মুখের ভাষা বদলে দেওয়া ঐ ভাষাভাষী গোষ্ঠীকে শোষণ করার একটা গুরুতর পর্যায়। তাদের জাতিগত পরিচয় (Ethnic Identity) কে অস্বীকার করার শুরু হয় এখান থেকেই। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ, যাদের শিক্ষিত অংশ ইংরেজিও জানতো, তাদেরকে হঠাৎ করে বলা হলো “ভাষা হবে উর্দু” —এটা যেন হঠাৎ সব অ্যান্ড্রয়েড ফোনে iOS চালানোর নির্দেশ দেওয়া।
.
স্রেফ ভাষা দিয়ে দেশের ৫৬% মানুষকে শিক্ষা, চাকরি, বাণিজ্য থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার এক মহা আয়োজন ছিল ১৯৪৮-এর জিন্নাহর ভাষণে। '৫২-তে এই যজ্ঞের আগুন রক্ত ঢেলে না নেভালে তার পরিণতি হতো উইঘুর, রোহিঙ্গা, কুর্দিদের মতো। ভাষার দমন দিয়ে শুরু, গণহত্যা ও উচ্ছেদ (Displacement) দিয়ে শেষ । ভাষার বিজয় '৫৬-তে হলেও বাঙালিদেরও গণহত্যার মুখে পড়তে হয় '৭১-এ। দুনিয়ার সব আন্দোলনই আসলে রুটি-রুজির ব্যাপার।
.
এখানে কিছু সম্পূরক তথ্য যোগ করি:
প্রথমত, জিন্নাহ ঘোষণা দিয়েছিলেন উর্দু এবং "শুধুমাত্র" উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এই "শুধুমাত্র উর্দু"র বিরুদ্ধেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতো নেতারা গণপরিষদে লড়াই করেছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হোক। অর্থাৎ '৫২-এর ভাষা আন্দোলনে "উর্দুকে বাদ দিয়ে তার জায়গায় বাংলা" নয়, বরং পাশাপাশি দুটো ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল। এবং '৫৬-তে তাই করা হয়। কারো যদি ধারণা হয় যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলে ওপারের পাকিস্তানিদের কী হবে, তাদের জন্যে এই তথ্য।
.
দ্বিতীয়ত, জিন্নাহর মাতৃভাষা উর্দু না হলেও তিনি ওপারের মানুষ এবং উর্দু জানতেন। তাই তিনি নিরপেক্ষ একটা ভাষাকে পুরো পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর ইনোসেন্ট চিন্তা নিয়ে ঘুরতেন, ব্যাপারটা তা নয়।
.
তার উপর, জিন্নাহ "একমাত্র উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা" এই ঘোষণাটাও দিয়েছিলেন ইংরেজিতে। তিনি উর্দু বুঝলেও নিজে তার দেশের বাকি শিক্ষিত কুলের মতো ইংরেজিতেই ছিলেন দক্ষ। তার মাতৃভাষা ছিল গুজরাটি।
.
আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, ১৯৪৮ থেকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের অফিস-আদালতে ইংরেজিই ব্যবহৃত হয়ে আসছে কাজেকর্মে। কারণ তাদের আইন-কানুন আর দাপ্তরিক দলিল-দস্তাবেজ সব ব্রিটিশরা ইংরেজিতেই তৈরি করে গেছে। আর লোকজন বিভিন্ন ভাষাভাষী হলেও ইংরেজিতে দক্ষ ছিল।
আরো বড় বিষয় হলো, বাংলাদেশও স্বাধীনতার পর মহানন্দে ইংরেজি ব্যবহার করতে লাগলো অফিস-আদালতে। কারণ এখানকারও সবকিছু একইভাবে ব্রিটিশদের করা। আর বাংলাদেশের হাইকোর্ট এবং পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট যথাক্রমে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে সরকারি অফিস-আদালতের কাগজপত্র সব বাংলা ও উর্দুতে করার নির্দেশ দেয়।
.
তো শেষ করি এই ভাষা আন্দোলনের মূল উপলব্দি দিয়ে। '৫২ ছিল একটি রক্তাক্ত এবং সফল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। সেই সময়ের শিক্ষিত বাঙালিরা ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন যে ভাষা দিয়ে তাদের রোহিঙ্গা বানানোর প্রকল্প শুরু হচ্ছে পশ্চিম থেকে। ব্রিটিশরা সব কিছুতে ইংরেজি নিয়ে আসলেও তাদের বিরুদ্ধে কোথাও ভাষা আন্দোলন হয়নি। তারা ইংরেজি এনেছে ধীরে ধীরে, মানুষও ইংরেজি শিখে ফেলেছিল। তাদেরকে ভাষা দিয়ে শোষণ করতে হয়নি।
.
বাঙালি যদি পাঞ্জাবি, সিন্ধি বা বেলুচদের মতো সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে আগে থেকেই উর্দু জানতো, তাহলে এত বড় আন্দোলনে নামতো না। তাই যারা বলেন বাংলার জন্য জীবন দিয়ে এখন কেন বাংলাদেশিরা ইংরেজি শিখছে! জার্মান, চায়নিজ, স্প্যানিশ শেখার জন্য জীবন-যৌবন ঢেলে দিচ্ছে- তাদের বোঝা দরকার যে ভাষা শেখা একটা দক্ষতার বিষয়। এতে নিজের এথনিকাল আইডেন্টিটি ধ্বংস হয় না। বরং নিজের গোষ্ঠীর বৈশ্বিক প্রচার হয়। বর্মায় খেজুরের গুড় বেচতে গেলে বার্মিজ ভাষাতেই বিজ্ঞাপন দিতে হবে। '৫২ তে বাংলার জন্যে জীবন দিয়ে ২০২৪ এ ইংরেজী শিখা তাই কোন পাপ না।
.
সমস্যা তখনই হয়, যখন কেউ অন্যের ভাষা শিখতে গিয়ে নিজের কালচার ভুলে হুদাই ঐ ভাষার কালচারে ঢুকে যায়। নিজেই নিজের ইথনিকাল আইডেন্টিটি ধ্বংস করা এক ধরনের সুইসাইডের মত।
.
#Afnan_Abdullah
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ রাত ১২:০৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


