somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

(যত সব হারিয়ে যাওয়া - ৩ ) রেডিও তুমি লুকিয়ে রও যেথায় আমার শৈশব........

১৮ ই মে, ২০১৪ রাত ১০:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আব্বা একটা আস্ত টু-ইন-ওয়ান কিনে এনেছে সেটা আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না । যদিও তখন আমি বয়সে যথেষ্টই বড় কিন্তু আমার মাথায় কিছু অদ্ভুত ধ্যান ধারণা ছিলো । যেমন, যাদের বাসায় টুইন ওয়ান , ফ্রিজ, রঙ্গিন টিভি থাকবে তারাই বড়লোক । আমাদের এক সাদা কালো টিভি ছাড়া আর কোনও বিলাস বস্তু ছিলো না , অদূর ভবিষ্যতে কখনও হবে এমন সম্ভবনাও দেখতাম না । সেই আমাদের বাসায় যখন আস্ত একটা ক্যাসেট প্লেয়ার চলে আসলো তখন খানিক অবিশ্বাস তো লাগছেই । তাহলে কি আমরাও বড়লোক হয়ে যাচ্ছি ?? স্পষ্ট মনে আছে আমার, একবার নিজের ঘরে যাচ্ছি আরেকবার বাহিরে ঘরে এসে দেখছি ক্যাসেট প্লেয়ারটা । হাত দিতে পারছি না, আমি বড় দুরন্ত, কিছুতে হাত দিলে সেটা নষ্ট করে ফেলি তাই আমার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, আমি টুইন ওয়ানে হাত দিতে পারবো না । মাঝে মাঝে আব্বার দিকে আর চোখে তাকাচ্ছি যদি তিনি এদিক সেদিক যান । আব্বার মধ্যে তেমন সম্ভবনা দেখা দিলো না , তিনি আজ পরিবারের সম্রাট আকবর । যেভাবে বলবেন যা বলবেন তাই হবে । মান্না দের গান শুনতে শুনতে উদাস হয়ে যাওয়া সম্রাট আকবর হঠাৎ আমাকে বললেন, ওই সুইচটা অন কর রেডিও শুনি । প্রথমবারের মতো টুইন ওয়ানে হাত দিচ্ছি, প্রায় কাঁপা কাঁপা হাতে সুইচ দিলাম । রেডিও বেজে উঠলো । কিন্তু রেডিওর সাউন্ড আমার ভালো লাগলো না । মনে হলো, আমার ঘরে ব্যাটারি চালিত যে রেডিওটা আছে সেটা অনেক ভালো । বিস্ময় হলেও সত্যি, টুইন ওয়ানের প্রতি এতো আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও ক্যাসেটের চেয়ে রেডিওই শুনতাম বেশি । রেডিওর প্রতি আমার এই যে ভালোবাসা তা কোনওদিনই ফুরিয়ে যায়নি ।



স্মৃতি থেকে লিখছি বলে অনেক তথ্য ভুল হতে পারে । সবকিছু স্পষ্ট মনেও নেই । যেমন মনে নেই প্রথম কবে রেডিও শুনি আমি । তবে মনে আছে কেয়ামত থেকে কেয়ামত সিনেমার অ্যাড শুনে উদাস হয়ে গেছিলাম । মানছি আমি সবসময়ই ইঁচড়ে পাকা ছিলাম কিন্তু আমার উদাস হওয়ার পিছনে গাজী মাঝহারুল আনোয়ার সাহেবের ভূমিকাও কম না । সত্যি কথা বলতে কি, যে গাজী মাঝহারুল আনোয়ারের করা বিজ্ঞাপন শোনেনি তার জীবনই বৃথা । পৃথিবীর আর কথাও এমন ১০ মিনিট ধরে সিনেমার অ্যাড হয় কিনা আমার জানা নেই, যদি হয়ও তবুও সেইসব অ্যাড সংরক্ষিত রাখা উচিৎ । কি যে উত্তেজনা জাগানিয়া সেই অ্যাডের ভাষা , কি যে চমৎকার বর্ণনায় ক্লাইমেক্স তৈরি করা । মাদক পাচারকারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রুবেল গান গাচ্ছে “আমি ডন আমি ডন” , মিথ্যে মামলায় কারাগারে বন্দী জসিম, সব ছোট ভাই বোন ভুল বুঝে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে মায়ের মতো মমতাময়ি শাবানাকে কিংবা মৌসুমির হাতে একশোটি চাবুকের মার খেয়ে ওমর সানীর অমর সংলাপ “ মেমসাহেব, আমরা গরীব হতে পারি ...”, এর পরেই গাজী সাহেবের অনুকরণ অযোগ্য ভঙ্গিতে, “এরপরররর, এরপরররর কি হবে??” এরপরে কি হবে জানার জন্য যেতে হবে আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রেক্ষাগৃহে ! প্রেক্ষাগৃহে না গেলেও তখনকার সব গান ছিলো ঠোঁটে । আমার জীবনের প্রথম হিট গান সম্ভবত আশিক প্রিয়া সিনেমার, আমি আশিক তুমি প্রিয়া । এই গানটা দিয়ে আমাদের এক স্কুল বন্ধুর জীবন অতিষ্ঠ করে ছেড়ে ছিলাম আমরা । তবে চটুল গান না, আমার সবধরনের গান শুনতেই ভালো লাগতো । সারাক্ষণ গান শোনার কারনেই সম্ভবত আনড্রু কিশোর, সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সুবির নন্দি, আবদুল হাদি, বশির আহমেদ, শাম্মি আক্তার, আবিদা সুলতানা, মাহমুদুন নবী, সামিনা চৌধুরী, রিজিয়া পারভিন এমনকি জাফর ইকবালের গলাও চিনে ফেলতাম মুহূর্তেই । ভালো লাগতো “অনুরোধের আসর গানের ডালি” । পচা লাগতো আধুনিক গানের আসর গিতালি, মনে হয় আধুনিক গান আমার তেমন পছন্দ ছিলো না । প্রতি শনি আর মঙ্গলবার হতো স্রোতাদের পাঠানো প্রশ্নের উত্তর নিয়ে অনুষ্ঠান বিনিময় । বিনিময় শুনতে শুনতে রেডিও বিষয়ে এতো বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছিলাম যে রেডিও নিয়ে যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম । আমার ভালো লাগতো উপস্থাপকদের শুদ্ধ উচ্চারণ আর নিখুঁত বাচনভঙ্গী , কত যে চেষ্টা করেছি তাদের মতো করে কথা বলতে । রেডিওর বাণিজ্যিক কার্যক্রমে বিভিন্ন পণ্যের অ্যাড হতো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে । যেমন, হেনলাক্স সুর মাধুরী বা নাবিস্ক সুর লহরী । আমি কোনওকিছুই বাদ দিতাম না । সারাক্ষণ আমার কানের কাছে রেডিও বাজতো । আম্মা যাতে টের না পায় তাই বালিশের তলায় রেডিও রেখে কোনোমতে শোনার চেষ্টা করতাম । মনে আছে দুপুরবেলা আমি বালিশ নিতাম না । রেডিওটাকে বালিশ হিসেবে ব্যবহার করতাম আর জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে যেতাম। একদিন এমন নির্জন দুপুরবেলা কানের নীচে রেডিও রেখে আকাশে সাদা সাদা মেঘ দেখতে দেখতে কেমন জানি বুকের ভিতরে ফাঁকা হয়ে গেলো । এরপরেই আমি আমার প্রথম কবিতাটা লিখি, আকাশ এতো নীল কেনও, আমি তখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি । সারাক্ষণ রেডিও নিয়ে পড়ে থাকতাম বলে কোনও অনুষ্ঠান আমার মিস যেতো না । সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান দুর্বার শুরুর আগে যে মিউজিকটা বাজত সেটা শুনেই বুকের ভিতরে রক্ত ছলকে উঠতো । কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে মনে হতো আমার তো আসলে কৃষক হওয়ার কথা, আমি বই খাতা নেড়ে ঘেঁটে কি করছি । নিশুতি নামের অনুষ্ঠান চলতো গভীর রাত পর্যন্ত , ততক্ষণ জেগে থাকতে পারতাম না, এতো নিশাচর হইনি তখনও । আমি এমনকি নিরক্ষরদের অক্ষর জ্ঞান দেওয়া নিয়ে একটা অনুষ্ঠান হতো সেটাও শুনতাম । কারণটা অবশ্য অন্য, অনুষ্ঠানের শেষে একটা নাটক হতো সেটা শোনার জন্য । আহ নাটক । রেডিওর নাটকের মতো প্রিয় আমার আর কিছু ছিলো না । রাজশাহী আর খুলনা স্টেশনে নাটক হতো শুক্রবার ২.৩০ এ । দুইটা একই সময়ে হতো বলে বিরক্ত হতাম । কোনটা ছেড়ে কোনটা শুনি । আর ৩.০৫ শুরু হতো ঢাকা খ তে । নামাজ থেকে ফিরে কোনওমতে দুই চারটা ভাত মুখে দিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়তাম রেডিও নিয়ে । রাজশাহী আর খুলনা চানেলে সাধারণত লোককাহিনী নির্ভর নাটকই হতো । আর ঢাকায় হতো মৌলিক সব নাটক । কখনও কখনও বিদেশি নাটকের অনুবাদও । মাঝে মাঝে টিভির শিল্পীরাও অভিনয় করতেন । কি যে চমৎকার ছিলো একেকটা নাটক । সংলাপ শুনে শুনে দৃশ্য কল্পনার ব্যাপারটাও কম মজার ছিলো না । তারপর একদিন বিনা মেঘেই বজ্রপাত । নষ্ট হয়ে গেলো রেডিও । আব্বা আর কিছুতেই রেডিও ঠিক করবে না । টুইন ওয়ান আছে রেডিওর কি দরকার ! আরও বেশ কিছুদিন পর আমাদের পুরো পরিবারকে হতভম্ব করে আব্বা একটা রঙ্গিন টিভি কিনে ফেললেন । বিটিভি আর একুশে টিভি দুইটা চানেলেই গ্রাস করে নিলো আমাদের । রঙ্গিন বিনোদনের হাতছানিতে হারিয়ে গেলো রেডিও, আমার প্রিয় রেডিওটা ।



রেডিও শুনি না প্রায় ১৫/১৬ বছর । এর মাঝে কত কিছুই বদলে গেছে । আগের সরকারি চ্যানেলগুলো পিছনে ফেলে উঠে এসেছে এফএম রেডিও । গানের ডালি, দুর্জয়, বিনিময়ের জায়গায় ভুত এফএম, লাভ গুরু আরও কত কি । দুঃখিত আমি নাম জানি এফএম এর অনুষ্ঠানগুলোর, কারণ আমি কখনই শুনিনি । আগ্রহওবোধ করিনি । যে দুই তিনবার শুনতে গেছি ততোবারই আমার পুরনো স্মৃতির সাথে মেলাতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছি । হয়তো আমি খ্যাত টাইপের, নতুন কিছু গ্রহনের চেয়ে শুদ্ধতার দিকেই আমার বেশি আগ্রহ । কিংবা রেডিওর প্রতি তীব্র যে আবেগ তাতে ধুলো পড়তে দিতে চাইনি বলে এফএম আমার শোনা হয়নি । কিন্তু পুরনো সেই চ্যানেলগুলোর কাছেও আর ফিরে যাওয়া হয়নি । কেনই বা যাবো এখন তো আর বিনোদনের অভাব নেই , নিত্য নতুন নিয়ত পরিবর্তনশীল । নিম্ন মধ্যবিত্তের সেই রোমাঞ্চ যদিও আর কিছুতেই নেই তবুও । জানি, আম্মা আজও তার আলমারির এক কোনে রেডিওটা রেখে দিয়েছে তার টানাটানির সংসারের স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে । অথচ গত পনেরো ষোল বছরে একবারও বের করে দেখা হয়নি সেটা । না হোক । কিছু স্মৃতি নাহয় জমে থাক খুব গোপনে । কিছু অলৌকিক অনুভব ভালো থাকুক হৃদয়ের গহীনে ।

বাকের ভাইদের জন্য এলিজি (যত সব হারিয়ে যাওয়া – ১)

ডাকপিয়ন, কবে তোমার ছুটি ?? ( যত সব হারিয়ে যাওয়া -২ )

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১৪ রাত ১০:৪২
১৯টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×