somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: চুড়ি

২৩ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কোনার মাসছয়েকের নতুন গজিয়ে ওঠা মেগাস্টোরটাতে আমি প্রায়ই যাই। হেন বস্তু নেই পাওয়া যায় না। কিন্তু আমাকে সবচেয়ে আকর্ষণ
করে ওদের জুয়েলারীর কালেকশনটা।গয়নাগাটির প্রতি আমার খুব আগ্রহ -আর আর সব মেয়ের মতই। তাই যে কাজেই যাওয়া হোক, ওখানটাতে একটাবার ঢুঁ মারতে ভুল হয় না আমার। লুকটাকে একনিমিষে বদলে দেবার মত এমন জিনিস আর কি আছে?

সব আনুষঙ্গিকের মাঝে একটু বিশেষ আলাদা দূর্বলতা আমার চুড়ির প্রতি। দোকানে গেলেই চোখ আটকে যায় এই অংশটাতে-যেখানে থরে থরে রংরেরঙের রিনিঝিনি চুড়ি সাজানো-আমাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। এই করে করে কত কত ঢঙের যে সংগ্রহ হয়েছে ,তাও আরো কেনা চাই-ই।আই জাস্ট কান্ট হেলপ ইট। এসব কারনেই শপিং-এ গেলে শাহেদ -রুম্পার প্রধান চেষ্টা থাকে কোন দোকানে এসবের সমাহার থাকলেও ঐদিকটাতে আমার যেন চোখ না পড়ে !

তা স্টোরটাতে যখনই যাই -প্রায়শই নতুন নতুন কালেকশন দেখি, একই জিনিস দ্বিতীয়বার গিয়ে খুব দেখতে পাওয়া যায় না। হবে নাই বা কেন? দূর্দান্ত সব ডিজাইনের লেটেস্ট সংযোজন আনা হয় ওখানে- আর তাছাড়া আমাদের এখানটা মূলত আবাসিক এলাকা- এরকম বড়সড় দোকান আশেপাশে আর নেই-তাই দামটা একটু চড়া হলেও দূরে যাবার ঝামেলা এড়াতে মানুষজন দেদারসে কেনে ঐখান থেকে। তো রংবেরঙের নানা ধাঁচের নতুন নতুন ডিজাইনের ফাঁকে একমাত্র বেখাপ্পা হয়ে প্রতিবারই দেখি জায়গা দখল করে থাকে একটা মোটাসোটা গাবদা সাইজের -চুড়ি না বলে বালাই বলা যেতে পারে ওটাকে। রংধনুর সাতটি রঙের চেয়েও বেশী রঙের বাহার তার শরীরে। বেশ মোটা ধাঁচের এই জিনিস ঠিক যেন দাদীনানীর আমলের সময়কার। এখন এ জিনিস বানায়-ই বা কে আর পরে-ই বা কে? অদ্ভূত রকমের বেখাপ্পা দেখায় ওটাকে হালফ্যাশনের সব সঙ্গীসাথীর সাথে।

এই জিনিসটা সঙ্গত কারনেই বিক্রিও হয় না, এই পদার্থ কে নেবে সাধ করে গাঁটের কড়ি ফেলে?আমাকে তো মাগনা দিলেও না।তাই যতবার যাই প্রতিবারই হেলায় অনাহুত অতিথির মত পড়ে থাকতে দেখি, যাবার জায়গা নেই অথচ যেখানে সে আছে সেখানে- অবাঞ্চিত।

সামনেই রাতুলের বিয়ে। আমাদের একমাত্র আদরের ছোটভাই- চারচারটি বোনের পরে পরে। তার উপর পরিবারের শেষ বিয়েও বটে। সেদিন কলিগের সাথে অফিস শেষে আড়ং-এ বেহুদা ঘোরাঘুরির ফাঁকে ধাঁই করে একটা শাড়ি কিনে ফেললাম।এমন একখানা যা সাধারনত অন্যসময় ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেই সাধ মেটাতে হয়। সাথে গোপন ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস!এবার নিয়েই নিলাম, মনে সুপ্ত ইচ্ছা সামনে সমাগত আনন্দের উপলক্ষ্যে এইটির শুভ উদ্বোধন হবে। এমনিতে খুব হিসেবী হলেও এমন একটা ব্যাপারে কিছুটা বল্গাহারা হলে কি হয়? আরে বাবা টাকা আয় হয় তো ব্যয় হবার জন্যেই তাই না?


বাসায় এসে শাহেদ-রুম্পার উচ্ছসিত প্রশংসায় এত্তগুলো প্রায় অনর্থক খরচের গ্লানি আরও কমে যায় মন থেকে।আমি গয়নার বাক্স নিয়ে বসে তখন তখনই ঠিক ঠাক করতে চেষ্টা নিই- কোনটা এর সাথে মানাবে। মেয়েদের পোশাক আশাক সাজসজ্জার ক -খ- গ মাত্র। বর্ণমালার শেষ অক্ষরে পৌঁছাতে হলে পায়ের আঙ্গুলের ডগা থেকে মাথার চুলের প্রান্ত পর্যন্ত নিঁখুত হতে হয়। কোনটাতে কমতি থাকলে বাকিটুকু পূর্ণতার দিকে কেউ তাকায় না, চোখে পড়ে খুঁত-তাতেই। বাজে ব্যাপার।

আমি আবার সাজগোজ ভালো বাসি, এ ব্যাপারটাতে আমার শৌখিনতার একটু খ্যাতি আছে, নিজেকে সুন্দর করে তোলাটা একটা চ্যালেঞ্জ- ভাবতে ভালোবাসি আমি। বিশেষত মেয়েদের তো বটেই - যে মেয়ে পর্দামোড়া আপাদমস্তক , তার নিজেকে আবৃত ঢেকে রাখার মাঝেও কিন্তু নিজস্বতা থাকে।

গয়নার সব বাক্সগুলো নিয়ে তো উপুড় করলাম খাটে। দিনে দিনে কম জমে নি- যেকোন মুহূর্তেই আপাত অপ্রাপ্যতায় যেকোন রঙের ফরমায়েশ পূরণ করতে সক্ষম আমার এই জাদুর ঝাঁপি।

বহু নেড়ে চেড়ে দেখার পরেও আজ কিন্তু এ আমাকে হতাশ করলো। শাড়িটাতে প্রচুর রং আছে- লাল ,নীল, কমলা, সবুজ , হলুদ -এর মাঝে যেকোনটা নিয়ে মিলিয়ে পরলেই হয় কিন্তু কেন যেন কোনটার সাথে ম্যাচিং সেটই দেখতে ভালো লাগছে না। রং মিশছে কিন্তু চোখে ধরছে না , ব্যাপারটা আজব।কি করা যায়?আজ কাল বাদে পরশু -ই অনুষ্ঠান। কালকে অফিস সামলে কিছু করার সময় হবে না মোটেই। তাছাড়া এসব জিনিস শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টানা আমার খুব নাপছন্দ- দেখা যায় একটা না একটা বিপত্তি বাঁধবেই।

ভাবতে ভাবতে আমার ধাঁ করে মনে এল- অফিসে গেল বৃহস্পতিতে আগের ম্যানেজার স্যারের জন্যে যে ফেয়ারওয়েলমত হয়েছিল, ওখানে নীশিতা ভাবি একটা বহুবর্ণী শাড়ি পড়ে এসেছিলেন -অনেকটা আমারটার কাছাকাছি, সাদামাটা টব, লম্বা সরু চেনে তার সাজগোজের পুরো আকর্ষণটা গিয়ে জমেছিল তার হাতের ঝকমকে পাঁচমিশালি রং -এর মোটা সোটা বালাটাতে। অন্য জবরজং বাহারের মাঝে তারটা চোখ আটকাচ্ছিল অনন্য স্নিগ্ধতাতে- আলাদা ভাবে। চিন্তা করে মনে হলো আমার কাছের দোকানটাতে অনাদরে পড়ে থাকা বালাটাইপের চুড়িটি আমার সমস্যারও সমাধান দিতে পারে। আজকাল আবার কম সাজে আধুনিক হয়ে ওঠার চল চলছে- যেটাকে কাল পর্যন্ত আলনাটাতে চোখের জন্যে পীড়দায়ক এমনকি কদাকার এক অবস্থান বলে মনে হচ্ছিল তাই আমার কাছে এখন অবশ্য সংগ্রহনীয় মনে হতে লাগলো। ও চুড়িটা আমার চাই-ই চাই।

সময় বেশী নেই , আমি তখনই দোকানটাতে ছুটলাম। জানা ক্থা কোথায় থাকে, সোজা নির্দিষ্ট জায়গাটাতে গিয়ে হাত দিলাম।আজ কেনাকাটার সময় লাগছে না একদম, নরম্যালি এসব জিনিস কিনতে গিয়ে যে পরিমাণ ঘোরাঘুরি দেখাদেখি বাছ বিচার - উফ! তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানেন। আমি হাত ও নজর দিয়েই কিন্তু বেকুব বনে গেলাম- চুড়িটা নেই। চোখে ভুল দেখছি নাতো। কই যাবে? না তন্ন তন্ন করে চোখ বোলালাম, নেই নেই নেই। আমার সাধের জিনিসটা কোথ্থাও নেই। এ কি করে হল? তবে কি বিক্রি হয়ে গেছে? ভেবেই ভাবতে চাই না আমি- তা কি করে হয়? এত্তদিন ধরে পড়ে আছে.. আর তাছাড়া অন্যে এ জিনিস নিয়ে করবেটা কি? এর মর্ম, কিভাবে পরলে এর রূপটা খুলবে - এ আমার চেয়ে বেশী আর কে জানে?

এককালের করুণতার প্রার্থী চুড়িটার জন্য আমার নিদারুন মর্মবেদনা হতে থাকে।

সেলসগার্লটা কাছেই ছিল। আমি এগিয়ে গেলাম ওর দিকে।

আচ্ছা এখানে একটা চুড়ি ছিল না, ওটা কোথায়?

ম্যাম , এখানে তো চুড়িরই সেকশান , অনেক আছে,বিশেষ কোনটার কথা বলছেন?

নিজের বোকাটে প্রশ্নে নিজের উপরই রাগ ধরে, যেন দুনিয়ার সবাই জেনে বসে আছে আমার মনকামনার কথা..!

ঐ যে একটা মোটামত, অনেকগুলো রঙমেশানো ছিল না..?

ওহ! ম্যাম ওটা তো আজ সকালেই সেল হয়ে গেছে।

হতাশা চেপে রেখে আমি শুধাই,

আর আছে ঐ ডিজাইনের?

সরি!ম্যাম । আসলে ওসব নকশা এখন আর চলে না তো। ঔটাই অনেক দিন ধরে পড়েছিল...তাছাড়া দামেও অনেক বেশি.. ঐরকম সূক্ষ্ণ কাজ ..।বেশী আনলে পোষায় না।
আর আমাদের স্টোরে তো জিনিস আনলেই বিক্রি হয়ে যায়, ওটাই দেখলাম শুধু এত সময় নিল, প্রচ্ছন্ন গর্ব নিয়ে আপাত বিনয়ে বলে চলে প্রগলভা মেয়েটি।

আমকে উৎসাহিত করতে বলে ওঠে, আরও অনেক সুন্দর এক্সক্লুসিভ ডিজাইন আছে ম্যাম আমাদের, এই ডিসপ্লের বাইরেও, আপনাদের মত ক্রেতার জন্যেই আলাদা করে রাখা,সবার জন্যে তো নয় ওসব -অভিজ্ঞ বিক্রয়কর্মীর মত পুরনো কায়দায় মেকী সমাদর করে সে।

না থাক দেখাতে হবে না, আমি মনের ভাব গোপন রেখে উদাসীন ভাবে বলি।

হতাশ ,বিরক্ত, একটু রাগ লাগে জানি না কার প্রতি...।


....এবং জীবনে অন্তত প্রথমবারের মত নিস্পৃহ চোখে রাশি রাশি চোখধাঁধানো চুড়ির সাজানো আকর্ষণহীন আলনাটার দিকে শেষবারের মত তাকিয়ে আশাহত ফেরার পথ ধরি..


রেজওয়ানা আলী তনিমা
২৩/৪/১৪ ইং
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১১:০০
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×