বাংলার ফতোয়াবাজরা আবারও পরাজিত হয়েছে
সাইয়িদ রফিকুল হক
বাংলাদেশে কতরকমের ফতোয়াবাজ রয়েছে। হিসাব করতে গেলে কম্বলের লোম-বাছার মতো অবস্থা হবে। প্রায় প্রতিটি কাটমোল্লাই এখন ফতোয়াবাজিতে লিপ্ত। এতে এদের কামইরোজগার হয় ভালো। শানশওকতও বাড়ে খানিকটা। এজন্য তাদের ফতোয়াবাজি থেমে নেই। বরং তারা আগের চেয়ে আরও জোরেশোরে তাদের মনগড়া ফতোয়াবাজিতে লিপ্ত হচ্ছে। আর তারা কথায়-কথায় অমুক-তমুক হারাম-হারাম বলে চেঁচামেচি করছে।
সেই ব্রিটিশ আমল থেকে তাদের এই অপকাণ্ড চলে আসছে। পাকিস্তানি আমলেও তারা জোরেশোরে ফতোয়াবাজি করেছে। তখন তারা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে, বাঙালি-জাতির বিরুদ্ধে, বাঙালির স্বপ্নদ্রষ্টা নেতাদের বিরুদ্ধে, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে, মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সীমাহীন ফতোয়াবাজি করেছে। শুধু তাই নয়, একাত্তরে নিজদেশের মা-বোনদের পাকিস্তানি জানোয়ারদের হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষেও নির্লজ্জভাবে ফতোয়াবাজি করেছে। আর আমাদের দেশের মা-বোনদের পাকিস্তানিদের ভোগ্যপণ্য হিসাবে আখ্যায়িত করার জন্য তারা ইসলামের দোহাই দিয়ে ফতোয়াবাজি করেছিল। সেই সময় তারা দেশের মা-বোনদের ‘মালে গনিমত’ বা ‘গনিমতের মাল’ বলে অভিহিত করেছিল!
এরা প্রতিনিয়ত নিজেদের স্বার্থের জন্য ফতোয়াবাজি করে থাকে। আজ পর্যন্ত দেখিনি-শুনিনি এরা ইসলামধর্মের ও দেশের জন্য কোনো ভালো কাজ করেছে। কিন্তু দেশ, জাতি, মানুষ, মানবতা ও ধর্মের ক্ষতি করার জন্য এদের ফতোয়াবাজি চলছে সমানতালে।
পৃথিবীতে ৩৬৫ দিন পর নতুন একটি বছরের আগমন ঘটে। নতুন বছর বা নববর্ষপালনের এই ঘটনা বিভিন্ন দেশের মানুষজনের কাছে নতুন কোনোকিছু নয়। আদিকাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নববর্ষপালনের রেওয়াজ রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী তাদের দেশীয় নববর্ষপালনের পাশাপাশি খ্রিস্টিয় নববর্ষও পালন করে থাকে। ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা হওয়ার সুবাদেই খ্রিস্টিয় নববর্ষের ব্যাপক প্রচলন হয়েছে। তবে পৃথিবীতে আধুনিককালে নববর্ষপালনের ব্যাপক জাঁকজমক লক্ষ করা যায়। কিন্তু একটি প্রতিক্রিয়াশীলচক্র সবসময় এর বিরুদ্ধাচরণ করছে। আর এক্ষেত্রে তারা ইসলামের দোহাই দিয়ে তাদের এই বিরোধিতাকে আরও সামনে আনার চেষ্টা করছে। এভাবে তারা বাংলা ও খ্রিস্টিয় নববর্ষ আসার আগে থেকে এর বিরুদ্ধে জোরেশোরে ফতোয়াবাজি শুরু করে দেয়। বিশেষত এরা বাংলা-নববর্ষের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এটাকে তারা ‘জিহাদ’ হিসাবে গ্রহণ করে থাকে। তবুও বাংলার মানুষ তাদের বিষোদগারকে পদদলিত করে ‘বাংলা-নববর্ষ পালন করে থাকে। মদীয় নিবন্ধের বিষয় এটি নয়। মদীয় আলোচ্য বিষয় হলো বাংলাদেশে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের খ্রিস্টিয় নববর্ষপালনের ঘটনাক্রম।
খ্রিস্টিয় নববর্ষ (আমাদের দেশের মানুষ যাকে ভুলবশত ‘ইংরেজি-নববর্ষ’ বলে থাকে) এটি পালনের রেওয়াজও আমাদের দেশে নতুনকিছু নয়। পাকিস্তান-আমলেও এটি হয়েছে। আর বর্তমানেও হচ্ছে। কিন্তু, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বর্তমানে নববর্ষপালনের ক্ষেত্রে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সাধারণ মানুষ ফতোয়াবাজির শিকার হচ্ছে বেশি। গতবছরও ফতোয়াবাজগোষ্ঠী বাংলা-নববর্ষের মতো খ্রিস্টিয় নববর্ষপালনের বিরুদ্ধেও ব্যাপক ফতোয়াবাজি করেছিল। এবছরও তারা ডিসেম্বর-মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ৩১-এ ডিসেম্বর পর্যন্ত হাটে-মাঠে-ঘাটে তথা রাস্তাঘাটের ওয়াজ-ব্যবসায় ও কয়েকটি জুম্মার নামাজে আসল বয়ান রেখে এই খ্রিস্টিয় নববর্ষের বিরুদ্ধে অহেতুক ফতোয়াবাজি শুরু করেছিল। তাদের মনগড়া-ফতোয়াগুলো ছিল:
১. ইংরেজি নববর্ষপালন করলে মুসলমানদের ঈমান থাকবে না!
২. মুসলমান কখনো ইংরেজি নববর্ষপালন করতে পারে না।
৩. মুসলমান যদি খ্রিস্টানদের মতো ইংরেজি নববর্ষপালন করে তাহলে তাদের ঈমান চলে যাবে। মুসলমান থেকে খারিজ হয়ে যাবে।
৪. থার্টিফার্স্ট-নাইট-পালন করা হারাম ও কুফরি!
৫. থার্টিফার্স্ট-নাইট চরিত্রবিধ্বংসী এক উৎসব!
৬. থার্টিফার্স্ট-নাইট ঈমান ধ্বংসের এক মহাউৎসব!
৭. থার্টিফার্স্ট-নাইট কাফির ও মুশরিকদের জন্য। কোনো মুসলমান এই রাত উদযাপন করতে পারে না!
৮. থার্টিফার্স্ট-নাইট, নববর্ষ, বছরের প্রথম দিন পালন করা হারাম ও কুফরি!
৯. ইংরেজি নববর্ষ হচ্ছে বেহায়াপনা। এটা শরিয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম!
১০. ইংরেজি নববর্ষের নামে উলঙ্গপনা, নোংরামি, বেহায়াপনা, মদ খেয়ে ফুর্তি করা চলবে না। কোনো মুসলমান থার্টিফার্স্ট-নাইট বা ইংরেজি নববর্ষপালন করবেন না।
১১. ইংরেজি নববর্ষপালন ইহুদি-খ্রিস্টানদের সংস্কৃতি।
১২. বাংলা-নববর্ষ হিন্দুদের সংস্কৃতি!
এরা একটু সুযোগ পেলেই বাংলা-নববর্ষের বিরুদ্ধেও বিষোদগার করে থাকে। নইলে, এই ডিসেম্বর-মাসে খ্রিস্টিয় নববর্ষের বিরুদ্ধে ফতোয়াবাজি করতে গিয়ে মসজিদে-মসজিদে বাংলা-নববর্ষকে তৎসঙ্গে এখনই আক্রমণ করতে হবে কেন?
এদের দৃষ্টিতে মুসলমানদের সংস্কৃতি হলো বুঝি ফতোয়াবাজি!
বাংলার সর্বস্তরের ভণ্ড মোল্লা, মুন্সি ও আর কাটমোল্লা জোট বেঁধে কতরকম ফতোয়াবাজি করেছিল―কিন্তু তাদের কোনোকিছুই কাজে লাগেনি। মাওলানা-লকবধারী অনেক ভণ্ড আগের মতো তাদের রেডিমেট ফতোয়াও দিয়েছিল। কিন্তু মানুষ তাদের কথা শোনেনি।
২০২০ খ্রিস্টাব্দের ৩১-এ ডিসেম্বর রাত সাড়ে এগারোটার পর থেকে সারা ঢাকা-শহরে শুরু হয়েছিল বৃষ্টির মতো পটকা ফুটানোর ধুম। আকাশজুড়ে পুড়ছিল হাজার-হাজার রঙিন আতশবাজি! আর আতশবাজির ফুলকিতে বাংলার আকাশ আলোকিত ও আলো ঝলমলে হয়ে উঠেছিল। তার সঙ্গে চলছিল হাজার-হাজার ফানুস উড়ানোর প্রতিযোগিতা। রাত বারোটা বাজার কয়েক মিনিট আগে থেকে আতশবাজি আর ফানুসে ছেয়ে গিয়েছিল ঢাকার আকাশ! আমি কয়েকশ’ সুউচ্চ ভবনের ছাদে শুধু মানুষ-আর-মানুষ দেখেছি। আর ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে এরা সবাই মুসলমান। সবার হাতে আতশবাজি কিংবা ফানুস দেখেছি। কিংবা কারও হাতে পটকা। চারিদিকে পটকা ফুটানোর শব্দে মনে হচ্ছিলো দেশজুড়ে বিরাট কোনো এক উৎসব শুরু হয়েছে! আর সমগ্র ঢাকাকে উৎসবের শহর মনে হচ্ছিলো!
গতবছরও আমি একই চিত্র দেখেছি। ইতঃপূর্বে আমি কখনো বাংলার আকাশ এত উজ্জ্বল আর আলোকিত হতে দেখিনি! ফতোয়াবাজদের যত ‘হারাম-ঘোষণা’র বাড়াবাড়ি ও লাগামহীন বক্তব্য আসছে―মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনাও যেন তত বাড়ছে! কেউ ফতোয়াবাজদের কথায় ঘরে বসে ছিল না। অধিকাংশ মানুষকে ছাদে উঠতে দেখেছি। সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে অংশগ্রহণ করেছে। আবারও বলছি: প্রতিটি ছাদে শুধু মানুষ-আর-মানুষ দেখেছি। আর দেখেছি মানুষের সীমাহীন তথা বাঁধভাঙা আনন্দ! এই আনন্দের যেন কোনো শেষ নেই!
কোনো মানুষকে আমি মদ আর মেয়েমানুষ নিয়ে ছাদে উঠতে দেখিনি! মানুষের হাতে ছিল, পটকা, আতশবাজি আর রঙিন ফানুস (দেশের যে মুষ্টিমেয় মানুষ মদ্যপান করে তারা মদীয় আলোচনার বাইরে)। আমি শুধু সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের থার্টিফার্স্ট-নাইট উদযাপনের সংক্ষিপ্ত একটা চিত্র এখানে তুলে ধরেছি। বাংলার মানুষ কখনো কায়েমি-স্বার্থবাদীদের মনগড়া-ফতোয়া মানেনি আর মানবেও না কখনো।
দেশের সাধারণ মানুষ তথা মুসলমান ও পবিত্র ইসলামধর্ম আজ একশ্রেণীর সস্তা মোল্লা-মৌলোভীদের অতিসস্তা ফতোয়াবাজির শিকার। এরা যোকোনো বিষয়কে খুব সহজে ‘হারাম’ বলে ঘোষণা করতে কোনোরকম দ্বিধা করছে না। আসলে, এদের সবকিছুই মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এইসব ঘটনাকে নিতান্ত দায়সারাভাবে দেখলে আমাদের চলবে না। এর মূলে রয়েছে ধর্মব্যবসায়ীদের সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত। দেশ, জাতি, মানুষ আর মানবতার স্বার্থে এই চক্রজাল ছিন্ন করার জন্য রাষ্ট্রকে সর্বস্তরের মানুষের স্বার্থচিন্তায় আজ আরও কঠোর আর আরও বেশি মানবিক ও সংবেদনশীল হতে হবে। আর যথেচ্ছা মনগড়া ও লাগামহীন ফতোয়াবাজি নির্মূল করার জন্য রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে।
সাইয়িদ রফিকুল হক
০১/০১/২০২১
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৩:১৯