গত কিছুদিন ধরে আমার মনে কেবল একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল, কেন সে আমার সাথে এমন করছে? যে মানবী কে আমি চিনতাম তাকে তো মনের আকাশে টেলিস্কোপ দিয়েও খুঁজে পাচ্ছিনা। সেই আন্তরিকতা, সেই মিষ্টি হাসি, সেই অভিব্যক্তি কিছুই তো এখন দেখিনা। সে এখনও কথা বলে, হাসে কিন্তু সবকিছুতেই যেন কৃত্তিমতার ছাপ।অনেক ভেবেছি কিন্তু কোন কূলকিনারা পাইনি।কখনও ভেবেছি সে আমাকে এড়িয়ে চলছে, আবার ভাবি নাহ! মনে হয় সে কোন ঝমেলায় আছে তাই এরকম করছে।কিন্তু আজ আমার কাছে সব জলের মত পরিষ্কার। আমার সেই দিনের অতিশয় ক্ষুদ্র সৌজন্যতা যে তার কাছে পাহাড়সম ঋণের বোঝা হয়ে যাবে (এতটাই যে তার আমাকে এড়িয়ে চলতে হবে) তা তো বুঝতে পারিনি।যদি বুঝতে পারতাম তাহলে হয়ত আমি এখনও তাকে সেই চিরচেনা রূপেই দেখতে পেতাম আর সে যে আমাকে আসলেই এড়িয়ে চলছে এটা বুঝতে পেরে এখন যে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি, সেটার জ্বালাও সহ্য করতে হতনা।
ঘটনার দিন:
সে: এটা রাখ
আমি: দেখ! আমার শত্রু হলেও মনে হয় এই ক্ষুদ্র জিনিস টা ফেরত দেবার জন্য এতটা উতলা হতনা। আমি এটা নিতে পারব না।
সে: তুমি আমাকে এখনও চিনতে পারনি,আমি এমনই। বলে সে আমার টেবিলে সেটা রেখে চলে গেল।
আমি: শোন! তুমিও আমাকে চিনতে পারনি। বলেই জিনিস টাকে টুকরো টুকরো করে ফেললাম।কয়েক মুহুর্ত পর.............
সে: তুমি কেন এটা আমাকে দেবে?তুমি আমার কে? তুমি একটা স্বার্থপর, শুধু মানুষ কে দিতে জান নিতে জাননা! সব সময় নিজে বড় থাকবে, কাওকে বড় হতে দিবেনা!!!!!!
তার এই কথাগুলো শুনে প্রচন্ড অভিমান হল। সেদিন তার সাথে আর কোন কথা বলিনি। একবার তার চোখে চোখ পড়ল, ফিরিয়ে নিলাম। যে আমি সারাদিনে শতবার তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম, সে আমি একবারের জন্যও তার দিকে ফিরে তাকাই নি। ইচ্ছে যে হয়নি তা নয়, তবে তা দমন করেছি অতি কষ্টে।শুধু চাচ্ছিলাম সে আগে কথা বলুক, যদিও জানতাম এমনটা হবে না (তার প্রচন্ড জেদের সাথে আমি আগেই পরিচিত)। তার পরও তাৎক্ষনিক অভিমানের কারনে তার সাথে কথা বলতে পারিনি।তার পরের ৪ দিনে সে আমার সাথে ৬ টা শব্দ বিনিময় করেছে (নিতান্ত বাধ্য হয়ে)। আমিও তার সাথে কথা বলতে না পারার সকল কষ্ট চাপা দিয়ে কোন বাক্য বিনিময় করিনি। কিন্তু ৪র্থ দিন রাতে মন আর কিছুতেই মানল না , মনে হল দুদিন বাদেই ১০ দিনের ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছি, তার সঙ্গে রাগারাগি করে কিভাবে থাকব এত লম্বা সময়! মনস্থির করলাম কাল সকালেই যেভাবে হোক তার রাগ ভাঙ্গাব।
পরদিন সকালবেলা:
আমি: বারান্দায় গিয়ে তাকে ডাক দিলাম, "এদিকে একটু আস"
সে এসে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। ১ মিনিট পর.........
আমি: আসলে তুমি অল্প কয়দিনেই আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছ, তাইতো সেদিন অমন করেছিলাম। আমি আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চাচ্ছি, এভাবে প্রতিদিন দুজন পাশাপাশি থাকব অথচ কবরস্তানের নীরবতা বিরাজ করবে এটা তো হতে পারেনা, কি বল!
তবুও সে নিশ্চুপ।
আমি: দুই হাতে দুই কান ধরে, " এদিকে দেখ! কান ধরেছি, আর এমনটি হবেনা!"
সে: আমার দেখার দরকার নাই। এসব কথা বলে তুমি তোমার দোষ এড়াতে পারবা না। তুমি জিনিসটা কেন নষ্ট করলা, না নিতে চাইলে কোন গরীব লোক কে দিতা।
তবে তার মুখে যে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে তা আমার চোখ এড়িয়ে যায়নি।
আমি: আচ্ছা বাবা, বললাম তো আমার ভুল হয়েছে! এখন কি তোমার পা ধরতে হবে? ঠিক আছে তুমি তো প্রতিদিন আমাকে বল তোমার সাথে গাড়ীতে যেতে, আজ তো গাড়ী নিয়ে এসেছ, চল আজ তোমার সাথে যাব।
কয়েক মুহুর্ত পর........ হঠাৎ তার সেই খোলা হাসি, যেন প্রস্ফুটিত গোলাপ।
আমি আশ্বস্ত হলাম, যাক বাবা! তার রাগতো ভাঙ্গাতে পেরেছি। ৪ দিন পর তার সাথে স্বাভাবিক ভাব বিনিময় করতে পেরে অনেক ভাল লাগল।অনেক কথা বলেছি সেদিন, তবে সেদিন আর তার গাড়ীতে যাওয়া হয়নি। পরের দিন তার ভাব ভঙ্গী মোটামুটি স্বাভাবিক ছিল এবং ঐ দিনই তার গাড়ীতে করে বাসায় ফিরেছিলাম।ঐ দিন রাতেই গ্রামের বাসায় চলে যাই ১০ দিনের জন্য, তবে সাথে ছিল কিছু সুখানুভুতি, অন্তত তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করলে একটা ফোন তো করতে পারব! আর ছিল তার জন্য এক অদৃশ্য পিছুটান। মনে হচ্ছিল বাসায় যাওয়ার দরকার নাই, এবার ঈদ তার শহরেই করি।ছুটির ঐ ১০ দিনে তার সাথে মাত্র দুবার কথা হয়েছে। তার মধ্যে ঈদের দিনের কথা না বললেই নয়।
ঈদের দিন:
সকালে ঈদের নামাজ শেষ করে বাসায় এসেই ফোন নিয়ে বসলাম, আশায় থাকলাম সে হয়ত ফোন দেবে। অবশেষে ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষা করে আমিই ফোন দিলাম। সাথে সাথেই ফোন রিসিভ করে ওপাশ থেকে........
সে: ঈদ মোবারক!
আমি: ঈদ মোবারক!
সে: আমি আগে বলেছি!
আমি: ফোন করলাম আমি আর আগে ঈদ মোবারক বলার কৃতিত্ব নিচ্ছ তুমি?
সে: আমি ঈদের দিন কাওকে ফোন করিনা কারণ শুধুমাত্র ফোন রিসিভ করলেই আগে শুভেচ্ছা জানানো যায়।
তার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেছিলাম, তবে কিছুটা মজাও পেয়েছিলাম তার দুষ্টামি মেশানো কথা শুনে আর ভেবেছিলাম যাক সবকিছু ঠিকঠাক আছে, আমার প্রতি তার আর কোন রাগ নেই। তারপর শুধুই দিন গুনতে লাগলাম, কবে ছুটি শেষ হবে আর কবে তাকে দেখব।
অবশেষে ছুটি শেষ হলে তার শহরে ফিরে আসলাম। ঐদিন রাতে খুব ভাল ঘুম হয়নি, শুধু অপেক্ষায় ছিলাম কখন রাত শেষ হবে আর সকালে তাকে দেখব। কিন্ত পরদিনই আবিষ্কার করলাম গত ১০ দিনে সবকিছু কেমন যেন বদলে গেছে। সে একবার জানতেও চাইলনা কেমন ছুটি কাটালাম।সারাদিনে যেটুকু কথা না বললেই নয় সেটুকু কথা বলল।বুঝলাম কোন সমস্যা ঘটেছে। আমার প্রচন্ড ব্যাস্ততার কারণে তাকে ২-৩ দিন তেমন ঘাটাইনি। কয়েকদিন পরে আমি আমার স্বভাবসুলভ দুষ্টামিতে মেতে উঠলাম, তাকে সবসময় জ্বালাতন করতে লাগলাম। কিন্তু সে আর আগের মত অভিমানী অভিব্যাক্তি প্রকাশ করেনা, মিষ্টি করে হাসেনা উল্টো আমার সব দুষ্টমির জবাব দেয় ক্যাটক্যাটে ভাষায়।আগে প্রতিদিন কাজ শেষে আমরা একসাথে বের হতাম, কিন্তু এখন সে আগে আগে চলে যায়, যাবার সময় বলেও যায়না।আমি শুধু ভাবতে থাকলাম কি আমার দোষ।
অবশেষে আজ...................
আজ:
আজ তার সাথে অনেক কথা বলেছি, কথার চাইতেও তাকে জ্বালাতন করেছি বেশী।অতিরিক্ত জ্বালাতনের ফলে......
সে: তুমি একটা বিরক্তিকর ছেলে, সবসময় আমাকে বিরক্ত কর।আমার পাশে থেকে যাও!
আমি: তুমি মনে কর আমি তোমার পাশে নাই।
সে: সরি, আমি তা মনে করতে পারছিনা, তুমি উঠবা নাকি আমিই চলে যাব।
এরপরে ঘন্টা তিনেক তার সাথে আর কথা বলিনি। যথারীতি কাজ শেষে আমাকে কিছু না বলেই সে চলে গেল। আমি আজ খুব মর্মাহত হলাম, আসলে আজ আমি আর সে ছাড়া অন্য কেও না থাকায় খুব আশা করেছিলাম একসাথে বের হব। সে চলে গেল, আমি এককাপ কফি নিয়ে বসলাম। হঠাৎ কেন যেন মনে হল ( বোধ হয় তার প্রতি তীব্র ভালবাসার টানে) সে আজ গাড়ী নিয়ে আসেনি, এই মুহুর্তে যদি বের হয়ে যাই তাহলে বাস স্টপেজে দেখা হয়ে যাবে। বের হয়ে গেলাম। বাস স্টপেজে গিয়েই মনটা খুশিতে ভরে গেল তার দেখা পেয়ে, কিন্ত একই সাথে আমি আমার সমস্ত প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলাম। আজ ২৯ তম দিনে এসে বুঝলাম এতদিন সে আমাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছে। কারণ এর আগে যে কদিন সে গাড়ী নিয়ে আসেনি, সে আমাকে তা জানিয়েছে, আমরা একসাথে বের হয়ে লোকাল বাসে চেপে বাসায় ফিরেছি। কিন্তু আজ সে আমাকে কিছুই বলেনি আবার আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য আগে আগে বের হয়ে গেছে। খুবই ব্যথিত হলাম, তবুও সব কষ্ট বুকে চেপে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, স্বভাবসুলভ শয়তানি হাসি দিয়ে বললাম......
আমি: দেখে ভাল লাগছে যে আমাকে না বলে একা একাই আসছ, ভাল! তবে আমি লজ্জিত, যদি জানতাম আমাকে এড়াতে তুমি আগে আগে আসছ তাহলে এ পথে আসতাম না।
সে: যে হাসি দিচ্ছ তাতে তো তোমাকে লজ্জিত মনে হচ্ছেনা।
মনে মনে বললাম এই হাসির পেছনের কষ্ট যদি তুমি বুঝতে!
আমি: যাক দেখা হয়ে ভালই হল, আজ তুমি আমার ঋণ শোধ করার সুযোগ পাবে।সেদিন যা দিতে চেয়েছিলে আজ দাও।
সে দিল, আমি কোন বাক্য না ব্যয় করে নিয়ে নিলাম। তাকে খুবই প্রশান্ত মনে হল, তবে আমার কাছে তার এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে যাওয়ায় কিছুটা অপ্রস্তুত মার্কা হাসি লেগে ছিল তার মুখে। সেদিকে আর ভ্রুক্ষেপ না করে বিদায় নিলাম।এখন সে বোধ হয় অনেক নির্ভার, হালকা বোধ করছে তার ঘাড় থেকে ঋণের বোঝা নামাতে পেরে। যাক! তার সুখেই আমার সুখ!
যাকে নিয়ে এই ফালতু পোষ্ট লিখলাম তার উদ্দেশ্যে:
আমি তোমাকে সবসময় জ্বালাতন করি এজন্যই যে, তোমাকে আপন করে পাবার কোন সম্ভাবনা এ জীবনে তো নাই, তবুও যদি এই জ্বালাতন করার কারণেই আমাকে সারাজীবন মনে রাখ, যখন আমি তোমার আশে পাশে থাকবনা তখন আমাকে মনে কর তাহলেই আমার জীবণ স্বার্থক।আর হ্যাঁ আমার ঋণ যখন শোধ করে ফেলছ আশা করি আর আমাকে এড়িয়ে চলতে হবে না। শুধু একটা প্রশ্ন তোমার কাছে, তোমাকে যে সমস্ত হৃদয় জুড়ে স্থান দিয়েছি, মনের অজান্তেই আমার সব ভালবাসা যে শুধুই তোমার জন্য বরাদ্দ করে দিয়েছি এই ঋণ কিভাবে শোধ করবে তুমি?
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ ভোর ৪:২৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



