জানাজা এবং দাফন শেষে ফিরতে ফিরতে রিক্সায় বসে আর মেনে নিতে পারছিলাম না লেখক, সাংবাদিক ফতেহ ওসমানীর মৃত্যুর ঘটনা। সিলেট প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ইকবাল সিদ্দিকী আর আমি এক সাথে ফিরছিলাম চৌকিদেখি থেকে। আমরা দু’জনই প্রথমে নীরব ছিলাম। ইকবাল ভাই প্রথমে নীরবতা ভাঙলেন মম ভাই অর্থাৎ দৈনিক শ্যামল সিলেটের সম্পাদক মম চৌধুরীর কৌতুকের সূত্র ধরে। জানাজা শেষে গোরস্থানে যখন দাফনের কাজ চলছিলো তখন আমি, ইকবাল সিদ্দিকী, সেলিম আউয়াল, বাসিত মুহাম্মদ সহ আরো কয়েকজ দাঁড়িয়ে ফতেহ ওসমানীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে করে আরো আক্রান্ত হচ্ছিলাম। হঠাৎ মম চৌধুরী এসে সবাই কে এই বলে হাসিয়ে দিলেন-‘আমাদের অফিসার চলে গেলেন। এখন আমরা কর্মচারীরা থেকে আর কি করবো।’ এরপর তিনি ফতেহ ওসমানীর কর্ম জীবনের কিছু মজার ঘটনা উপস্থাপন করতে থাকেন। তাঁর কথায় প্রায় ভুলে-ই গেলাম আমরা যে গোরস্থানে দাঁড়িয়ে আছি আমাদের আপনজন কে চিরবিদায় জানাতে। ইকবাল সিদ্দিকী রিক্সায় বসে মম ভাইয়ের এই কথাগুলো স্মরণ করিয়ে বললেন-‘ মমের কথা শোনে আজ তিনদিনে হাসলাম। যদিও তোমাদের মতো ফতেহ ওসমানীর সাথে আমার খুব চলা হয়নি, তবে কিছুদিন এক সাথে কাজ করেছি। প্রকৃত অর্থে সে একটা ভদ্রলোক ছিলো।’ আম্বরখানা পৌঁছার পর ইকবাল সিদ্দিকী রিক্সা থেকে নেমে সুবিদ বাজারের দিকে চলে গেলেন। আমার ইচ্ছে ছিলো বাসায় ফিরবো, কিন্তু ফতেহ ওসমানীর লাশ এসে আমাকে গ্রাস করে ফেলে। মনটা ভারি হয়ে গেলে আর বাসায় যেতে মন চাইলো না। রিক্সার ড্রাইভারকে সামনে চলতে বললাম, উদ্দেশ্যহীন।
সাংবাদিক ফতেহ ওসমানীর সাথে আমার পরিচয় আশির দশকে। তিনির সাথে আমার বয়সের ব্যবধান প্রায় ১১ বছরের। কোন পরিচয়ের যোগসূত্রে আমরা নানা-নাতি, তা জানি না। তিনি আমাকে নাতি ডাকতেন, আমি ডাকতাম নানা। এই নানা-নাতির সম্পর্কের ভেদ আমি কোনদিন ভাঙার চেষ্টা করিনি। সম্ভবত এই সম্পর্কটা গড়ে উঠেছে আমার মামাদের জন্য। ওয়াহিদ খান সম্পাদিত অধুনালুপ্ত দৈনিক জালালাবাদী এবং সাপ্তাহিক সমাচারে কর্মরত থাকাকালে তিনি বড় মামা ফরিদ আহমদ রেজা এবং ছোট মামা আহমদ ময়েজ-এর সহকর্মী ছিলেন। তাতিপাড়াস্থ পত্রিকার অফিসে আমি প্রায়-ই যেতাম ছোট মামার সাথে। আমার বয়স তখন অনুমানিক বারো কিংবা তেরো। অফিসে ডুকেই যে টেবিল ছিলো সেখানে বসতেন ছোট মামা এবং ফতেহ ওসমানী পাশাপাশি। আমি গিয়ে তাদের পাশে বসলে-ই তিনি আমাকে নিয়ে এমন কৌতুক করতেন যে, মাঝেমধ্যে আমি কষ্টে কেঁদে দিতাম। তখন তিনি আবার হেসে হেসে বলতেন-‘নাতি ডং করলাম।’ আমি তখন দরগা মাদ্রাসায় পড়তাম। তিনি এই বিষয়ে খুব-ই কটা করে আমাকে আঘাত করতেন। পরে আমি আবিস্কার করলাম এটা তাঁর বিদ্রোহ। তিনি নিজে এক সময় দরগাহ মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। চিত্রালী পত্রিকা পড়ার অপরাধে তাকে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেয়া হয়েছিলো। এরপর তিনি কিছুদিন সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। যতটুকু আমার জানা, তিনি দাখিল না দিয়ে-ই প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া ছেড়ে জ্ঞানের জগতে প্রবেশের চেষ্টা করেন। ফতেহ ওসমানী একজন ভালো পাঠক এবং লেখক ছিলেন।
গত ১৮ এপ্রিল রাতে সিলেট নগরীর শাহী ঈদগাস্থ টিবি গেট এলাকায় অজ্ঞাত দুবৃত্তদের এলোপাতারি ছুরিকাঘাতে তিনি মারাত্মক আহত হলে তাকে প্রথমে সিলেট ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করে পরে অবস্থার বেগতি দেখে ১৯ এপ্রিল ঢাকার এপোলো হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে তিনি কয়েকদিন ‘ কোমায়’ থাকার পর ২৮ এপ্রিল রাত ১১ টা ১০ মিনিটে ইন্তেকাল করেন।
সিলেটের সাংবাদিক পরিবারে ফতেহ ওসমানী একটি আলোচিত নাম। দীর্ঘদিন তিনি এই শহরে সুনামের সাথে সাংবাদিকতা করেছেন। ওয়াহিদ খান সম্পাদিত অধুনালুপ্ত দৈনিক জালালাবাদীতে যোগদানের মধ্যদিয়ে তিনি নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করে কাজ করেছেন দৈনিক জালালাবাদ, দৈনিক সবুজ সিলেট, দৈনিক বার্তাবাহক সহ বেশকিছু স্থানীয় দৈনিকে। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ২০০০-এর সিলেট প্রতিনিধি। তা ছাড়া ছড়া, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, ফিচার লিখেছেন। দীর্ঘ চার বছর ছিলেন যুক্তরাজ্যে। ‘লন্ডনের সুখ দুঃখ’ শিরোনামে একটি গবেষণা গ্রন্থ এবং ‘লন্ডন’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন প্রবাসের চার বছরের অভিজ্ঞতা থেকে। ফতেহ ওসমানীর পৈত্রিক বাড়ি সিলেট ওসমানী বিমান বন্দরের কাছাকাছি সালুটিকর বাজার সংলগ্ন নোয়াগাও গ্রামে। তবে তিনি ছোটবেলা থেকেই নগরীর চৌকিদেখির বাসিন্দা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং দুই মেয়ের জনক। মৃত্যুকালে ফতেহ ওসমানীর বয়স ছিলো ৫১ বছর। ২৯ এপ্রিল বাদ জুম্মা চৌকিদেখি মসজিদ সংলগ্ন মাঠে তাঁর জানাজা এবং সিপাহসালার নাসির উদ্দিন মাজার সংলগ্ন গোরস্থানে দাফন করা হয়। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, কাউন্সিলার কয়েস লোদী, কাউন্সিলার ফরহাদ চৌধুরী শামীম, সিলেট প্রেস কাবের নেতৃবৃন্দ, স্থানীয় এবং জাতীয় পত্রিকাগুলোর সাংবাদিক সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সহ সকল শ্রেণীর মানুষের উপস্থিতি ছিলো এই জানাজায়।
ফতেহ ওসমানীর মৃত্যুতে সবাই শোকাহত এবং সরকারের কাছে সকলের দাবী এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদেরকে খুব দ্রুতগতিতে গ্রেফতার করে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করার জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১০ রাত ১:৩১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



