"আচ্ছা মেঘ গুলো সব গেলো কোথায় ?" বললে ল্যুবেশকা। ঘাসের ওপর শুয়ে শুয়ে সে নীল আগুনে পোড়া আকাশটাকে দেখছিল। পরিষ্কার ফাঁকা আকাশ।শুধু ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে একটা তপ্ত গোলক -- সূর্য। আজ দুদিন ধরে এই চোখ ধাঁধানো গোলকটায় মেঘের ছায়া পড়ে নি।
গুমোট। গরম। তপ্ত হাওয়ায় তালু জ্বলে যায়। পুড়ছে , পুড়ছে , ফ্যাকাশে নীল আগুনে পুড়ছে উঁচু আকাশটা। পুড়ছে একদিন,দুদিন , সপ্তাহ, দুসপ্তাহ। সাদা মেঘ গুলো যেন দানা বাঁধতে না বাঁধতেই সে আগুনে বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে।
'অমন মনমরা কেন ওগুলো , অমন চুপচাপ ?' বললে ক্ষেতের গম শীষ গুলোকে লক্ষ্য করে। গমগাছ গুলো দাঁড়িয়ে আছে একেবারে নিশ্চল। গম , ঘাস , গাছপালা --- সবকিছুই। এতটুকু খসখসানি নেই।
'হবে না মনমরা !' পাশ দিয়ে যাচ্ছিল শূরা মাসি , আমার হয়ে জবাব দিলে , ' ঘাস গুলো যে নিঃশ্বাস নিতেই পারছে না, শুকিয়ে মরবে। '
'ঘাসে আমার নিঃশ্বাস নেয় নাকি?'
‘নেয় বৈকি, ' বললাম আমি। ল্যুবশকা ঘাসের উপর কান পেতে শুনল:
'উঁহুঁ , শুনতে পাচ্ছি না তো। '
আমি বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে, এখানে বড় গোলমাল : মুরগি ডাকছে, ঘেউ ঘেউ করছে কুকুর , কাঠ ফাড়ছে লোকে , এখানে কি শোনা যায় ? শুনতে হলে যেতে হবে দূর ঘাসে -ভরা মাঠে।
তবে ব্যাখ্যাটা ল্যুবেশকা মনে ধরল না। তক্ষুনি ছুটে গিয়ে বিনা গোলমেলে ঘাসের নিঃশ্বাস শোনার ইচ্ছে হল তার।
ভারি এক ফ্যাসাদ বাধালে শূরা মাসি। খেতে আরো গরম, একটু ছায়া নেই গা বাঁচাবার।
আকাশ এখানে আরো বড় আরো উঁচু। শুরু হয়েছে একেবারে টিলে গুলো থেকে, কোথাও আড়াল পড়ে নি। শুধু আকাশ আর মাঠ। তাছাড়া ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ওই হাঁটা পথটা। বাস্। ওপরে আকাশ , আর নিচে ক্ষেত আর আমরা , চলেছি হাঁটতে হাঁটতে।
ট্রাক্টরের ঘড়ঘড় শোনা গেলো। খেতের ওদিক থেকে ধুলোর মেঘ উঠল। হাঁটা পথটাতেও পুরু হয়ে জমেছে ধুলো। কাছের গমগাছ গুলো যেন ছাই-মাখা।
পাকন্ত গাছগুলো যেন মূর্ছা গেছে ; একটা শীষও কাঁপছে না, একটা পাতাতেও সরসরানি নেই। বোবা। কালা। আধা-ঘুমে কিসের যেন হাপিত্যেশ। খরা। গুমোট।
-----
'কী চাইছে ওরা ?' ল্যুবাশকা জিজ্ঞেস করলে গম গুলোর কথা।
'বৃষ্টি চাইছে। তোর তেষ্টা পেয়েছে তো? '
' হ্যাঁ পেয়েছে। '
' দ্যাখ তবে , অথচ জল খেয়েছিস মাত্র ঘন্টা খানেক আগে। দু'হপ্তা বৃষ্টি হয় নি , ওদেরও তেষ্টা পায় তো। '
'কিন্তু ওদের তো প্রাণ নেই। '
' আছে বইকি। ওই গম গাছগুলো , এই ঘাস , এই ফুলটা , ওই বার্চ গাছ টা , সবারই প্রাণ আছে। নিঃশ্বাস নেয় , মাটি থেকে রস খায় , রোদ খায়।
' কিন্তু এখানেও নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে না কেন?' ফের জিজ্ঞেস করলে ল্যুবাশকা।
উত্তর দেয়ার ফুরসুত হলো না। বনের ওপারে গর্জন করে উঠলো যেন মস্ত এক কামান দেগেছে। খেতের ওপর দিয়ে বহুদূর গড়িয়ে গড়িয়ে গেলো মেঘের গুড়গুড়। বনের ওপরকার আকাশটা হয়ে উঠল ঘোলাটে , আর তার ফ্যাকাশে নীলের ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এলো ঘন কালো মেঘ।
মেঘ ডাকলো আরও অনেক বার। রুপোর খড়গ দিয়ে যেন কেউ বাঁকা কোপ মেরে চলেছে। কিন্তু কাটতে পারছে না। ধীরে ধীরে কেবলই উঠে আসছে মেঘ। উঁচুতে , আরো উঁচুতে। ঢেকে ফেললে আধখানা আকাশ , ঢাকা পড়লো সূর্য। জ্বলজ্বলে রোদের জায়গায় হঠাৎ যেন গোধূলি নেমেছে। গুমোট , আগের চেয়েও যেন বেশি গুমোট।
চারিদিককার এই হঠাৎ-বদলটা চুপ করে দেখছিলাম আমরা। অন্য সবকিছুও আমাদের মতোই চুপচাপ। যেন লুকিয়ে পড়েছে , নিথর হয়ে গেছে একটা মস্তো ঘটনার সামনে।
আবার বাজ ডাকল, রুপোর বাঁকা খড়গে ফুলে ওঠা মেঘের ওপর কোপ পড়ল আবার।
এবার কিন্তু ফেটে গেলো মেঘ। সেই ফাটল দিয়ে বৃষ্টি নামল ঘুঘুরঙা ধারায়। একটা বার্চগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা , হঠাৎ তার ডালপালায় দমকা হাওয়ার দোল উঠল। বৃষ্টি ঝেঁপে এল এখানেও , ঘা দিলে পাতায় পাতায়। আনন্দে থরথরিয়ে উঠল গাছটা, প্রতিটি পাতায় যেন জলের ফোঁটাটুকুর জন্য অস্থির।
' যেন হাসছে !' বার্চগাছটার কথা বললে ল্যুবাশকা , ' কিসের আনন্দে ? বৃষ্টির জন্যে ?'
'দ্যাখ্ , গাছ গুলোও একেবারে তাজা হয়ে উঠেছে। '
বাতাসে দোল খাচ্ছে শীষ , খেতময় ঢেউ। বৃষ্টিও আসছিলো ঘনঘন। এই সামনে খেতের ওপর দেখা গেল ঘুঘুরঙা বাঁকা ধারা , হঠাৎ তা ধেয়ে আসতে লাগল আমাদের দিকে। আসছে , আসছে , এসে গেল গাছের মাথায়। ভেজা পাতায় জল আর আটকালো না , অঝোরে ঝরে পড়ল আমাদের খোলা মাথায় , কাঁধে।
মাথা আর ভেজা মুখখানায় হাত বুলাল ল্যুবাশকা।
'আহ!'
'চমৎকার!'
আমি ওর হাত ধরে সোজাসুজি এগিয়ে এলাম বৃষ্টির মধ্যে। ওম-ওম বৃষ্টি , জলে ধুয়ে যাচ্ছে রোদপোড়া মুখ, কি ভালোই না লাগছে, চারপাশের সব কিছু হয়ে উঠছে তাজা, রসালো , জ্বলজ্বলে , যেন নতুন করে জন্ম হল। আর খালি পায়ে নরম ভেজা মাটির ওপর দিয়ে , টাপুর-টুপুর জমা জলগুলোর উপর দিয়ে হাঁটতেও আনন্দ। জোরে জোরে ছপ ছপ করতে লাগলাম আমরা , ভিজে যাওয়ার ভয় তো আর নেই , কিছুরই ভয় নেই।
এক দুই , ছপ, ছপ, ছপ, ছপ !
হেসে উঠলাম আমার , কে জানে কেন। অনেকদিন এমন খুশি লাগে নি।
'আয় বৃষ্টি ঝেঁপে!'
আয় বৃষ্টি আয় ! আরো ঝেঁপে , আরো ঝেঁপে ! ঢাল , কেপটামি করিস নে। মাটি আর তার গাছপালা সবার তেষ্টা মিটুক।
হটাৎ বৃষ্টির ধারা কমে এল , ঝিমিয়ে এল। ঘেসো মাঠটায় যখন গিয়ে পৌঁছলাম , তখন একেবারেই থেমে গেছে। আবছা ঝিকঝিক করছে মাঠটা , জলে ধোয়া ফুলগুলোর ওপর , জ্বলজ্বলে সবুজ গাছগুলোর ওপর হালকা ভাপ ভাসছে।
বসলাম গিয়ে মাঠটার একেবারে ধারে , ল্যুবাশকা তো আবার শুয়েই পড়লে ,কান পাতলে ভেজা ঘাসের ওপর। সে তো করবেই। কারো যদি কিছু জানবার ইচ্ছা হয় , সে তো তখন তাই নিয়েই দিনরাত ভাববে , সাতবার জিজ্ঞেস করবে। বোঝাই যাচ্ছে , কী করে ঘাস বাড়ে তা শোনার অসম্ভব ইচ্ছে হয়েছে ল্যুবাশকার।
জলের ভারে ডগমগ করে উঠলো ঘাস-ফুল গুলো , নিজেদের পেয়ালা আর কলসি উপচানো বাড়তি জলটুকুও প্রাণে ধরে ছাড়তে চাইছে না। ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে , ঘাস পড়ছে নুয়ে , হয়তো এক পলক রইলো তার পাতার ওপর , আস্তে করে কেঁপে উঠলো ঘাস। প্রায় চোখেই পড়ে না ঘাস গুলোর তিরতিরানি। কে জানে তার কারণ কী , হয়তো জল পেয়ে তাজা হয়ে উঠেছে শিকড়গুলো , জলের ফোঁটা গুলো শুষে নিচ্ছে , শুষছে , শুষছে, তেষ্টা আর মিটছে না।
'শুনতে পাচ্ছি !' বললে ল্যুবাশকা। বললে না, আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল।
আবছা ঝিকমিকে মাঠটার দিকে চেয়ে তন্ময় হয়ে ছিলাম , চট করে ধরতে পারলাম না ও কি বলছে।
' শুনছি , ঘাস বাড়ছে!'
আমিও কান পাতলাম মাটিতে , সত্যিই ভারি আবছা নরম , প্রায় ধরা যায় না কী সব শব্দ। হয়ত ঘাসের ওপর জলের ফোঁটার শব্দ। হয়ত ফুলগুলোর শেকড়ে জল টানার শোঁ শোঁ।
নাকি --- হ্যাঁ , হ্যাঁ , সত্যিই হয়ত ল্যুবাশকা আর আমি শুনেছি বৃষ্টির পরে তাজা ঘাস কী ভাবে বাড়ে!...
বৃষ্টি থেমে ছিল কেবল কিছুক্ষণ। বনের ওপর থেকে আবার এগিয়ে এল ঘুঘুরঙা বৃষ্টির ধারা , মাঠের ওপর দিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল সোজা আমাদের দিকে।
উঠে দাঁড়ালাম আমরা , এগিয়ে গেলাম বৃষ্টির দিকে। ফের ভারি ইচ্ছে হচ্ছিল হাতের ওপর , মুখের ওপর বৃষ্টির স্নিগ্ধ ছোঁয়া নিই। আর বৃষ্টি যখন একেবারেই এসে পড়ল ,
তখন গেয়ে উঠলাম :
' আয় বৃষ্টি ঝেঁপে!'
এখন আর মনে নেই আরো কী কী গেয়েছিলাম। এইটুকু শুধু মনে আছে যে খুশি লেগেছিল ।লাগবে না আবার ! আমরা যে শুনেছি কী ভাবে ঘাস বাড়ে। আমরা যে দেখেছি কী ভাবে চোখের সামনে চারিদিকটা জীবন্ত আর নতুন হয়ে ওঠে।
-------------------------------------------------------------শেষ--------------------------------------------------------------
গল্পের নাম : শুনছি , ঘাস বাড়ছে...
বই : বৃষ্টি আর নক্ষত্র
লেখক : সেমিওন শুরতাকভ
অনুবাদ : ননী ভৌমিক (রাশিয়ান বই আর প্রিয় ননী ভৌমিকের কাছে আমার শৈশব চিরঋণী !)
***ছোটবেলায় ভেবেছিলাম, গল্পের চরিত্র গুলো করা ? গল্প বলছেই বা কে ?
পাদটীকাঃ
-----------------------------------------
বৃষ্টি আর নক্ষত্র - নামের শৈশবের একটা রাশিয়ান বইয়ের একটা গল্প - শুনছি , ঘাস বাড়ছে...! মাঝে মাঝে শৈশবের সেই রাশিয়ান বইগুলো বুকের মাঝখান থেকে আচমকা বের হয়ে আসতে চায় লেখায়। খুব ছোটবেলায় যখন আব্বা আমাকে বই পড়ে শোনাতেন , যখন আমি বানান করেও পড়তে পারতাম না , যখন আমি স্কুলেও যেতাম না -- তখন থেকেই রাশিয়ান বইগুলো আবার সাথেই আছে। তাই সেই 'ছোটমানুষের ' বইগুলোকে মাঝে মাঝে আমি শৈশবের স্কুল বলে ডাকি !
ছবিঃ https://sovietbooksinbengali.blogspot.com/ (রাশিয়ান শৈশবের সম্ভার!)
আরো সোভিয়েত শৈশব :
১। সাত বন্ধু ইয়ুসিকের - ( আমার সোভিয়েত শৈশব )
২।রূপের ডালি খেলা - (আমার সোভিয়েত শৈশব)
৩। জ্যান্ত টুপি (আমার সোভিয়েত শৈশব)
৪।সভ্য হওয়া - (আমার সোভিয়েত শৈশব)
৫। মালপত্র (আমার সোভিয়েত শৈশব)
৬।শেয়ালের চালাকি ১ (আমার সোভিয়েত শৈশব)
৭।মোরগ ভাইটি (আমার সোভিয়েত শৈশব)
৮।বীরব্রতী ভাসিয়া -- আমার সোভিয়েত শৈশব (আমার শৈশবের স্কুল !)
৯। আমার সোভিয়েত শৈশব - আমার শৈশবের স্কুল !
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০২২ বিকাল ৫:১৮