটা খুনের ঘটনা কি আমরা পেয়েছি আমাদের শৈশবে, তারুণ্যে? আর কিছুদিন পর কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবো, বিয়েশাদী করবো, বাবা হবো, চুলে পাক ধরবে, মহল্লার মুরুব্বী হবো, তখন চায়ের দোকানে এসে সেই সময়ের তরুণ প্রজন্মকে বলার মত তেমন কিছু কি আছে আমাদের কাছে?
সন্ধ্যা নেমে আসে। বাহার ভাই চলে যান দৃপ্ত পদক্ষেপে। আমরা বসে থাকি পুরোপুরি অন্ধকার নেমে আসার জন্যে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যে শেষ চেষ্টা চালায় মিন্টু।
-সাত্তার মিয়া, তোমার চাচতো ভাই না খুন হইলো গতমাসে? ঐটার আপডেট কী? এইগুলা নিয়া পত্রপত্রিকায় লেখা দরকার, বুঝলা? আমার পরিচিত সাংবাদিক আছে তাদের দিয়া রিপোর্ট করামু কিছু?
সাত্তার মিয়া কোন আগ্রহ দেখায় না।
-করাইলে করান, আমারে জিগানোর কী আছে? লন, চা লন।
এসব অশিক্ষিত মানুষকে কিছু বোঝানো কঠিন, বেশ কঠিন। এদের জীবনে কোন আশা নাই, হতাশা নাই, প্রাপ্তি নাই, সমাজের প্রতি কমিটমেন্টও নাই। এদেরকে উদ্দীপ্ত করা বেশ কঠিন!

সন্ধ্যা নেমে আসছে। ঝরা পাতায় ধ্বনিত হচ্ছে স্থবির বিষাদ। আমরা বিষণ্ণ মুখে ঘোড়ার মুত পান করতে থাকি।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০২০ বিকাল ৪:৪২
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×