বিশাল পরিবর্তন হয়ে গেল বছর ২০২০ জুড়ে। সক্কালবেলা উঠে তাড়াহুড়া করে রাস্তায় নামা। বিশাল ট্রাফিক জ্যাম তখন রাস্তা জুড়ে। সক্কলে কাজে যাওয়ার জন্য রাস্তায় নেমেছে। বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে। ছোট যে বাচ্চাটা স্কুল শুরু করেনি তাকেও টেনে উঠিয়ে নিয়েছে মা। নামিয়ে দিবে সারাদিনের জন্য ডে কেয়ারে। তারপর নিজের কাজে যাওয়া।
যেতে যেতে টিমহর্টন, স্টার বাক্সের ড্রাইভ থ্রু তে লম্বা লাইনে দাঁড়ানো। কফি আর মাফিন বা ব্যাগল, স্যান্ডউইস তুলে নেয়া। চুমুক দিতে দিতে পথ চলা। অস্থিরতা আর ব্যস্ততায় শুরু হয় দিন।
কারো বা সকালে খেতে ভালোলাগে না। তারা বারোটা বাজলে লাঞ্চ আওয়ারে এক্কেবারে ব্রাঞ্চ করে নেয় ভালো মতন। বন্ধু, কলিগদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে। অফিস শেষ হতেই আবার ছোটা ব্যাস্ততায় জ্যাম ঠেলে। পথে বাচ্চা উঠানো, বাজার করা। বাড়ি ফিরে রান্না খাওয়া টাইডি আপ সেরে দিনের শেষে স্বস্থির নিঃশ্বাস নেয়া। সেই অন্ধকার সময়ে চোখের পাতা খুলতে না চাইলেও এর্লামের শব্দের সাথে সাথে জোড় করে উঠাতে হয় শরীর বিছানা থেকে। ইচ্ছা না করলেও আরেকটু সময় শুয়ে থাকার উপায় নেই। তাহলে সব কিছুতে লেট হবে। আর সব জায়গায় চলবে দেরী হওয়ার খেসারত দেয়া আর জবাবদিহীতা।
এমন সময়ের সাথে পা ফেলে দ্রুত চলায়, অভ্যস্থ মানুষ কেমন থমকে গেলো ঘরে থাকার হুকুম পালন করতে গিয়ে এবছর। ঘর থেকে বেরুনো যাবে না। শুধু ঘরে থাকো লকডাউনে, কাজ বন্ধ প্রথমে।
তারপর কারো অফিস জানাল কাজ চলবে, ঘরে বসেই কাজ করো।
ঘরের সেট আপ সাজানো হলো নতুন করে । এক কোনায়, ডাইনিং টেবিলে বা একটা ঘর করে নেয়া হলো অফিস করার জায়গা। প্রথম প্রথম খুব অস্বস্থি হলেও বেশ ভালোলাগতে শুরু হলো এই ব্যবস্থা অনেকের কাছে। সকালে উঠে দৌড়াতে হয় না। টিপটপ তৈরি হওয়া নেই। ঘরে বসেই অফিসের কাজ গুলো করা যাচ্ছে কম্পিউটারে। কাপড় পরিপাটি করে পরা, ইস্ত্রি করার ঝামেলা নেই, ঘরের পাজামা পরেই কাজ করার সহজ স্বস্থি। কখনো অফিসের মিটিং থাকলে পাজামার উপরে একটা সার্ট বা টপ পরে ক্যামেরা অন করলেই হয়।
অফিসের মালিক পক্ষও ভাবতে শুরু করলেন বেশ তো ভালো। ঘরে বসেই কাজ হচ্ছে যখন তবে এত ব্যয় করে অফিস রাখার কি প্রয়োজন। অনেকেই অফিস রাখার ব্যয় কমানোর কথা ভাবতে শুরু করেছেন ।
কর্মীরাও ভাবছে এই আরাম ঘরে বসে কাজ। যাতায়াতের খরচ এবং সময় সব বাঁচে। মাঝে মধ্যে ঘরের মানুষের সাথেও সময় ব্যয় করা যাচ্ছে। ইচ্ছে হলে নিজে বানিয়ে টাটকা খাবার খাওয়া যাচ্ছে। ফাস্ট ফুড বা রেস্তুরায় যেতে হচ্ছে না দুুরের লাঞ্চ সারতে। ডার্লিং, সন্তান সবার সাথে মাঝে মধ্যে সারাদিন ধরেই দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে। পারিবারিক জীবনটা মধুময় হচ্ছে।
বেশ ক'বছর আগে একটা গবেষণা হয়েছিল, একজন তরুণ যেসব কারখানা দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা ধরে চলে তেমন কিছু অফিসের কর্মিদের কাজের সময় সীমার সেটআপ বদল করে দিয়েছিলেন। তাদের পছন্দের সময়ে কাজে আসতে দিয়ে। যারা সকালে উঠে কাজ করতে পছন্দ করেন তারা সকালে অফিসে আসবে। যারা দেরিতে উঠতে পছন্দ করে তারা দেরিতে আসবে। যারা রাতে জাগতে পছন্দ করে তারা রাতে আসবে। এমন প্রত্যেক কর্মির পছন্দের সময়ে কাজে আসার ব্যবস্থা করে দেওয়ার পর দেখা গেল উৎপাদন বেড়ে গেছে। কাজ খুব ভালো হচ্ছে।
তখন থেকে তারা এই অফিসের আটটা পাঁচটার নিয়ম বদল করার চেষ্টা করছিল। প্রত্যেক মানুষের দেহ ঘড়ি তার নিজস্ব নিয়মে চলে। অথচ নাগরিক জীবনে আমরা সবাইকে একই ভাবে চালাতে চাই। সকালে উঠো তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাও। এটা খুব প্রচলিত কথা । সবাই মনে করেন এই নিয়ম মেনে চললেই জীবনে সব চেয়ে ভালো কাজটি করা যায় কিন্তু সবার জন্য এই তথ্য সঠিক না। কেউ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে পছন্দ করলেও কেউ সকালবেলা ঘুমাতে পছন্দ করেন। তাদের শরীরের চক্রটি সে ভাবেই ঠিক করা। তারা যে সারা রাত জেগে থাকেন, সেটা ভোরে উঠা মানুষরা সহ্য করতে পারেন না। অনেকটা আস্তিক মানুষরে নাস্তিকদের সহ্য করতে না পারার মতন।
আসলে প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব শারীরিক নিয়ম চাহিদা আছে। তাদের সে ভাবে চলতে দিলে তারা অনেক ভালো কাজ করতে পারেন। জোড় করে অন্য সময়ে ভালো কাজ করানো তাদের দিয়ে সম্ভব না।
আমার একজন বন্ধু, সব সময় আমাকে সকালে তার সাথে দেখা করতে বলত। কিন্তু আমি কিছুতেই সকালের সিডিউল নিতাম না। কারণ সকাল আমার ঘুমে কাটবে। তারপর আস্তে ধীরে উঠে দুপুরে আমি বেরুব।
আথচ আমার বন্ধুটি অন্ধকার থাকতে উঠে ঘরদোর পরিস্কার করতে লেগে যাবে। তারপর সকালের কাজে বেরিয়ে পরবে।
আমার মনে পরে যায় একটা বাসায় থাকতাম প্রতিদিন উপরতলা থেকে ভোরবেলা এত্ত আওয়াজ আসত বিছানায় শুয়ে আমার মেজাজ খারাপ হতো। অথচ উপরতলার সকালে উঠা মানুষটি জানত না, সারারাত আমি কতটা কাজ করে ভোরবেলা শুতে গিয়েছি।
এবারের এই পরিবর্তনে অফিসপাড়ার চেহারা হয়তো অনেকটা বদলে যাবে। অনেক অফিস স্বাভাবিক অবস্থায় হয়তো আর সাজানো অফিস সেট আপে ফিরবে না। কর্মিদের ঘরে বসেই কাজ করতে দিবে।
এই যে খাখা করছে বিশাল অফিস পাড়া, স্কুল, চিকিৎসা কেন্দ্র গুলি এখন। যেখানে ভোর থেকেই লেগে যেত মানুষের ভীড়। সেখানে মানুষ নেই কিন্তু কাজ থেমে নাই বিক্ল্প উপায়ে কাজ ঠিক চলছে। আর বাড়ি গুলো পরে থাকত একা। মানুষ বাড়ি ফিরত শুধু রাতে ঘুমানোর জন্য। এখন মানুষ বাড়িতে থাকা উপভোগ করছে। নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক, কাছে থাকা বাড়ছে। হোম অফিস কার কাছে কেমন লাগছে । আমার তো বেশ লাগছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ২:৫৪