somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-১৬)

১৯ শে নভেম্বর, ২০১৯ ভোর ৬:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-১৫)

কী তোমারে চাহি বুঝাইতে?
গভীর হৃদয়-মাঝে, নাহি জানি কী যে বাজে
নিশিদিন নিরব সংগীতে,
শব্দহীন স্তব্ধতায় ব্যাপিয়া গগন
রজনীর ধ্বনির মতন।

মরিয়মের বিয়ের দিন আলেয়া সকাল থেকে সাজ গোজ করছে। ছোট চাচীমার বয়স কম। তাঁরও সাজ গোজ করার খুব শখ। নিজে সেজে গুজে তৈরি হয়ে আলেয়া ছোট চাচীমাকে সাজাতে বসেছে। ছোট চাচা নিজের ঘরে উঁকি দিয়ে চাচী ভাতিজির এসব কাণ্ড দেখছেন আর ছি ছি করছেন। আমার মা এসে ছোট চাচাকে হাত ধরে টেনে দূরে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘তুই এত ছি ছি করছিস কেন? তোর বউ কী বুড়ি হয়ে গেছে? বিয়ের বাড়িতে একটু সেজে গুজে যাবে না তো কী ফকিরনীর মতো যাবে? তুই তোর কাজ করগে,যা। এদিকে তোর আসার দরকার নাই।’

ছোট চাচীমা স্নো পাউডার মেখে নতুন শাড়ি ও গয়নাগাঁটি পরে আলেয়ার সাথে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। মাথায় ঘোমটা দিয়ে তার একটা অংশ টেনে তিনি মুখের অর্ধেকটা ঢেকে রেখেছেন। ফলে তাঁর পুরো চেহারাটা দেখা যাচ্ছে না। আলেয়াকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী রে, ছোট চাচীমাকে এত সুন্দর করে এক ঘণ্টা ধরে সাজালি, কিন্তু তার মুখটাই যে দেখা যাচ্ছে না! সেজে গুজে কী লাভ হলো?’
‘আর বলো না মেজভাই!’ আলেয়া হতাশ হয়ে বললো, ‘ছোট চাচীমা তার লিবিসটিক পরা ঠোঁট কাউকে দেখাবেনা। তার নাকি খুব লজ্জা লাগছে।’
‘তা’ তুই লিপস্টিক লাগাতে গেলি কেন?’
‘ওমা, চাচীমার যে লিবিসটিক পরার খুব শখ। আমাকে কবে থেকে বলছে, তুমি জানো?’
ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়ার শখ, অথচ সেই ঠোঁট কাউকে দেখানো যাবেনা। এই মারফতি রহস্যের শানে নজুল আমার মাথায় ঢুকলো না। চাচী ভাতিজির এসব উচ্চমার্গের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে আমার আগ্রহ শেষ হয়ে গেল।

বড় চাচীমা একখানা হাল্কা ঘিয়ে রঙের শাড়ি পরেছেন। গায়ে গয়নাগাঁটি তেমন নেই। মা গিয়ে তাঁকে কষে ধমক লাগালেন, ‘এই শাড়ি ছাড়া তোর কী আর কোন শাড়ি নাই? গয়নাগাঁটি কী সব বেঁচে খেয়েছিস? এভাবে তুই যদি বিয়ে বাড়ি যাস তো আমি কিন্তু যাবো না বলে দিলাম। ছেলেমেয়ের এখনো বিয়েই হলো না, এখনই বিধবা সাজার শখ!’
বড় চাচীমা পড়িমরি করে ঘরে ঢুকে শাড়ি ব্লাউজ বদলে গয়নাগাঁটি পরে আবার মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঠিক আছে ভাবী?’
মা কিছু বলার আগেই আলেয়া উল্লসিত হয়ে বললো, ‘হাঁ মা, এবার তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।’
মা বড় চাচীমাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘তুই ঠিক বলেছিস আলেয়া। তোর মা জোয়ান কালে আরো সুন্দর ছিল। তোরা তো দেখিসনি। মধুপুর গাঁয়ের সবাই দেখেছে। যখন বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে এলো, তখন তোর মায়ের কী রূপ! দুধে আলতা গায়ের রঙ, হাঁটু পর্যন্ত ঘন কালো লম্বা চুল। সেসব চুল কোথায় গেল........!’
‘ভাবী!’ বড় চাচীমা লজ্জা পেয়ে বললেন, ‘এসব কথা থাক না!’

মেজ চাচীমা তাঁর ঘরে বসে চেঁচামেচি করছেন। মাসখানেক আগে কেনা তাঁর নতুন চপ্পল জোড়া তন্ন তন্ন করে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেজ চাচার ধমক খেয়ে কাঁদাকাটি করে তাঁর চোখের কাজল ধুয়ে গেছে। চোখের নিচে ও নাকের ডগায় কাজলের ছোপ ছোপ কাল দাগ নিয়ে বিদঘুটে চেহারা করে তিনি খাটের ওপর বসে আছেন আর চিৎকার করে চপ্পল চোরের গুষ্টি উদ্ধার করছেন। শেষে সবাই মিলে খোঁজাখুঁজি করে খাটের নিচে থেকে চপ্পল জোড়া উদ্ধার করা হলো। মেজ চাচীমার কোন দোষ নাই। চপ্পলের ওপর বাঁশের খলপা ও চটের ছালা বিছিয়ে তার ওপর আদা, রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ, হাঁড়ি ভর্তি আখের গুড়, টিন ভর্তি মুড়ি ও গমের আটা ইত্যাদি রাখা হয়েছে। চপ্পল চোখে পড়বে কিভাবে?

যা হোক, জালালকে বাড়ি পাহাড়া দিতে রেখে সবাই মিলে বিয়ে বাড়ি যাওয়া হলো। বেলা বারোটার আগে বরপক্ষ চলে এল। অবস্থাপন্ন ঘরেই বিয়ে হচ্ছে মরিয়মের। মধুপুর থেকে চার ক্রোশ দূরে হরিরামপুর গ্রামে মরিয়মের শ্বশুর বাড়ি। সেখান থেকে আটখানা গরুর গাড়ি ভর্তি হয়ে বরপক্ষের লোকজন এসেছে। বরের গাড়ির ছই নানা রঙের কাগজের ফুল দিয়ে সাজানো। বরের পরনে সাদা পাজামা ও ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি। মাথায় কিস্তি টুপি। মুখে আতর মাখা সাদা রূমাল। বরের সাথে আসা যাত্রীদের পরনে ফুলহাতা শার্ট ও নতুন লুঙ্গি।
পরামানিকের বাড়ির ভেতর বাহির লোকে লোকারণ্য। চারদিকে প্রচণ্ড হৈ চৈ। নারী পুরুষ ছেলে বুড়ো কে কাকে কী বলছে বোঝার উপায় নাই। কলাগাছ ও রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো গেটে বরকে আটকে রেখে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা টাকার জন্য গলা ফুলিয়ে ঝগড়া করছে। দু’তিন দফা ঝগড়া শেষে কুড়ি টাকা আদায় করে তারা মনমরা হয়ে গেট ছেড়ে দিল। বরপক্ষের কেউ একজন বললো, ‘একসাথে কুড়ি টাকা বাপের কালে দেখেছিস তোরা?’ বাপ তুলে কথা বলায় আবার এক পশলা তুমুল ঝগড়াঝাটি হয়ে গেল।

বাড়ির ভেতর বরকে বসানোর পর দেন মোহরানার টাকা নিয়ে বড়দের মধ্যে তর্ক বিতর্ক শুরু হলো। কনে পক্ষের মহিলারা ঘরের ভেতর থেকে ঝগড়ার সুরে কথা বলছেন। তারা বরপক্ষের প্রস্তাবিত মোহরানার অংকে সন্তুষ্ট নন। বাইরে বারান্দায় বসা মুরুব্বীরা অবশ্য অতটা নির্দয় নন। তাদের তর্ক বিতর্কের মধ্যে একটা মিঠেকড়া ভাব। শেষ পর্যন্ত দুশো এক টাকা দেন মোহরানা ধার্য করে বিয়ের কালমা পড়ানো হয়ে গেল। দোয়া খায়ের শেষে সবার মধ্যে শুকুর মিঠাই বিলি করা হলো। পরামানিক তার নতুন জামাই নিয়ে লোকজনসহ মসজিদে চললেন জুম্মার নামাজ আদায় করতে। নামাজ থেকে ফিরে শুরু হবে খাওয়া দাওয়া।

জামাইয়ের এক পা সামান্য ছোট। হাঁটার সময় একদিকে একটু কাত হয়ে হাঁটে। তবে ছেলে দেখতে শুনতে মন্দ না। গ্রামের মহিলারা কেউ কেউ বললেন, পরামানিকের জামাই লুলা। কেউ কেউ বললেন, ‘পুরুষ মানুষের আবার খুঁত কী? পুরুষ মানুষ হলো সোনার আংটি। বাঁকা হলেও সোনা, ফাটা হলেও সোনা।’
পরামানিকের সোনার আংটি জামাই উঁচু নিচু হয়ে হাঁটতে হাঁটতে শ্বশুরের সাথে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে ফিরে এলো। জামাইয়ের মুখে চিরস্থায়ী লজ্জা লজ্জা ভাব।
বাড়ির সামনে শামিয়ানা টানিয়ে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। সরকার বাড়িসহ গ্রামের অবস্থাপন্ন গৃহস্থ এবং বরপক্ষের লোকেদের জন্য শামিয়ানার নিচে ফরাশ পেতে টিনের প্লেটে খাওয়ার ব্যবস্থা। অন্যান্যদের জন্য ফরাশবিহীন মাঠে বসে কলাপাতায় খাওয়ার আয়োজন। মহিলা ও বাচ্চা কাচ্চারা খাবে বাড়ির পেছনে পরামানিকের ধান শুকানোর চাতালে বসে।

খাওয়ার মেন্যু হলো রোপা আমন চালের সাদা ভাত আর গরুর মাংস। বড় বড় বাঁশের ঝাঁকা ভর্তি গরম গরম ভাত আর বালতি ভর্তি ঝোলে টই টুম্বুর গরুর মাংস পরিবেশন করা হচ্ছে। গ্রামের গরিব লোকেরা হাপুস হুপুস করে খেতে খেতে রান্নার খুব সুনাম করছে। আমার থালায় দুই ডাবু ঝোলের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে দু’টুকরা ট্যাবলেট সাইজের মাংস পাওয়া গেল। অত্যাধিক ঝালের কারণে আমি প্রায় কিছুই খেতে পারলাম না। আমার অন্যান্য ভাইদেরও একই অবস্থা। শুধু চাচাদের ছেলেরা ধুমসে খেয়ে যাচ্ছে। ওরা ঝাল খেয়ে অভ্যস্ত, কিন্তু আমাদের এত ঝাল খাওয়ার অভ্যাস নাই। আব্বাসহ আমরা পাঁচ ভাই সবার আগে খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লাম। অর্ধেকের বেশি খাবার পড়ে রইল আমাদের থালায়। পরামানিক হৈ হৈ করে ছুটে এসে খুব সংকোচের সাথে আব্বাকে বললেন, ‘ভাইজান, এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন যে! ছেলেরাও তো কিছুই খেল না দেখছি। রান্না বোধহয় ভালো হয়নি, তাই না?’
আব্বা হেসে বললেন, ‘পরামানিক, চিন্তা করো না। আমরা শহরের মানুষ এরকমই খাই। রান্না ভালো হয়েছে।’
‘বাঁচালেন ভাইজান। সরকার বাড়ির অসম্মান হলে তো আমার নিজের গালে নিজের হাতে জুতা মারা ছাড়া উপায় নাই। আল্লাহ, তুমি ইজ্জতের মালিক।’
পরামানিক আব্বার কাছে অনুমতি নিয়ে তদারকি করতে অন্যদিকে চলে গেলেন। আমরা পাঁচ ভাই তখনো ঝালের চোটে মুখ দিয়ে হু হু শব্দ করছি। অন্ধ দাদাজানকে দাওয়াতে না এনে জালালের জিম্মায় রেখে আসা হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, পরামানিক একবারও দাদাজানের কথা জিজ্ঞেস করলেন না।

মরিয়মের শ্বশুর বাড়ি দূরের পথ। দুপুর গড়ানোর পর পরই বরপক্ষের লোকেরা বিদায় নেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে দিল। সাজানো গোছানো কনেকে বরের সাথে সাথে হাঁটিয়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসা হলো। মরিয়মের মা ও অন্যান্য মহিলাদের বুকফাটা কান্নাকাটির মধ্যে টানাটানি করে বরসহ কনেকে রঙিন কাগজের ফুল দিয়ে সাজানো গরুর গাড়িতে উঠানো হলো। দূর থেকে দেখলাম, আলেয়া গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে মরিয়মের হাত ধরে কাঁদছে। বরপক্ষের মুরুব্বীদের সাথে পরামানিক কোলাকুলি করছেন। কম বয়সী ছেলে মেয়েরা ঠেলাঠেলি করে বর কনেকে দেখার চেষ্টা করছে। এরপর এক সময় ক্যাঁচর ক্যাঁচর আওয়াজ তুলে গরুর গাড়ির বহর রওনা হয়ে গেল। আলেয়া চোখ মুছতে মুছতে অন্য মহিলাদের সাথে বাড়ির ভেতর চলে গেল।

বাড়ি ফেরার পর পোশাক আশাক বদলে হাতমুখ ধুয়ে আমি বারান্দায় বসে আছি। আলেয়া এসে বললো, ‘মা তোমাকে খেতে ডাকছে।’
আমি বললাম, ‘এখন আবার খাওয়া কেন? এখনই তো দাওয়াত খেয়ে এলাম।’
আলেয়া গম্ভীর মুখে বললো, ‘আমি জানিনা। না খেলে তুমি মাকে গিয়ে বলো।’
বড় চাচীমার ঘরে মাদুর বিছিয়ে আমাদের সব ভাই বোনকে চিঁড়া, দুধ আর পাকা আম দিয়ে নাস্তা দেওয়া হয়েছে। বিয়ে বাড়িতে যে ছেলেমেয়েদের খাওয়া দাওয়া যুৎসই হয়নি বড় চাচীমা তা’ বিলক্ষণ জানেন। তিনি বেশ কুণ্ঠার সাথে বললেন, ‘গ্রামে এসব সমাজের খাওয়া তোমাদের জন্য নয়, বাবা। এসব কী তোমরা খেতে পারো? এখন একটু কিছু খাও, সন্ধ্যের পর ভাত দিয়ে দেব।’
আমি বললাম, ‘আলেয়া, তুই খাবিনা?’
আলেয়া বললো, ‘না।’
বড়ভাই ও বড়বোন খেতে বসেছেন দেখে আমি আর কথা না বাড়িয়ে খেতে বসে গেলাম। খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে আলেয়াকে খুঁজলাম। কিন্তু বাড়ির ভেতর কোথাও তাকে দেখলাম না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক খুঁজেও ওকে পাওয়া গেল না। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। বিশ্ব চরাচর ডুবে যাবে অন্ধকারে। গরু চরিয়ে মাঠ থেকে ফিরছিল জালাল। আমাকে দেখে সে বললো, ‘আলেয়া বুবু পুকুর ঘাটে বসে আছে।’
আমি ওর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমি তোমার আলেয়া বুবুকে খুঁজছি সে কথা তোমাকে কে বললো?’
জালাল পুরোপুরি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি যাও।’

সরকার বাড়ির অদূরে বিশাল লিচু গাছের নিচে এই পুকুরের ভাঙ্গাচোরা ঘাটে সাধারণত কেউ বসে না। এই পুকুরে সরকার বাড়ির ময়লা চটের ছালা, নোংরা হাঁড়ি পাতিল, পুরনো তেল চিটচিটে কাঁথা কাপড় এইসব পরিস্কার করা হয়। সঙ্গত কারণে পুকুরের পানি ঘোলা। পদ্মপুকুরের মতো টলটলে নয়। অথচ আলেয়া একা একা সেখানে বসে আছে। আমি লিচু গাছের নিচে দাঁড়িয়ে খুক খুক করে কাশি দিলাম। উদ্দেশ্য আলেয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কিন্তু আলেয়া ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখেও পাত্তা দিল না। যেন বহুবার আমাকে দেখে দেখে সে ক্লান্ত হয়ে গেছে। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও সে যখন কিছু বললো না, তখন পা টিপে টিপে ওর পাশে গিয়ে চুপচাপ বসে পড়লাম। একটা কিছু বলা দরকার। কিন্তু কী বলবো বুঝতে পারছি না। শেষে কিছুই না বলে আমি শান্ত হয়ে বসে থাকলাম।

আলেয়ার মুখ থমথমে। কিশোরী মেয়ের চঞ্চলতা হারিয়ে সে যেন এক স্থিতধী পরিপূর্ণ নারীতে রূপান্তরিত হয়েছে। চোখের পলক না ফেলে সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পুকুরের ঘোলা পানির দিকে। অনেকক্ষণ পর সে আমার দিকে না তাকিয়ে বললো, ‘আমার কিছু ভালো লাগছে না, মেজভাই।’
সে তো বোঝাই যাচ্ছে। আমি কিছু একটা বলার সুযোগ পেয়ে তাড়াতাড়ি বললাম, ‘বিয়ে হয়ে মরিয়ম চলে গেছে বলে মন খারাপ?’
আলেয়া এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘হাঁ।’
খুব স্বাভাবিক। আমি ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘একদিন তো সব মেয়েকেই বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি চলে যেতে হয়। এটাই দুনিয়ার নিয়ম। তুইও যখন শ্বশুর বাড়ি চলে যাবি, তখন তোর অন্যান্য সইদের মন খারাপ হবে। এটা মেনে নিতে হয়।’
আলেয়া শুন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি আরো কিছু বলে ওকে সহজ করবো বলে ভাবছে, এই সময় সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা মেজভাই, মেয়েরা বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে গেলে তার পুরাতন সইদের কথা ভুলে যায়, তাই না?’
‘ভুলে তো যেতেই হয়। না হলে স্বামী সন্তান নিয়ে সে সংসার করবে কিভাবে বল্? এই দুনিয়াতে কোন শুন্য স্থানই শেষ পর্যন্ত শুন্য থাকে না। স্বামী সন্তানের ভালোবাসা পেয়ে সব মেয়েই তার পুরাতন জীবনের কথা ভুলে যায়। মন খারাপ করিস না আলেয়া। সংসারে কিছু কিছু বিষয় আছে, যা আল্লাহর বেঁধে দেওয়া নিয়মে চলে। মানুষের কিছু করার থাকে না।’

মধুপুরে আসার পর এই প্রথম আলেয়াকে আমি কিছু সিরিয়াস কথা বললাম। ওর বয়স, শিক্ষা-দীক্ষা ও গ্রামীন সংস্কৃতির কথা মাথায় রেখে এর আগে কখনো এভাবে কথা বলিনি। কিন্তু যথেষ্ট আন্তরিকভাবে কথাগুলো বলার পরেও আলেয়ার কোন ভাবান্তর হলো না। কেন জানি সে মোটেই সহজ হতে পারছে না। সে কাঁদছে না ঠিকই, কিন্তু সে যে হাসছে না সেটাই তো আমার কাছে ওর কান্নার সমান। এ কথা ওকে বোঝাবো কিভাবে? আমি আর কথা না বাড়িয়ে আলেয়া নিজে থেকে কিছু বলে কী না সে আশায় অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু আলেয়া একদম চুপচাপ। ওর এই চেহারা আমার অচেনা। আমি সত্যি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। আমার নিজেরও বয়স কম বলে এক ধরনের উপেক্ষার অভিমানও হলো। আলেয়ার মন খারাপ, তাই আমার অভিমানকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাপা দিলাম।
এক সময় আমি বললাম, ‘আলেয়া, চল বাড়ি যাই।’
আলেয়া হাঁ বা না কিছুই বললো না। জায়গা ছেড়ে উঠলোও না। আগের মতোই ভাবলেশহীন শুন্য দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল পুকুরের ঘোলা পানির দিকে। প্রকৃতির মতো নিরব নিস্তব্ধ তার উপস্থিতি। পাশাপাশি বসে থেকেও নিজেকে আমার একা মনে হতে লাগলো।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে আলেয়ার হাত ধরে বললাম, ‘কী রে যাবি না? সন্ধ্যে হয়ে এলো। চল্, বাড়ি যাই।’
আলেয়ার কোন ভাবান্তর নাই। হাতও ছাড়িয়ে নিল না। একইভাবে চুপচাপ বসে রইল সে। আমি ওর কাছে থাকি বা না থাকি তাতে যেন ওর কিছু যায় আসে না। আমার উপস্থিতিটাই সে ঠিক মতো উপলব্ধি করছে কী না কে জানে? শেষ পর্যন্ত অসহায়ের মতো বললাম, ‘আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি কিন্তু।’ আলেয়া তবু নিশ্চুপ। আমি ঘাটের কয়েক ধাপ উপরে উঠে বললাম, ‘চলে গেলাম কিন্তু।’

এবার কাজ হয়েছে বলে মনে হলো। আলেয়া উঠে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির কয়েক ধাপ ডিঙ্গিয়ে এসে আমার একটা হাত চেপে ধরলো। তারপর আমাকে টেনে আগের জায়গায় নিয়ে গেল। সিঁড়ির ওপর আমাকে জোর করে বসিয়ে পাশাপাশি বসে আমার ঘাড়ে মাথা রেখে সে কান্নাভেজা স্বরে বললো, ‘তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে আমি কোথায় যাবো, বলো তো? আর একটু থাকো না আমার কাছে!’

মধুপুরে সন্ধ্যা নেমেছে। আঁধারের কালো চাদরে ধীরে ধীরে ঢেকে যাচ্ছে পৃথিবী। বাঁশের ঝাড়ে মিটি মিটি আলো জ্বেলে নাচানাচি শুরু করেছে জোনাকিরা। চারদিকে নিঃসীম নিস্তব্ধতার মাঝে ক্লান্তিহীন ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। আমার ঘাড়ে মাথা রেখে চুপচাপ বসে আছে আলেয়া।
**********************************************************
আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-১৭)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:৩২
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×