গল্প:
বজ্রাহত একটা মানুষ
সাইয়িদ রফিকুল হক
ফুলের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো তানভির।
শাহবাগের এই দোকানটা ওর খুব প্রিয়। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর নিয়মিত সে এখান থেকেই এতদিন সব ফুল কিনেছে। এমনকি বছর তিনেক আগে মিতির সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার পরও সে ফুল কিনেছে এখান থেকেই। কখনো-কোনোদিন তার ভুল হয়নি। আজও সে ফুল কিনতেই এসেছে।
আজ মিতির জন্মদিন। সে সুন্দর দেখে একগুচ্ছ ফুলের অর্ডার করে রেখেছিল সেই সকালে।
এতক্ষণ তার ক্লাস ছিল। তবুও সে ফুলের তোড়াটা একবার দেখতে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু ক্লাসের ব্যস্ততা আর ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু অনিক ও-কে আসতে দেয়নি। সামনে ওদের অনার্স-ফাইনাল পরীক্ষা। এখন প্রতিটি ক্লাস এজন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দুপুরে অনিক হলে খেতে গেল। তানভিরকেও সে সঙ্গে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু একটা কাজের কথা বলে সে খেতে যায়নি। এই সুযোগে সে একাই ফুলগুলো নিতে এসেছে।
অনিক তাকে বলেছিল, “জন্মদিনের অনুষ্ঠান তো সেই সন্ধ্যায়! এত আগে ফুল হাতে নিয়ে কী করবি! তারচেয়ে ক্লাস শেষে আমরা ফুল আনতে যাবো।”
কিন্তু তানভিরের মন মানছিল না এতে। সে ফুলগুলোকে এখনই দেখতে চায়। আর আগেভাগে এগুলো তুলে দিতে চায় মিতির হাতে। তাছাড়া, তার যে আরও গিফট কেনার জন্য নিউ মার্কেটে যেতে হবে!
মিতির সঙ্গে আজ সকাল থেকে ওর একবারও দেখা হয়নি। সে পড়ে ইতিহাসে। আর মিতি পাশেই কমার্স ফ্যাকাল্টিতে। সে একটা ক্লাসের গ্যাপে মিতিকে অনেক খুঁজেও তার দেখা পায়নি। ফোনও করেছিল সে কয়েকবার। তবুও তার কোনো সাড়াশব্দ পায়নি। একসময় দেখলো, ওর ফোনটা খুব ব্যস্ত! ভাবলো, আজ ওর জন্মদিন। তাই, সবাই হয়তো শুভেচ্ছা জানাচ্ছে তাকে! এরপর সবশেষে সে দেখলো, মিতির ফোনটা একেবারে বন্ধ! আর সপ্তাহখানেক হলো সে মিতির দেখা পাচ্ছে না!
সেই থেকে একটা চিন্তার মধ্যে রয়েছে তানভির। মিতির কোনো-একটা অমঙ্গল আশঙ্কায় তার বুকটা অজানা ব্যথায় কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো! তবুও সে শান্ত থাকার চেষ্টা করে।
সে মনখারাপ করে ফুলের তোড়াটা হাতে নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলো। এমন সময় সে দেখলো, তার মিতি তার থেকে দশ গজ দূরে ওপারের ডানদিকে দাঁড়িয়ে আছে! আর সে এখন এমপি সাহেবের ছেলের হাতধরে রাস্তাপার হয়ে এপারে আসছে!
তার দুচোখ যেন এখন অন্ধ হয়ে গেছে! সে কিছুতেই এটা বিশ্বাস করতে পারছিল না! সে যেন হঠাৎ চলৎশক্তি হারিয়ে রাস্তার মাঝখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো!
মিতি কী সুন্দর করে হাসছিল ওই ছেলেটির হাতধরে। সে তাকে একবারও দেখলো না! কিংবা দেখেও না-দেখার একটা ভান করে চলে গেল!
তানভির আজ নির্ঘাত অ্যাকসিডেন্ট করতো। কিন্তু রাস্তার একটা লোক তাকে এভাবে হঠাৎ মাঝরাস্তায় বেসমাল অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছুটে এসে তার হাতধরে টেনে রাস্তার ওপারে নিয়ে গেল। আর সে শাসনের সুরে বললো, “ভাইসাহেব কি পাগল হয়ে গেছেন নাকি! এভাবে গাড়ি-চলাচলের মাঝরাস্তায় কেউ দাঁড়িয়ে থাকে!”
তানভির তবুও কোনো কথা বলতে পারে না! তবুও সে একেবারে চুপচাপ! আর তবুও সে ভাবলেশহীন। সে তখনও গমনোদ্যত মিতির আবছা চেহারাটুকু দেখার চেষ্টা করছে!
সে যেন এখন বজ্রাহত কোনো এক মানুষ!
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা।
৩০/১২/২০২০
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:০৫