somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'৫২ ছিল একটি রক্তাক্ত এবং সফল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। (ভাষা শেখা আর ভাষা আন্দোলন গুলিয়ে যারা পাপবোধে ভোগেন, এই লেখাটি তাদের উপশম দেবে।)

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ রাত ১১:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মুখের ভাষা বদলে দেওয়া ঐ ভাষাভাষী গোষ্ঠীকে শোষণ করার একটা গুরুতর পর্যায়। তাদের জাতিগত পরিচয় (Ethnic Identity) কে অস্বীকার করার শুরু হয় এখান থেকেই। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ, যাদের শিক্ষিত অংশ ইংরেজিও জানতো, তাদেরকে হঠাৎ করে বলা হলো “ভাষা হবে উর্দু” —এটা যেন হঠাৎ সব অ্যান্ড্রয়েড ফোনে iOS চালানোর নির্দেশ দেওয়া।
.
স্রেফ ভাষা দিয়ে দেশের ৫৬% মানুষকে শিক্ষা, চাকরি, বাণিজ্য থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার এক মহা আয়োজন ছিল ১৯৪৮-এর জিন্নাহর ভাষণে। '৫২-তে এই যজ্ঞের আগুন রক্ত ঢেলে না নেভালে তার পরিণতি হতো উইঘুর, রোহিঙ্গা, কুর্দিদের মতো। ভাষার দমন দিয়ে শুরু, গণহত্যা ও উচ্ছেদ (Displacement) দিয়ে শেষ । ভাষার বিজয় '৫৬-তে হলেও বাঙালিদেরও গণহত্যার মুখে পড়তে হয় '৭১-এ। দুনিয়ার সব আন্দোলনই আসলে রুটি-রুজির ব্যাপার।
.
এখানে কিছু সম্পূরক তথ্য যোগ করি:
প্রথমত, জিন্নাহ ঘোষণা দিয়েছিলেন উর্দু এবং "শুধুমাত্র" উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এই "শুধুমাত্র উর্দু"র বিরুদ্ধেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতো নেতারা গণপরিষদে লড়াই করেছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হোক। অর্থাৎ '৫২-এর ভাষা আন্দোলনে "উর্দুকে বাদ দিয়ে তার জায়গায় বাংলা" নয়, বরং পাশাপাশি দুটো ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল। এবং '৫৬-তে তাই করা হয়। কারো যদি ধারণা হয় যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলে ওপারের পাকিস্তানিদের কী হবে, তাদের জন্যে এই তথ্য।
.
দ্বিতীয়ত, জিন্নাহর মাতৃভাষা উর্দু না হলেও তিনি ওপারের মানুষ এবং উর্দু জানতেন। তাই তিনি নিরপেক্ষ একটা ভাষাকে পুরো পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর ইনোসেন্ট চিন্তা নিয়ে ঘুরতেন, ব্যাপারটা তা নয়।
.
তার উপর, জিন্নাহ "একমাত্র উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা" এই ঘোষণাটাও দিয়েছিলেন ইংরেজিতে। তিনি উর্দু বুঝলেও নিজে তার দেশের বাকি শিক্ষিত কুলের মতো ইংরেজিতেই ছিলেন দক্ষ। তার মাতৃভাষা ছিল গুজরাটি।
.
আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, ১৯৪৮ থেকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের অফিস-আদালতে ইংরেজিই ব্যবহৃত হয়ে আসছে কাজেকর্মে। কারণ তাদের আইন-কানুন আর দাপ্তরিক দলিল-দস্তাবেজ সব ব্রিটিশরা ইংরেজিতেই তৈরি করে গেছে। আর লোকজন বিভিন্ন ভাষাভাষী হলেও ইংরেজিতে দক্ষ ছিল।
আরো বড় বিষয় হলো, বাংলাদেশও স্বাধীনতার পর মহানন্দে ইংরেজি ব্যবহার করতে লাগলো অফিস-আদালতে। কারণ এখানকারও সবকিছু একইভাবে ব্রিটিশদের করা। আর বাংলাদেশের হাইকোর্ট এবং পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট যথাক্রমে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে সরকারি অফিস-আদালতের কাগজপত্র সব বাংলা ও উর্দুতে করার নির্দেশ দেয়।
.
তো শেষ করি এই ভাষা আন্দোলনের মূল উপলব্দি দিয়ে। '৫২ ছিল একটি রক্তাক্ত এবং সফল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। সেই সময়ের শিক্ষিত বাঙালিরা ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন যে ভাষা দিয়ে তাদের রোহিঙ্গা বানানোর প্রকল্প শুরু হচ্ছে পশ্চিম থেকে। ব্রিটিশরা সব কিছুতে ইংরেজি নিয়ে আসলেও তাদের বিরুদ্ধে কোথাও ভাষা আন্দোলন হয়নি। তারা ইংরেজি এনেছে ধীরে ধীরে, মানুষও ইংরেজি শিখে ফেলেছিল। তাদেরকে ভাষা দিয়ে শোষণ করতে হয়নি।
.
বাঙালি যদি পাঞ্জাবি, সিন্ধি বা বেলুচদের মতো সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে আগে থেকেই উর্দু জানতো, তাহলে এত বড় আন্দোলনে নামতো না। তাই যারা বলেন বাংলার জন্য জীবন দিয়ে এখন কেন বাংলাদেশিরা ইংরেজি শিখছে! জার্মান, চায়নিজ, স্প্যানিশ শেখার জন্য জীবন-যৌবন ঢেলে দিচ্ছে- তাদের বোঝা দরকার যে ভাষা শেখা একটা দক্ষতার বিষয়। এতে নিজের এথনিকাল আইডেন্টিটি ধ্বংস হয় না। বরং নিজের গোষ্ঠীর বৈশ্বিক প্রচার হয়। বর্মায় খেজুরের গুড় বেচতে গেলে বার্মিজ ভাষাতেই বিজ্ঞাপন দিতে হবে। '৫২ তে বাংলার জন্যে জীবন দিয়ে ২০২৪ এ ইংরেজী শিখা তাই কোন পাপ না।
.
সমস্যা তখনই হয়, যখন কেউ অন্যের ভাষা শিখতে গিয়ে নিজের কালচার ভুলে হুদাই ঐ ভাষার কালচারে ঢুকে যায়। নিজেই নিজের ইথনিকাল আইডেন্টিটি ধ্বংস করা এক ধরনের সুইসাইডের মত।
.
#Afnan_Abdullah
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ রাত ১২:০৯
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×