সাদেক হোসেন খোকা (১২ মে ১৯৫২ - ৪ নভেম্বর ২০১৯) ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ, সাবেক মন্ত্রী এবং বাংলাদেশের রাজধানী অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সর্বশেষ মেয়র। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সহ-সভাপতি ছিলেন এবং অবিভক্ত ঢাকা শহর বিএনপির সভাপতি ছিলেন দীর্ঘদিন। ঐতিহাসিক বায়ান্নোয় জন্ম নেওয়া খোকা একই সাথে নন্দিত ও নিন্দিত রাজনৈতিক জীবন পেরিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন ৬৭ বছর বয়সে। তিনি প্রাণের মায়া ত্যাগ করে জীবনের নয়টি মাস উৎসর্গ করেছিলেন বাঙালি জাতির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তাঁর প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলতে পারি যে ৬৭ বছর বয়সের একজন মানুষকে শুধুমাত্র নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অনেকেই আজ দলবাজির উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধের পতাকা হাতে নিয়ে খোকার গুণগানের মিছিলে হাজির! খোকা মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও জীবনে আরো অনেক ভালো ভালো কাজ করেছিলেন। তাই তাঁকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হলে তাঁর জীবনের ভালো-মন্দ সব ঘটনাকে আলোচনায় আনতে হবে। দলবাজি ও ব্যক্তিপূজার মন-মনসিকতা ছেড়ে সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলতে হবে। টানা এক দশকেরও বেশি সময় ঢাকার মেয়র ছিলেন তিনি। শুধু মেয়রই নন, দুই দুবার মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন তিনি। দল হিসাবে বিএনপির সফলতা নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে কিন্তু বিএনপির নেতা হিসাবে তিনি যে সফল তাতে কোন মতভেদ নেই। তিনি দুই মামলায় দণ্ডসহ ২৫টির অধিক মামলায় আসামি ছিলেন। খোকার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা তাঁর বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির মামলায় তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে যেতে পারেন নি বা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন নি। যাই-হোক, সাদেক হোসেন খোকার বর্ণাঢ্য জীবনের ঘটনা ও কাহিনী এখানে তুলে ধরলাম:
জন্ম ও ছাত্রজীবনে
সাদেক হোসেন খোকার জন্ম ১৯৫২ সালের ১২ মে মুন্সীগঞ্জের সৈয়দপুরে। তার বাবা এম এ করীম ছিলেন প্রকৌশলী ছিলেন। জন্ম গ্রামে হলেও তিনি বড় হয়েছেন বাবা-মায়ের সঙ্গে পুরান ঢাকার গোপীবাগে। শিশুকাল থেকেই খোকার বন্ধু-বান্ধবদের গন্ডি ছিল অনেক বড়। এই বন্ধুদের সঙ্গে মিলেই গড়ে তোলেন ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব। তিনি গোপীবাগ রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল, কলতাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জয়দেবপুর রানী বিলাস মনি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। তারপর জগন্নাথ কলেজ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলনে নাম লিখিয়ে খোকা হয়ে উঠেছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। রুশ-চীন দ্বন্দ্বে কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙন দেখা দিলে তিনি নাম লেখান চীনপন্থি শিবিরে। উল্লেখ্য, চীনপন্থী বামদলগুলো চীনের প্ররোচনায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থ করেনি। বন্ধুত্বের সূত্র ধরেই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে
১৯৭১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন নেতা রুহুল আমীন এবং গোপীবাগের মাসুদসহ বেশ কয়েকজন মিলে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য আগরতলার পৌঁছলে তাদের রিসিভ করেন শহীদুল্লাহ খান বাদল (রাশেদ খান মেননের ছোট ভাই)। সেখান থেকে খোকা চলে চলে যান দুই নম্বর সেক্টরে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ছিলেন সেই সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার। মেজর হায়দারের (পরে কর্নেল হায়দার) নেতৃত্বে ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। দুই নম্বর সেক্টরের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের নাম ছিল ‘মেলাঘর’। মেজর হায়দারের অধীনে তিন সপ্তাহ গেরিলা ট্রেনিং শেষে তারা সম্মুখ যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করেন ক্যাপ্টেন গাফফারের (পরে জাতীয় পার্টি নেতা ও মন্ত্রী) নেতৃত্বাধীন সাব সেক্টরে। ওখানে ট্রেনিং শেষ করার পর প্রথমদিকে কসবা-মন্দভাগ (মির্জাপুর) বর্ডার এলাকার সাব সেক্টরে কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন তিনি। ট্রেনিং শেষে একটি গেরিলা গ্রুপের কমান্ডার হিসাবে ঢাকায় আসেন সাদেক হোসেন খোকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের কাছে বিমান বাহিনীর রিক্রুটিং অফিস, বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সফল অপারেশনের নেতৃত্ব দেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঢাকায় অনেকগুলো সফল অপারেশনের নেতৃত্ব দেন ভয়ংকর সাহসী গেরিলা নেতা সাদেক হোসেন খোকা। যুদ্ধের ৯ মাসই প্রতিদিন এক বা একাধিক ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি।
কর্মজীবনে
মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি ফুটবল নিয়ে কাজ করেন। ১৯৭২ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়নের দায়িত্ব নেন। তিন বছরে ঘরোয়া ফুটবলের তৃতীয় ডিভিশন থেকে প্রথম ডিভিশনে উঠে আসে ব্রাদার্স ইউনিয়ন, মোহামেডান ও আবাহনীর সমপর্যায়ে চলে আসে। এছাড়া ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, ফরাশগঞ্জ ক্লাব এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের চেয়ারম্যানের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। তিনি ঢাকা মহানগর ফুটবল সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদে পদোন্নতি লাভ করেছিলেন। কাজী জাফর আহমেদ নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস লীগে (ইউপিপি) যোগ দিয়েছিলেন খোকা। এরপর খোকা মাওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ) যোগদানের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঊষালগ্নে চীনের পাকিস্তানকে সমর্থন এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের সদস্য হওয়ার বিরুদ্ধে ভেটো দেওয়ার কারণে অনেক কর্মী চীনপন্থী বামদলগুলো ত্যাগ করেছিলেন। তাছাড়া আশির দশকে আভ্যন্তরীন মতবিরোধে ভাঙ্গনের ফলে বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলো যখন বিলীন হওয়ার পথে তখন অনেকেই তাদের দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক আদর্শ-নীতি পরিত্যাগ করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোতে যোগ দেন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে যখন খালেদা জিয়া দলের হাল ধরেন, তখন চীনপন্থি অনেক বাম নেতাকে অনুসরণ করে খোকাও ১৯৮৪ সালে বিএনপিতে যোগ দেন। এরপর খোকাকে আর পেছন দিকে ফিরে তাকাতে হয়নি। তারপরের ইতিহাস সামান্য ওয়ার্ড কমিশনার থেকে খোকার মেয়র, মন্ত্রী ও বিএনপি'র প্রভাবশালী নেতা হওয়ার ইতিহাস, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থবিত্তের পাহাড় গড়ার ইতিহাস।
বিএনপির রাজনীতিতে
শুরু থেকেই বিএনপিতে বেশি ছিল সুবিধাবাদী নেতা যাদের বেশিভাগই সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার অথবা ব্যবসায়ী। এদের সাথে সাধারণ মানুষের কোন সম্পর্ক ছিল না, তাছাড়া এরা রাজনৈতিক সংঘটন ও দলীয় কর্মকান্ডের ব্যাপারে অভিজ্ঞ ছিলেন না। খোকা তাঁর অতীতের রাজনৈতিক সংঘটন ও দলীয় কর্মকান্ডের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বিএনপিতে উল্কার গতিতে শীর্ষ ও সিনিয়র নেতাদের সারিতে চলে আসেন। বিএনপিতে যোগদান করার অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। তৃণমূল থেকে উঠে আসা খোকা সহ-সাংগঠনিক পদ দিয়ে শুরু করে নানা পদ পেরিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত।
১৯৯০ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙা কেন্দ্র করে পুরান ঢাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার চেষ্টা হলেও তা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর পাহারা দিয়ে সম্প্রীতির অনন্য নজির স্থাপন করেন। এতে খোকা পুরান ঢাকাবাসীর আস্থা অর্জন করেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা-৭ আসন (সূত্রাপুর-কোতোয়ালি) থেকে বিএনপির মনোনয়নে জয়ী হন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হারিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন খোকা। এর পর তাকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী করা হয়।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ঢাকার আটটি আসনের মধ্যে সাতটিতে বিএনপি প্রার্থী পরাজিত হলেও একমাত্র খোকা নির্বাচিত হন। রাজনীতিবিদ খোকা প্রথমে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন। বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দল কঠোর আন্দোলন শুরু করলে ঢাকায় বিএনপি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় খোকাকে ১৯৯৬ সালে মহানগর বিএনপির আহ্বায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। ওই সময় পুরান ঢাকায় বিএনপির রাজনীতিতে নিজস্ব বলয় তৈরির পাশাপাশি প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ডে দলকে শক্তিশালী করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল খোকার। ২০০১ সালের নির্বাচনেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মৎস্য ও পশুসম্পদমন্ত্রী হন।
মেয়র পদে
পরে তাকে ঢাকার মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়া হয়। ২০০২ সালে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হয়ে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৪ সালে তিনি মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন, এর আগে তিনি একই সাথে মেয়র ও মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ক্রীড়া ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তাকে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার ২০০৪ দেয়া হয়। ২৯ নভেম্বর ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শাসনামলে ঢাকা মহানগরের মেয়র ছিলেন তিনি। বিএনপির সবশেষ কমিটিতে খোকাকে ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়।
সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে
২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তৎকালীন বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে দলে যে সংস্কারের দাবি উঠেছিল, তার প্রতি সাদেক হোসেন খোকার সমর্থন ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে খোকা সেই অভিযোগ অস্বীকার করতেন।
মেয়র খোকার সম্পদের পাহাড়
দুদকের তথ্য: ঢাকার মেয়রের ৫ বাড়ি, ফ্ল্যাট ৬টি, জমি ৯৫ বিঘা, প্লট ৮, নগদ সাড়ে ৫ কোটি টাকা, ৪০টি ব্যাংক এ্যাকাউন্ট, গাড়ি ২টি। ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা অর্থ-বিত্তের পাহাড় গড়েছেন। জমি-জায়গা-প্লট-ফ্ল্যাট, গাড়ি-বাড়ি, ব্যাংক একাউন্টের যে হিসাব তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দাখিল করেছেন তা রীতিমত পিলে চমকানো। সাদেক হোসেন খোকার পক্ষে তার আইনজীবী এডভোকেট এসএমএ কাইয়ুম ও এডভোকেট আশরাফউদ্দিন দুদকের সচিব মো. মোখলেস-উর-রহমানের কাছে সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিল করেন। দুদকের দেয়া তথ্যানুযায়ী ঢাকা শহর ও এর উপকণ্ঠে মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ও তার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যার নামে প্রায় শত বিঘা জমি, ১১টি বাড়ি-ফ্ল্যাট, ৮টি প্লট, ৪০টি ব্যাংক একাউন্ট, দুইটি বিলাসবহুল গাড়ি, নগদ সাড়ে ৫ কোটি টাকা রয়েছে। দুদকে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী অনুয়ায়ী জানা যায়, তার নিজ নামে গোপীবাগে দুইটি বাড়ি, মুন্সিগঞ্জে একটি বাড়ি, আরকে মিশন রোডে তিনতলাবিশিষ্ট একটি অধিগ্রহণকৃত বাড়ি, গুলশানে ৬ তলাবিশিষ্ট একটি আলিশান বাড়ি রয়েছে। তার স্ত্রী ইসমত আরার নামে গুলশানে একটি ও ঢাকার অন্য স্থানে একটি ফ্ল্যাট, ছেলে ইশরাক হোসেনের নামে দুইটি ফ্ল্যাট, মেয়ে সারিকা সাদেকের নামে দুইটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ২০০৮ সালে তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে একটি মামলা করে দুদক।
দেশত্যাগ
২০১৪ সালের ১৪ মে সাদেক হোসেন খোকা চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান। এর পর থেকে সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। তারপর থেকে সাড়ে পাঁচ বছর ধরে ছিলেন নিউইয়র্ক সিটির ইস্ট এলমহার্স্ট এলাকায় একটি ভাড়া বাসায়। সার্বক্ষণিক তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী ইসমত হোসেন। এ সময়কালে দেশে তার বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি দুর্নীতি মামলা হয়।
ফোনালাপে তোলপাড়
২০১৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার দুটি টেলিফোন কথোপকথন ফাঁসের পর দেশব্যাপী তোলপাড় হয়েছে। ‘জেনারেলদের সঙ্গে বৈঠকে আগ্রহী মান্না’ এবং ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ চান মান্না’ শিরোনামে দুটি অডিওবার্তা ছড়িয়ে পড়ার পর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন মান্না এবং খোকা। মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে পাড়ার চায়ের দোকান- সর্বত্রই চলছিল মান্না-খোকার ফোনালাপ নিয়েই তর্ক-বিতর্ক। এ বিষয়ে খোদ মাহমুদুর রহমান মান্নার বক্তব্য ছিল, তার ফোনালাপ সত্য।
মান্না ও খোকার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা
০৫ মার্চ ২০১৫ নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ও বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা হয়েছে। খোকা-মান্নার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমতি চাওয়া হয়েছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এই অনুমতি মেলার পর গুলশান থানায় তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নম্বর-১০। এর আগে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মান্না ও খোকার বিরুদ্ধে গুলশান থানায় একটি জিডি করা হয়েছিল।
খোকার ১৩ বছর কারাদণ্ড, ‘অবৈধ সম্পদ’ বাজেয়াপ্তের নির্দেশ
২০ অক্টোবর ২০১৫, সম্পত্তির তথ্য গোপন ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকাকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। তিনি অবৈধভাবে ১০ কোটি ৫ লাখ ২১ হাজার ৮৩২ টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন ঘোষণা করে, ওই সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রায়ে। মঙ্গলবার ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার সাত বছর আগের এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। এই রায় যখন হল, বিএনপির সাবেক ঢাকা মহানগর আহ্বায়ক খোকা তখন ‘চিকিৎসার জন্য’ নিউ ইয়র্কে অবস্থান করছেন। তাকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচার চলে। রায়ে বলা হয়, আসামি খোকা অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ার পাশাপাশি নয় কোটি ৬৫ লাখ তিন হাজার টাকার সম্পদের ওপর প্রযোজ্য কর ফাঁকি দিয়েছেন।
পার্কিং ইজারায় দুর্নীতি: পলাতক খোকার ১০ বছর সাজা
২৮ নভেম্বর ২০১৮, রাজধানীর বনানীর ডিসিসি সুপার মার্কেট হাউজিং কমপ্লেক্সের বেইজমেন্টে কার পার্কিং ইজারায় দুর্নীতির দায়ে ঢাকার সাবেক মেয়র বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকাসহ চার আসামিকে দশ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র খোকা ছাড়া দণ্ডিত তিন আসামি হলেন- সিটি করপোরেশনের ইউনিক কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আবদুল বাতেন নকী, সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান আজাদ ও গুডলার্ক কার পার্কিংয়ের ম্যানেজার এইচ এম তারেক আতিক। আসামিদের কেউ রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সাদেক হোসেন কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। তাকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচার শেষ হল। মামলার নথি থেকে জানা যায়, ডিসিসির বনানী সুপার মার্কেট কাম হাউজিং কমপ্লেক্সের বেইজমেন্টের কার পার্কিং ইজারার জন্য ২০০৩ সালে দরপত্র ডাকা হয়। জমা পড়া চারটি দরপত্রের মধ্যে মিজানুর রহমান নামের ব্যক্তি বার্ষিক এক লাখ ১০ হাজার টাকায় সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হন। কিন্তু তখনকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা অন্য আসামিদের সঙ্গে যোগসাজশে ইজারার কার্যক্রম স্থগিত করেন।
জীবনাবসান
সাদেক হোসেন খোকা ৪ নভেম্বর ২০১৯ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যানসার সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান স্ত্রী ইসমত হোসেন, মেয়ে সারিকা সাদেক, ছেলে ইশফাক হোসেন। তিনি মারা যাওয়ার আগে মির্জা ফখরুলের কাছে বাংলাদেশে আসার আকুতি জানিয়েছিলেন।
দুর্নীতির মেঘে ঢাকা সব অর্জন
সাদেক হোসেন খোকা শুরু থেকেই একজন দক্ষ সংগঠক ছিলেন। রাজপথের আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্র সেনানী। তার রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে । সরকারবিরোধী আন্দোলনে বারবার মার খাওয়ার পরও কর্মী বাহিনী নিয়ে সব সময় রাজপথে ছিলেন বিএনপির একমাত্র এই নেতা। খোকার রাজনীতির আদর্শ ও ধরন বদল হলেও মানুষকে নিয়েই তিনি সবসময় রাজনীতি করেছেন। জনপ্রতিনিধিত্ব করেছেন দীর্ঘ সময়। এমপি-মন্ত্রী-মেয়র পদে থেকে ঢাকার মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। তারেক, বাবরসহ বিএনপির অনেক নেতার বিরুদ্ধে হত্যা, সন্ত্রাস, ষড়যন্ত্র ও অবৈধ অস্ত্রের অভিযোগ/মামলা থাকলেও খোকার বিরুদ্ধে এই ধরনের কোনো অভিযোগ ছিল না। সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বেশির ভাগ নেতাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে জরুরি ভিত্তিতে মামলা হয়েছিল। এর থেকে খোকাও বাদ ছিলেন না।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর আইন-আদালতের নিয়মাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এ ধরনের বেশির ভাগ মামলা খারিজ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের নেতাদের কথা বাদই দিলাম, বিএনপির মওদুদ, আনোয়ার, মিলন, মোরশেদ খান, নাজমুল প্রমুখ অনেকেই বেশির ভাগ মামলায় উচ্চ আদালত থেকে খারিজ পেয়ে যায়। কারো কারো বিরুদ্ধে কিছু মামলা এখনও চলছে। তবে বাবরের মতো কয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া কাউকেই এখনো জেলে যেতে হয়নি। তাই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে সাদেক হোসেন খোকার মত একজন জনপ্রিয় নেতা দুর্নীতির মামলায় নিজে হাজির হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন না করে প্রবাসে স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিলেন কেন? খোকা আদালতে হাজির না হলেও তাঁর পক্ষের উকিলও প্রমাণ করতে পারেন নি যে খোকার বিরুদ্ধে আনীত দুদকের অভিযোগ মিথ্যা। তাছাড়া জমি-জায়গা-প্লট-ফ্ল্যাট, গাড়ি-বাড়ি, ব্যাংক একাউন্টের যে হিসাব তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দাখিল করেছেন তা ছিল রীতিমত দুর্নীতির আত্মস্বীকৃত দলিল।
শেষ কথা
ভুল-ত্রুটি, দোষ-গুণের সমন্বয়েই মানুষ। খোকাও এর উর্ধ্বে নন। বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার মহাপ্রয়ানে বেদনা-বিধূর হৃদয়ে দোয়া করি আল্লাহ তার জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিয়ে তাকে বেহেস্ত নসীব করুক। নদীর উৎপত্তি পাহাড়, পর্বত, ঝর্না, হ্রদ যেখান থেকেই হোক না কেন উদ্দেশ্য থাকে এঁকেবেঁকে সব বাঁধা পেরিয়ে সাগরে মিলিত হওয়া। আমাদের বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিকদের অবস্থাও তাই। বামপন্থী, মধ্যপন্থী, ডানপন্থী, কৃতি ছাত্র, পরোপকারী, ক্রীড়াবিদ,ধর্মভীরু, সমজসেবক–শুরু যেখান থেকে যেভাবেই হোক না কেন, রাজনীতির সাধারণ কর্মী থেকে শুরু করে দলের শীর্ষ নেতা সবারই উদ্দেশ্য শর্টকাট পথে স্বল্প সময়ে বৈধ-অবৈধ উপায়ে আগাধ সম্পদের মালিক হওয়া। নিজের দল, নেতা বা ব্যক্তিকে সমর্থন করতে গিয়ে আমরা আমজনতা যদি এই ধরনের দুর্নীতি বা অবৈধ কাজকে প্রশ্রয় দিই, দুর্নীতিবাজকে সৎ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করি, তাহলে সৎ ও দেশপ্রমিক নেতা এই দেশে আর কখনো পয়দা হবে না।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
২। দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সমকাল
৩। উইকিপিডিয়া
৪। ইউটিউব
৫। SATV, N-TV
৬। ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:১০