ধরেন, একটা গ্রামে ১০০ জন মানুষ থাকে। গ্রামের ধারণ ক্ষমতাও ১০০ জনই। ১০০ জনই কর্মক্ষম।
১০০ জনের ৩০ জন সরকারি/রাষ্ট্রীয় চাকরিজীবি (পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, জজ, সচিব, ইত্যাদি)। ১০ জন বুদ্ধিজীবি (শিক্ষক, ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, ইত্যাদি)। ২০ জন শ্রমিক (পরিবহন, শিল্প, নির্মাণ, প্রভৃতি খাতের শ্রমিক)। ১০ জন কৃষক (সরাসরি যারা খাদ্য উৎপাদনের সাথে জড়িত)। ২০ জন ব্যবসায়ী (যারা শুধু এদিকের মাল ওদিকে বিক্রি করে)। ১০ জন উৎপাদক (যারা ব্যবসায়ী, কিন্তু শিল্পউদ্যোক্তা; তাদের ব্যবসা থেকে পণ্য বা কাঁচামাল উৎপাদিত হয়)।
এখন গ্রামে জনসংখ্যা বাড়তে শুরু করলো। ধারণ ক্ষমতা, ভূমি, প্রাকৃতিক সম্পদ, উৎপাদিত খাদ্য ও অন্যান্য পণ্য, সবই কিন্তু ১০০ জনের জন্যই ঠিক ছিল। বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে কিছু জরুরি খাদ্য ও পণ্য আমদানি করা শুরু হলো। এদিকে গ্রাম থেকে যা কিছু রপ্তানি করা হতো, বাইরে সেসবের চাহিদা কমে গেলো, বা বদলে গেলো। ফলে গ্রামের আয় কমে গেলো, ব্যয় বেড়ে গেলো, ধারধর্ণা বেড়ে গেলো।
মানুষ বাড়তে থাকলো, বেড়ে যাওয়া মানুষের জীবিকার পছন্দের তালিকায় ছিল- সরকারি চাকরিজীবি, ব্যবসায়ী ও শ্রমিক; যার যেটা সামর্থ্যে কুলোয়। কৃষক কমতে থাকাতে খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিলো। বুদ্ধিজীবি কমে যাওয়াতে শিক্ষা, সংস্কৃতি, উদ্ভাবন, সভ্যতার অধপতন দেখা দিলো। উৎপাদক ও উদ্যোক্তা কমে যাওয়াতে গ্রামের অন্যান্য সবকিছুর জন্য বাইরের মুখাপেক্ষী হওয়া বাড়তে থাকলো।
তারপরেও মানুষের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ ও জনসংখ্যা কমানো নিয়ে সচেতনতা ও আগ্রহ দেখা গেলো না। গ্রামের প্রায় সবার মধ্যেই "জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ" বিষয়টা একটা ট্যাবু- নিষিদ্ধ বিষয়। সামাজিক বা ধর্মীয়ভাবে গ্রামের প্রায় শত ভাগ মানুষই সন্তান জন্মদানে কোন প্রকার উপদেশ, অনুরোধ ও হস্তক্ষেপে নারাজ।
এদিকে একসময় নতুন জন্ম নেওয়া গ্রামের মানুষগুলোর মধ্যে কাজের চাহিদা দেখা দিলো। গ্রামের আয়তন, সম্পদ, আয় কিছুই বাড়েনি, তাই কাজের প্রয়োজন ও সুযোগ কোনটাই বাড়েনি। দীর্ঘসময় ধরে, জটিল নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়ে, স্থায়ী ও বিশাল সুযোগসুবিধার সরকারি চাকরিতে ঢুকার জন্য সবার তীব্র আকাঙ্খা বাড়তে থাকলো। গ্রামের যা কিছু মোট আয়- সবই এই খাতে ঢেলে দেওয়া হতে লাগলো। অর্থাৎ পুরো গ্রামের মোট জনসংখ্যার সেবার জন্য যে কর্মীবাহিনী পোষা হচ্ছে, সেই কর্মীবাহিনীকে পোষার জন্যই পুরো গ্রামের আয়ের সিংহভাগ ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। গ্রামের মানুষেরও এতে আপত্তি নেই; কারণ সবারই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ও লক্ষ্য হচ্ছে সেই চাকরি!
নিশ্চিন্ত পেশা হওয়ার কারণে প্রশাসনের কর্মচারীরা গ্রামের সামগ্রিক আয়-উন্নতির ব্যাপারে মাথা ঘামানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না একদমই। কিন্তু ১০০ জন থাকতে পারে এমন একটা গ্রামের- ১০০০০ জন মানুষের মধ্যে ১০০০ জনই যদি রাষ্ট্রের কর্মচারী হয়, তবে বাকি ৯০০০ জন কি কখনো গুরুত্ব পাবে? ৯০০০ জনের মধ্যে যারা কৃষক, তাদের উপর চাপ বাড়ছে, কিন্তু তাদের চাষের জমি ও উপযুক্ত পরিবেশ ধীরে ধীরে কমছে। ৯০০০ জনের মধ্যে যারা শিল্পউদ্যোক্তা, তাদের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা গ্রামেই কমে আসছে; কর্মসংস্থানের অভাবে গ্রামের মানুষই সেই পণ্য ও সেবা কিনতে পারছে না। ফলস্বরূপ উৎপাদকও নিজের উৎপাদনখাতে নতুন নিয়োগ করতে পারছে না। শ্রমিক শ্রেণী অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল, সামাজিকভাবে অপদস্ত, ও মানসিকভাবে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। বুদ্ধিজীবি শ্রেণী হয় সরকারি চাকরিতে ঢুকার চেষ্টা করছে, কিংবা গ্রাম ছেড়ে বাইরে চলে যাচ্ছে- যেখানে ধারণক্ষমতার তুলনায় জনসংখ্যা কম ও সম্পদ বেশি।
গ্রামটাতে মানুষ বাড়ছে, চাহিদা বাড়ছে, দূষণ বাড়ছে, অপরাধ বাড়ছে, অস্থিরতা বাড়ছে, সংকট বাড়ছে, কিন্তু বিবেক-বুদ্ধি কমছে। এ এক অভূতপূর্ব গ্রাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০২১ দুপুর ১২:১৫