somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্নিগ্ধা (অণুগল্প)

১৫ ই নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"সম্পর্ক হল চারাগাছের মতো। ভালোবাসলে একটু যত্ন করতে হয়। যত্ন করে সম্পর্কের গাছটিকে বড় করে তোলেন। সেই সম্পর্ক আর সহজে ভাঙবে না।" দশ মিনিট আগে পরিচয় হওয়া একটি মেয়ের সাথে টিএসসির মিলন চত্তরে বসে আছি। মেয়েটির নাম এখনও জানা হয় নি। শুরুটা টিএসসির এটিএম বুথ থেকে।

এটিএম বুথ থেকে বেরিয়ে আসতেই এই মেয়েটি চিতকার করে ডাকলো, "এইযে..."
আমি আগেও দেখেছিলাম ওকে। আমার পিছনে টাকা তোলার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। আমার কাছে এসে বললো, "টোকেন-বক্সে এটিএম কার্ড ফেলে চলে যাচ্ছিলেন!"
আমি খেয়াল করলাম, আমার হাতে এটিএম কার্ডের বদলে বুথ থেকে বের হওয়া টোকেন। এর আগেও এমনটা হয়েছে। মিরপুরে টাকা উঠিয়ে একবার কার্ড ফেলে এসেছিলাম। ভার্সিটির হলে এসে মনে পড়লো। আবার মিরপুরের সেই এটিএম বুথে ফিরে গিয়ে কার্ড উদ্ধার করেছিলাম।
মেয়েটাকে ধন্যবাদ দিলাম।
"আপনি মানুষটা মনে হয় আত্মভোলা।" মেয়েটি হেসে বললো।
"সুন্দরী মেয়ে দেখলে আলাভোলা হয়ে যাই।" আমি উত্তর দিলাম।
"খেয়াল করেছিলাম। ক্যাশ আউট করার সময় আপনি টাকা না গুণে বার বার পিছনে ফিরে তাকাচ্ছিলেন। সব ছেলেরাই দেখি এক। মেয়ে মানুষ দেখলেই এদের লালা ঝরে!"
এইবার আমি এগ্রেসিভ হলাম, "লালা ঝরার ব্যাপারটা কি শুধু ছেলেদের ক্ষেত্রেই? সুন্দর ছেলে দেখলে আপনার ভালো লাগে না? এখন এতো কড়া করে কথা বলছেন। আমি তো বুঝি, যেচে এসে এটিএম কার্ড দেয়াই শুধু আপনার উদ্দেশ্য না।"
"আপনি নিজেকে কী মনে করেন? হ্যান্ডসাম, সুদর্শন অনেক? এইসব হাবিজাবি ভার্সিটি লাইফে পার করে এসেছি অনেক আগেই। ফ্রেন্ডশীপ করে পরে রিলেশন করা- তারপর... আপনাদের চেনা আছে।"
"আপনিও ত তাহলে কম অভিজ্ঞ না! বিতর্ক করতে চাইলে চলেন টিএসসির মিলন চত্তরে। আমার হাতে যথেষ্ট সময় আছে।" আমি বললাম।

তারপর এই অপরিচিত রূপবতীর সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছি। বাইরে আলাভোলা হলেও সুন্দরী মেয়ের প্রতি আগ্রহ কম না। অবশ্য যেন তেন মেয়ের সাথে ঢলাঢলি করি না।
"তাহলে বলতে চান আমার আগের তিন তিনটা সম্পর্কের কোনোটিরই যত্ন নিই নি?" মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো। "ওরা যখন যেমনটা চেয়েছে, আমার দেহমন উজাড় করে দিয়েছি। শুধু এটুকু কামনা, এই যেন শেষ হয়।"
"প্রোডাক্ট যত ব্র‍্যান্ডেরই হোক না কেন, সহজলভ্য হয়ে গেলে কারোরই কোনো আগ্রহ থাকে না। ফুটপাতের জিনিসও অনেক সময় বেশি দামে বিক্রি হয়।"
"মেয়ে বলে আমাদের প্রোডাক্ট মনে করা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটা ব্যাধি। এখন বলেন, আমার এই জিন্স- টিশার্ট আমাকে পণ্য করে তুলেছে!"
"শুনুন ম্যাডাম। আপনি রেগে যাচ্ছেন শুধু শুধু। আপনার পোষাকে আমার কোনো এলার্জি নাই। বরং, ব্যাপারটা উপভোগ্য৷ বোরখায় আচ্ছাদিত হলে, টিএসসির এই বিকেলে আমার কোন ঠেকা পড়েছে আপনার সাথে বাতচিত করার।"
"আপনার হয়তো জানা নেই, আমি চারুকলার অনেক মেধাবী ছাত্রী। থার্ড ইয়ারে থাকতেই আমার আকা ছবি কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। শুধু ভাল স্টুডেন্ট বলে আমার আগের বয়ফ্রেন্ডরা আমাকে ছেড়ে অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়েছে। আমি নাকি যেকোনো সময় তাদের ছেড়ে চলে যাবো! তারা সব সময় ইন্সিকিউরড ছিল!" মেয়েটই বললো।
"করাটাই স্বাভাবিক। এ যুগের ছেলেরা যতই ফেসবুক ব্লগে নারীর স্বাধীনতা নিয়ে ঝড় তুলুক, দিনশেষে তারা তাদের বাধ্য, ধার্মিক মেয়েদেরই লাইফপার্টনার বানাবে। আপনারা হলেন, তাদের জন্য জাসট সেক্স অবজেক্ট।"
"এটা আমাদের দেশের জন্য সত্য হয়তো৷ বাই দ্য ওয়ে, আপনি কিন্তু আমার শরীর ঘেষে বসে আছেন। অথচ আপনাকে চিনিই না!"
"আমার আরিফ। বঙ্গবাজারে আমার একটা জিন্সের দোকান আছে।" বঙ্গবাজারে, যে দোকান থেকে প্যান্ট কিনেছিলাম, ঐ দোকানের কার্ড বের করে দিলাম।
"তারমানে, আপনি বঙ্গবাজারের দোকানদার!" মেয়েটি অবাক হল।
"কেন? আমার ব্যবসা ভাল। লোক ঠকাই না। আর সমসাময়িক হাল হকিকত নিয়ে পড়াশুনা করি, ব্লগ, ফেসবুক পড়ি। এখন কি জিন্সের ব্যবসায়ী মনে করে চারুকলার ভালো ছাত্রীটি আমার সাথে কথা বলবে না?"
মেয়েটা এবার আমার আরো কাছে এসে ঘেষলো। "তোমাকে একটা কিস করতে পারি?"
এমন আকস্মিক আবদারের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না! কী বলবো?
মেয়েটা আমার গালে চুমু একে দিল। মিলন চত্তরে অনেক কাপল ইন্টিমেট হয়ে বসে আছে। মেয়েটি বললো, "আমি স্নিগ্ধা। ভার্সিটির হলে থাকি। এর আগে বয়ফ্রেন্ডদের সাথেও অনেক কিছু করেছি। জাস্ট ফ্রেন্ডরাও জড়িয়ে ধরেছে। বাট, স্বেচ্ছায় কাউকে কিস করি নি।"
"আচ্ছা! আপনি থেকে তুমিতে এত তাড়াতাড়ি নেমে এসে কিস করলে। আর কিছুক্ষন বসে থাকলে আরো কিছু হয়ে যেতে পারে! আর জিন্সের দোকানদারের জন্য সেটা অনেক বড় পাওয়া।"
"তোমার স্বপ্ন জিন্সের দোকানে সীমাবদ্ধ থাকলেও আমার স্বপ্ন, একদিন আমি প্রতিষ্ঠিত চিত্রশিল্পী হব। আমার আকা ছবির এক্সিবিহিশন হবে। দাড়াও কিছু ছবি দেখাচ্ছি।" বলেই মেয়েটি ছবি আকার খাতা বের করলো। আমার দিকে ঝুকে এসে খাতাটিকোলের উপর মেলে ধরলো।
"এগুলো পেন্সিল স্কেচ৷ এগুলো জলরং। জলের রংএ দেখো ছবিগুলোর ভিন্ন অর্থ আছে।"
এবসার্ড ছবি নিয়ে আমার আগ্রহ কম।
বললাম, "এই ছবিগুলো আমাদের দোকানের টিশার্টে ব্যবহার করলে ভাল বেচাকেনা হবে। শেয়ার বিজনেসে আসবে?"
"দূর! শিল্পের মর্যাদা তুমি বুঝবে না। তুমি লোকটা ধুরন্দর৷ সব জায়গায় ব্যবসা খোজো। নিশ্চই, বঙ্গবাজারের বন্ধুমহলে গিয়ে আমার কিস দেয়ার ঘটনা বলে ফায়দা নিবে!"
আমি হাসলাম। "এই ছবিটার অর্থ কী? সন্ধ্যায় পাখিরা নীড়ে ফিরছে। একটা পাখি দলছুট হয়ে উলটো দিকে উড়ছে।"
"এটার পিছনে বিশাল সাইকোলজি আছে।"
"শুনি কী সাইকোলজি?"
"ঢাকা শহরে কোনো মরা পাখি দেখেছো? এই যে হাজার হাজার কাক। একটা মরা কাক কোথাও দেখা যায় না কেন?"
আমি একটু ভাবলাম। "তাই তো, কেন?"
"আসলে, মৃত্যুর আগে পাখিরা নিজের শেষ পরিণতির কথা প্রাকৃতিকভাবে জানতে পারে। কিন্তু, সেটা দলের অন্য পাখিদের জানতে দিতে চায় না। মৃত্যু ঘনিয়ে আসলে তারা নির্জন কোন বন জঙ্গলের উদ্দেশ্যে উড়তে থাকে। সেখানে গিয়ে সে একাকী মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। এই পাখিটাও মৃত্যুর জন্য নির্জন এলাকার উদ্দেশ্যে ছুটে যাচ্ছে।"
একটা ছবির নিগুঢ় অর্থ এতোকিছু?
"কী ভাবছো?" মেয়েটি বললো। বলতে বলতে ব্যাগ খুলে আরো কিছু আর্ট খাতা বের করলো। খাতাগুলো আমার কোলের উপর রেখে বললো, "শেয়ার বিজনেসের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। পার্টনার হিসেবে কত পাবো?" স্নিগ্ধা মিটিমিটি হাসতে লাগলো।
"মেয়েদের পারিশ্রমিক কম। তবে, সেলের উপর টাকা পাবা।"
"আচ্ছা, দাড়াও। ব্যাগটা তোমার কাছেই রাখো। খুব ক্ষুধা লেগেছে৷ বিজনেসের অংশ হিসেবে একশো টাকা ছাড়ো। চটপটি আনি।"
আমি মানিব্যাগ থেকে একশ টাকার একটা নোট বের করলাম।
স্নিগ্ধা নোট নিতে নিতে বলল, "তোমার এটিএম কার্ডটা যে ইচ্ছাকৃতভাবে টোকেনের ঝুড়িতে ফেলেছিলে, সেটা কিন্তু আমি জানি। বলেই হেসে দিল সে। তারপর হাকীম চত্তরের ভীড়ের দিকে এগিয়ে গেল।
আমি ওর আকা ছবিগুলো উল্টিয়ে দেখছিলাম। বেশির ভাগই রূপক ছবি। একটু গভীরভাবে ভাবলে প্রত্যেকটার পিছনে একটা গল্প চলে আসবে। প্রতিটা ছবিতে কী এক গভীর বেদনা লুকিয়ে আছে। আছে চাপা অভিমান!
সন্ধ্যায় পাখি ওড়ার ছবিটাতে দেখলাম, স্নিগ্ধার স্বাক্ষর আর আজকের তারিখ দেয়া।
হঠাৎ কী মনে হল, আমি ভীড়ের মধ্যে স্নিগ্ধা নামের মেয়েটিকে খুঁজতে লাগলাম। কোথাও নেই।
ওর ব্যাগ খুজলাম। একটা খয়েরী রঙের ডায়েরী৷ সেটাতেও অনেক পেন্সিল স্কেচ।
একটা জায়গায় লেখা, " যে জীবন দোয়েলের, ফড়িং এর।"
প্রায় দুঘন্টা ওয়েট করার পরও স্নিগ্ধা ফিরে এলো না।
আমি চারুকলায় গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম। সবাই চেনে ওকে। সবথেকে অদ্ভুত কথা জানলাম, মেয়েটি গত এক মাস থেকে নিখোঁজ! ওর বাসা ধানমন্ডিতে। হলে থাকার কথাটা মিথ্যা। বাসার লোকজনও ওর খোঁজ জানে না।
...
আমার টেবিলের উপর প্রায় দুবছর ধরে মেয়েটির ডায়েরি, তিনটা আর্টের খাতা আছে। গত দুবছরে ওকে অনেক খুঁজেছি। মাঝে মাঝে মনে হয়, স্নিগ্ধা নামের মেয়েটি একদিন আমাকে ঠিকই খুঁজে বের করে ওর আঁকার খাতাগুলো নিয়ে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:৫৪
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×