somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফেরা

১৪ ই মে, ২০১৮ বিকাল ৫:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একদা জীবনের টানে জন্মদাত্রী মমতাময়ী মায়ের আঁচল ছিন্ন করে ইট-কাঠ-পাথরের ঢাকা শহরে আসতে হয়েছিল। প্রথম দিকে রাজধানী শহরকে একেবারে অসহ্য লাগত। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে নিজেকে খুব একা লাগত। মায়ের জন্য, বাড়ির জন্য মনটা ভীষণ আনচান করত। সেজন্য যখনই ছুটি পেতাম প্রায় উড়ে বাড়ি চলে যেতাম।



ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরতে আমি কিছু অদ্ভুত নিয়ম পালন করতাম। এর জন্য বিশেষ পরিকল্পনাও করতাম। সেগুলো হলোঃ হুট করে বাড়ি গিয়ে বাবা-মাকে চমকে দেয়া; কিছুটা রাত করে বাড়ি ফেরা এবং নিজের কন্ঠস্বর যথাসম্ভব কাউকে না শুনিয়েই বাড়িতে পৌঁছানো। কেন এমন করতাম?

একটা বিশেষ উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখেই আমি এসব করতাম। আর সেই উদ্দেশ্যকে যথাযথভাবে বাস্তবে রূপদান করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম। কি সেই উদ্দেশ্য? সেটা হল, “বাড়ি পৌঁছে মায়ের স্নিগ্ধ, দরদী মুখটা আগে দেখা এবং উনার দরদভরা কন্ঠস্বরটি প্রথম শোনা”।

ঢাকা থেকে ঠিক বেলা তিনটার গাড়িতে উঠে বসতাম। বাড়ি পৌঁছাতে আনুমানিক রাত ৮-৯টা বেজে যেত। ঢাকা আসার তৎপরবর্তী বিশ বছর এই নিয়ম মেনেই বাড়ি গিয়েছি। কদাচিৎ এর ব্যতিক্রম হত। যাক, বাস স্থানীয় বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছালে একটা অপরিচিত রিকশায় চেপে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতাম। এক্ষেত্রে অপরিচিত রিকশাই আমার প্রথম পছন্দ ছিল। চলার পথে চারিদিকে লক্ষ্য রাখতাম কেউ আমাকে দেখে ফেলল কি-না। আমার চোখে পরিচিত কেউ পড়ে গেলে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নিতাম। তবে তখন অন্ধকার থাকত বিধায় প্রায় নির্বিঘ্নেই বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে যেতাম। আর ভাগ্যদোষে আমাকে কেউ আগে দেখে ফেললে রিকশা না থামিয়ে হাত ইশারা করে চলে যেতাম। গ্রামে ঢোকার পর থেকে নিজেকে আড়াল করার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী সাবধান থাকতাম। এ সময় যদি আমার নিজের ভাইও চোখে পড়ত তবু থামতাম না। আমি এতটাই সিরিয়াস থাকতাম। যেহেতু পুরো গ্রাম তখন অন্ধকারে ডুবে থাকত সেজন্য তেমন কারো সাথে দেখা হত না। বাড়ির বাইরের রাস্তায় রিকশা থামত। এই পথটুকু সবচেয়ে বেশী বিপদের কারণ ছিল। আমাদের বাড়ি ঢোকার আগে ছোটচাচার ঘর পড়ত। এ সময় তাদের যে কেউ বেরিয়ে আসতে পারত। সেজন্য প্রায় লুকিয়ে ভেতরে ঢুকতাম। তবে বেশীরভাগ সময়েই আমার ভাগ্য খুবই সুপ্রসন্ন থাকত। মানে তেমন কাউকে চোখে পড়ত না। আর দুর্ভাগ্যবশতঃ যদি সামনে কেউ এসেও যেত তখন ‘হ্যা হু’ করে দ্রুত বিদায় নিতাম। বাড়িতে সে সময় অচেনা কোন অতিথি থাকলে আমার এই ‘পালিয়ে যাওয়া’ দেখে হয়ত ‘চোর’ ‘চোর’ বলে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলত। যাইহোক সে রকম কিছু ঘটেনি সেটাই ভাগ্য।

অবশেষে আমাদের বাড়ির আঙ্গিনা; স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন; অবশেষে মাটিতে, নাড়িতে ‘ফেরা’। ‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে’। যদিও আমার এই ফেরার ‘মূল’ উদ্দেশ্যই তখনো সম্পন্ন হয়নি। আমার প্রিয় মায়ের মুখটা দেখা, তার কন্ঠস্বর শোনা! মনের মধ্যে তখন আনন্দের জোয়ার বইত। আস্তে করে দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আমি শুধু একটি শব্দই উচ্চারণ করতাম, ‘মা’। এতেই আমার ‘মা’ চোখেমুখে খুশির ঝিলিক মাখিয়ে অতি দরদমাখা কন্ঠে বলে উঠতেন, ‘আমার বেটা আসছে’! মা ত্বরিত এসে আমার গাম্যে, মাথায় হাত বোলাতেন। আর অবধারিতভাবে শুষ্ক কন্ঠে বলে উঠতেন, ‘আহারে! আমার ব্যাটা কাবু হয়ে গ্যাছে’। ও আল্লাহ! সেই ডাক, সেই কঠস্বর, সেই আদর, সেই স্পর্শ! দিনের পর দিন শুধুমাত্র এটার জন্যই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি। এর জন্যই এত এত পরিকল্পনা। এরপর মায়ের সাথে প্রাণের-আত্মার কথা হত। মাকে দেখে, তাঁর আদর মেখে, তাঁর কথা শুনে পথের সমস্ত ক্লান্তি নিমেষেই উধাও হয়ে যেত; অন্তরটা শীতল হয়ে যেত; বুকের ধুকপুকানি থেমে যেত। আমি যে উদ্দেশ্যে বাড়ি যেতাম তা পূরণ হত।

যতবার আমি মনমতো বাড়ি ফেরার কাজটা সুসম্পন্ন করতে পেরেছি ততবার নিজেকে স্বার্থক মনে হয়েছে। আর কদাচিৎ এর ব্যতিক্রম হলে সাংঘাতিক মনোঃকষ্টে ভুগতাম। তবে দয়াময় আল্লাহর কাছে লাখো-কোটি শুকরিয়া যে, তিনি জীবনে বহুবার আমাকে ঐ অনন্যসাধারণ মুহূর্তটা দান করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ! এটাই ছিল আমার বাড়ি ফেরার শ্রেষ্ঠতম আনন্দ।

এখনো বাড়ি গেলে মায়ের সাথে সাক্ষাতের আগে কিছুই করিনা। তবে এখন আগের মত আর বেলা তিনটার গাড়ি ধরি না। বরং বেলা থাকতে থাকতে কিংবা যতটা সম্ভব আগে আগে বাড়ি পৌঁছানোর চেষ্টা করি। অবশ্য এখন আমার প্রাণপ্রিয় মা আমাকে সাক্ষাৎ দিতে বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে এসে অপেক্ষা করেন। আমি মায়ের পাশে বসি। তাঁর সাথে কথা বলি। আমি তাঁকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ডাকি, মনের সকল আবেগ মিশিয়ে মনের অব্যক্ত কথা উজার করে দেই। নিজের সুখ-দুঃখের কথা বলি। চোখে বান নামে। ‘মা’ অবশ্য আমার ডাকে সাড়া দেন না। তিনি চুপটি করে আমার কথা শুধু শুনেই যান। সে সময় চারিদিকে কেমন এক নিঃসীম নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। আসলে কবরবাসীদের কথা ত আমরা শুনতে পাই না!!!

আজ চার বছর হয়ে গেল মা আমাদের মাঝ থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। এর মধ্যে কত কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু চার বছর আগে মায়ের চলে যাওয়ার সেই মুহূর্তটা মনের মধ্যে চিরস্থায়ীভাবে বসে আছে। সময় যেন একেবারে নিশ্চল, নিস্তব্ধ হয়ে আছে এখানে।

আমার অবশ্য ‘মা’কে তেমন মনে পড়ে না। শুধু কবি গুরুর মত হয় আর কি!

‘মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু যখন বসি গিয়ে শোবার ঘরের কোণে,
জানলা থেকে তাকাই দূরে নীল আকাশের দিকে-
মনে হয় মা আমার পানে চাইছে অনিমিখে।
কোলের পরে ধরে কবে দেখত আমায় চেয়ে,
সেই চাউনি রেখে গেছে সারা আকাশ ছেয়ে’।

হে আমার প্রতিপালক! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।” সূরা বনি ইসরাঈলঃ ২৪

“হে আমাদের প্রভু! রোজ কিয়ামতে আমাকে, আমার পিতা-মাতা ও সকল মুমিনকে ক্ষমা করে দিন।” (সুরা ইবরাহীমঃ ৪১)

‘বিশ্ব মা দিবস’ উপলক্ষ্যে অনেকেই নানা কথা বলছেন। ইউরোপ-আমেরিকায় ব্রোকেন ফ্যামেলি বেশী। তারা অনেকটা যান্ত্রিক। সাবালক হবার পর বেশীরভাগ সন্তানই বাবা-মা থেকে আলাদা থাকে। অনেকের বাবা-মা জীবনভর অপরিচিতই থেকে যায়! সেজন্য পারিবারিক জীবন বলতে যা বোঝায় তার অনেকটাই সেখানে অনুপস্থিত। সেজন্য তারা একটা বিশেষ দিনকে ‘মা দিবস’ বানিয়ে মা’কে এক্সট্রা কেয়ার নেয়ার চেষ্টা করে। সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তাদের জন্য এই বিশেষ ব্যবস্থা ঠিকই আছে বোধহয়। যদিও ইদানিং সেখানেও মা দিবস পালনে কিছুটা ভাটার টান লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

তবে আমাদের দেশে এখনো তেমন পরিস্থিতি আসেনি। আমাদের দেশের কোটি-কোটি সন্তানের কাছে এখনো মা মানে আত্মার পুরোটা; মা মানে মা’ই। এর কোন বিকল্প নেই। আর ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে মা দিবস একটাইঃ

“যেদিন পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠে”।

সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০১৮ বিকাল ৫:৩৫
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×