somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: ঝড় বৃষ্টির গল্প

০৬ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সবে মাত্র বৈশাখ শুরু হয়েছে। তাতেই সে তার তাণ্ডব দেখাতে ব্যস্ত। কখনো ঘরের চাল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কখনো বা বড় বড় ডাল এনে চালে ফেলছে। এতে তার মন ভড়ে না। তাই ঝড়ের সাথে শিলাবৃষ্টিও হয়।

আজও প্রচন্ড ঝড় হচ্ছে। বড় সুপারি গাছগুলো বাতাসের সাথে সাথে নুইয়ে পড়ছে, বাতাস কমতেই সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কড়াইয়ের মোটা ডালগুলো যেকোন সময় ভেঙ্গে কারো চালে পড়তে পারে। এ সময় ধানে শিস আসে। শিল পড়ে ধান নষ্ট হবার আশঙ্কা তারা সব সময়ই থাকে। ঝড়ের শুরুতে যে যেখানে পেরেছে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। মহিলারা উঠোন থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র ঘরে এনে দরজা, জানালা ভাল করে বন্ধ করে বসেছে।

ঝড়ের পাশাপাশি প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। শিলা বৃষ্টি হলে সাধারণত শিশুরা আনন্দে শিল কুড়োয়, শিল পড়া দেখে। আজ সে সুযোগ নেই। বড় বড় শিল পড়ছে, সবচেয়ে ছোটটা রাবারের বলের সমান। এর একটা মাথায় পড়লে হাসপাতালে যাওয়া ছাড়া গতি থাকবে না। এমন শিল পড়ে টিনের চাল পর্যন্ত ছিদ্র হয়ে যায়। ফসলের তো যাচ্ছেতাই অবস্থা। এ নিয়ে বড়দের মনে চিন্তার ছাপ। মনে মনে আফসোস করছে এবারের ফসল বুঝি ঘরে তোলা হবে না।

ছোটদের চিন্তা না থাকলেও খুব একটা সুখে নেই তারা। বৃষ্টিতে লুটোপুটি করতে পারছে না। শিল কুড়াতে পারছে না। অন্যের গাছতলায় গিয়ে আম কুড়াতে পারছে না। তার বদলে হাড়ি-পাতিল, মগ-বাটি নিয়ে দৌড়া-দৌড়ি করতে হচ্ছে। টিনের চালের যেসব জায়গা শিল পড়ে ছিদ্র হয়ে পানি পড়ছে; সেখানেই পাত্র দিচ্ছে। পাত্র ভরে যাবার সাথে তা খালি করে আবার জায়গা মতো রাখা হচ্ছে।

বৃষ্টির পানি থেকে ঘর শুকনা রাখার মহান দায়িত্বটা তারা পেয়েছে। তাই কাজটা তারা আনন্দের সঙ্গেই করছে। বড়রা হম্বিতম্বি করে বলছে, এই খানে কি করতাছোস। ওই খানে যা। কোথায় পানি পড়ে দ্যাখ। এক খানে বইয়া থাকলে হইব।

উঠোনের সামনের আম গাছের মুকুল দেখে উঠতি বয়সি মেয়েরা বলেছিল, এবার মনে হয় ম্যালা আম আইব। এতো আম ক্যমনে শেষ করবা বুবু? আমরারে দেওন লাগবো কিন্তু।

তাহেরার বয়স বেশি না, চুলেও পাক ধরেনি। তার পরেও ছোট ছেলে-মেয়েরা তাকে বুবু বলে ডাকে।

তাহেরা এক গাল হেসে বলেছিল, খাইছ, খাইছ। আম তো তোরাই খাবি।

আনন্দে ভরে ওঠতো তাহেরার বুক । এক মেয়ে আর স্বামী নিয়ে তাহেরার সংসার। কাঁচা বাজারের বাড়তি খরচ বাঁচানোর জন্য বাড়ির পেছনে একেক সময়ে একেক জিনিস লাগায়। কখনো সিম, কখনো বেগুন, কখনো বা করলা, মরিচ। এতে বাড়তি আয় না হলেও নিজেদের প্রয়োজন কিছুটা মিটে।

উঠোনের এক কোনে আম গাছ লাগিয়েছিল। বেশ কয়েক বছর আম আসেনি । এবার আমের ভারে ডাল নুইয়ে পড়েছিল। কিন্তু আজকের ঝড়, আর শিলা বৃষ্টিতে আমগুলো ওঠোনে ছড়িয়ে আছে। যেগুলো গাছে এখনো রয়ে গেছে সেগুলোর মধ্যে কিছু শিল পড়ে ফেটে গেছে।

তাহেরা সেগুলোই দেখছে। বৃষ্টিতে ভিজে কয়েক ঝুঁড়ি আম নিয়ে এসেছে। এখনো অনেক আম রয়ে গেছে। সেগুলো আনার অপেক্ষায় আছে।

মা, আমগুলা কি করবা।

কি আর করমু, সবাইরে দিয়া দিমু।

দিয়া দিবা।

ক্যান তুই কি করবি, এতো আম দিয়া।

আচার বানাইয়া বইয়ামে পুরায় রাখমু।

এতো আম ছুলতে ছুলতে তোর হাত ছুইল্লা যাইব। আচার বানাবো কইলেই বানান হইয়া গেলো নাকি? কত মসলা লাগে তার হিসাব আছে। বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ নাই বেক্কল মাইয়া আছে আচার বানান লইয়া।

আল্লায় জানে আমার বেগুন গাছগুলা আস্তা আছে নি।

তাহেরার মেয়ে সুফিয়া বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে। তাহেরা মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলল, চুপ কইরা দারায় না থাইক্কা আল্লা খোদার নাম নিতে তো পারছ। বৃষ্টি-বাদলে এমন করতে নাই। কওন যায় না কখন আল্লার গজব নামে

(দুই)

এখন সকাল গড়িয়ে দুপুর। বৃষ্টি থেমেছে কিন্তু বাতাস বইছে। পুরুষরা নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে। চারপাশে তাকিয়ে একেকজন নানা ধরনের মন্তব্য করছে। একজন বলে উঠল, ঝড়ে সবকিছু উলডাইয়া লাইছে, এক্কেবারে চিননই যায় না।তার কথায় সাই দিয়ে আরেকজন বলল, হ রে ভাই, দেখছোসনি কারবার। গাছ-পালা ভাইঙ্গা হইছে কী! একজন কৃষক বলল, আরে মিয়া তোমরা আছো গাছ লইয়া ক্ষেতের কি অবস্থা আল্লায় জানে।

কথা বলতে বলতে তারা ফসলি জমির দিকে গেলো। ইতোমধ্যে শিশুরা হাড়ি নিয়ে নেমে পড়েছে আম কুড়োনোতে। পাড়ার কয়েকজন মেয়ে এলো তাহেরার বাড়িতে।

তাহেরা তার মেয়েকে নিয়ে আম কুড়োচ্ছে। মেয়েদের দেখে বলল, ঘরের থেইক্যা বালতি আইন্যা আমগুলা ল তো বইন। কুড়াতে কুড়াতে একটি মেয়ে বলে উঠল, বুবু সব আমই তো পইড়া গেছে।

-হ রে বইন। এত বছর পর আম আইল, ঝড়ে সবডি আম পইড়া গেছে। তয় সবই আল্লার ইচ্ছা বুঝলি। আল্লাহ একেক সময় একেক জিনিস দিয়া মানুষরে পরীক্ষা লয়। তহন সবুর করতে হয়। আল্লা যা দেয় তাই লইয়া খুশি থাকতে হয়।

মেয়েরা আম কুড়োচ্ছে। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। কখনও ইশারায়, কখনও মুখে। একজনের কথা শুনে অন্যজন হাসছে মুখ টিপে। উঠতি বয়সি মেয়েরা খুব বেশি আবেগি হয়। এরা সামান্য কৌতুকে মুখ টিপে হাসে। আবার কখনও সামান্য কথায় রেগে লাল হয়, আড়ালে চোখের জল ফেলে।

আম কুড়োনো শেষ। সবাই আমের চারপাশে বসে আছে। তাহেরা বেগম আমগুলো ভাগ করে ঝুড়িতে রাখছেন। কে কাকে আম দিয়ে আসবে সেই ফরমায়েশ দিচ্ছেন। মেয়েরা বেশ আনন্দে কাজ করছে। কাউকে কিছু দেওয়ার মধ্যে একধরনের আনন্দ আছে। প্রশান্তি অনুভব হয়। হোক সেটা অন্যের পক্ষ থেকে অথবা নিজের।

তাহেরা এক ঝুড়ি আম রেখে সব আম বিলি করে দিয়েছে। মেয়েরা বসে আছে, আমের আচার বানানোর জন্য। কিন্তু কেউ মুখে কিছু বলছে না। তাহেরা মেয়েগুলোকে জিজ্ঞেস করলো, আমের ভর্তা বানাবি না?

মেয়েদের একজন বলে উঠল, হ বুবু।

-যা দা লইয়া আয়। পাকের ঘরে আছে দেখ। মেয়েটা দা এনে আম কুটতে বসলো। একজন গল্প বলছে। অন্যরা সেটা শুনছে আর হো হো হাসছে। তাহেরা বেগম তাদেরকে ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন বাড়ির পেছনের অংশে।। তার চিন্তা নিজের ছোট্ট ক্ষেত নিয়ে। ভাল ফলন হয়েছিলো।

শিল পড়ে ঝাল বেগুনসহ সব গাছগুলো পড়ে আছে। একটা গাছও ঠিক ভাবে নেই, নষ্ট হয়ে গেছে। ধান গাছে সবে মাত্র শিষ এসেছে। কিন্তু ঝড় আর শিল পড়ে ধান গাছগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।

এমন অবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাহরো গাছগুলো নেড়ে দেখছে কোনটা বাঁচবে, কোনটা বাঁচবে না। তাহেরা নির্বাক। ঘোলা চোখে তাকিয়ে আছে নষ্ট ধানি জমির দিকে। এ শুধু নষ্ট ধান নয়, বরং কৃষকের নষ্ট হওয়া বহু স্বপ্ন, নষ্ট হওয়া ঘাম, নষ্ট হওয়া আশা-আকাঙ্খা।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:১৯
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×