somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-১৮)

২১ শে নভেম্বর, ২০১৯ ভোর ৫:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-১৭)

বসন্ত নাহি এ ধরায় আর আগের মতো
জ্যোৎস্নাযামিনী যৌবনহারা জীবনহত
আর বুঝি কেহ বাজায়না বীণা
কে জানে কাননে ফুল ফোটে কিনা

দেশ স্বাধীন হলো। চার দিকে স্বামীহারা, সন্তানহারা, ভাইহারা, ইজ্জতহারা অসহায় নারীর কান্না। লুটতরাজে ছিন্নভিন্ন, আগুনে পোড়া শুন্যভিটায় ফিরে সর্বহারা আদম সন্তানরা কাঁদছে। পেছনে রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত ফেলে আসা জীবন। সামনে বেঁচে থাকার অনন্ত সংগ্রাম। আবার নতুন করে ধরতে হবে জীবনতরীর হাল। এক সংগ্রাম শেষ হয়ে শুরু হলো আরেক সংগ্রাম। এই তো জীবন!

স্বাধীন দেশে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছি। এ সময় হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ার মতো প্রচণ্ড ঝটকায় আমার জীবনে এক ভয়ংকর ছন্দ পতন ঘটলো। পাড়ার মাঠে সামান্য ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে আমাদের পাশের পাড়ার ছেলেদের সাথে মারামারি হলো। এই ঘটনায় বাম চোখে আঘাত পেয়ে পাশের পাড়ার একটি ছেলে হাসপাতালে ভর্তি হবার পর জানা গেল তার চোখের কর্নিয়া গলে গেছে। সে ঐ চোখে আর কোনদিন দেখতে পাবে না। ছেলেটির বাবা ছিলেন পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

ঘটনার দুই দিন পর পুলিশ রাতের বেলা বাড়ি ঘেরাও করে আমাকে গ্রেপ্তার করলো। হাতকড়া লাগিয়ে তারা আমাকে নিয়ে গেল থানা হাজতে। সেখানে গিয়ে দেখি, আমাদের পাড়ার আরো কিছু ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ সেদিন খেলার মাঠে ছিলই না। পুলিশ আমাদের সবাইকে প্রচণ্ড মারধোর করলো। রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে আমাদের চোখ গেলে দেওয়ার ভয় দেখালো। আমার দুই কাঁধে আস্ত ইট দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করায় সেখানে রক্ত জমে গেল। কাঁধসহ দুই হাত ফুলে গেল। আমি খেলায় ছিলাম, তবে ঐ ছেলেটিকে কোন আঘাত করিনি। এ কথা বহুবার বলেও আমি তাদের হাত থেকে রেহাই পেলাম না। পরদিন ‘এ্যাটেম্পট্ টু মার্ডার’ ও দণ্ডবিধির ৩২৬ ধারায় মামলা দিয়ে আমাদের সবাইকে কোর্টে চালান করে দেওয়া হলো।

আব্বা জামিনের আবেদন করলেন। কিন্তু জামিন হলো না। আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে। আব্বা অনেক চেষ্টা চরিত্র করে জেলের ভেতরের হাসপাতালে আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন এবং জেলগেটে আমার সঙ্গে দেখা করে অভয় দিয়ে বললেন, ‘ঘাবড়িয়ো না বাবা। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো। আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে জামিনে বের করে আনবো।’

এরপর শুরু হয়ে গেল পুলিশের ক্ষমতার সাথে আব্বার আইনী জ্ঞানের লড়াই। এই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত আব্বাই জিতলেন। তবে ততদিনে জেলের ভেতর আমার ছয় মাস কেটে গেছে। জামিনে মুক্ত হয়ে বাইরে এসে জানলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় পার হয়ে গেছে। আমার শিক্ষা জীবন থেকে ঝরে গেছে একটা বছর। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এই ছয় মাসে আরো কিছু ঘটনা ঘটেছে। আমার মন খারাপ হবে এবং জেলের ভেতর নিঃসঙ্গ অবস্থায় আমি কষ্ট পাবো বলে আমাকে সেসব জানানো হয়নি। সময়টা ছিল ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাস। আমি জেলে যাবার একমাস পর মধুপুরে আমার দাদাজান ইন্তেকাল করেছেন। আর তার মাত্র পনের দিন পর আমার তিন মাসের পালক মা, আমার স্নেহময়ী, মমতাময়ী বড় চাচীমা মাত্র দু’দিনের জ্বরে ভুগে এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। মৃত্যুর আগে তাঁর জবান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবু তিনি নাকি একবার অস্পষ্টভাবে আমার নাম উচ্চারণ করেছিলেন। হয়তো আমার মমতাময়ী মা একবার আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন। বহু বছর পর আমি জানতে পারি যে, মা আমার টিটেনাস হয়ে মারা গিয়েছিলেন।

সারা দুনিয়াটা টলে উঠলো আমার চোখের সামনে। ছোট শিশুর মতো আমি হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললাম। জন্মদাতা মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে গিয়ে নিজেই কেঁদে ফেললেন। ছয়মাস জেলে থেকে অপর্যাপ্ত খাবার আর অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে এবং তার আগে পুলিশি নির্যাতনের কারণে আহত শরীরের সুষ্ঠু চিকিৎসা না হওয়ায় আমি এমনিতেই খুব দুর্বল ছিলাম। তার ওপর এই দুটি অপ্রত্যাশিত মৃত্যু আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। এই অবস্থায় আমি কখন যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছি জানিনা।

দীর্ঘ আঠাশ ঘণ্টা পর রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বেডে শুয়ে আমার যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন আমি কে, কোথায় আছি, কেন আছি, আমার আশে পাশে এরা কারা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। মাথার ভেতরটা একেবারে শুন্য। নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে কোন উপলব্ধি ছিল না। প্রায় দুই সপ্তাহ চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আমি দুর্বল ও বিধ্বস্ত দেহ মন নিয়ে আব্বা ও বড়ভাইয়ের সাথে বাসায় ফিরলাম।

আমার অনুভূতিশক্তি ভোঁতা হয়ে গেছে। ছয় মাসের জেল জীবন এবং মা ও দাদাজানের মৃত্যু কোন কিছুই আর স্পর্শ করেনা আমাকে। আমার জীবনে এসব ঘটনার প্রভাব কী বুঝতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। মাসে মাসে মামলার তারিখ পড়লে যন্ত্রের মতো আব্বার সাথে কোর্টে গিয়ে হাজিরা দেই আর সারাদিন ঘরে বসে একা একা বিড় বিড় করে আমি নিজের সাথে নিজেই কথা বলি। জেলখানায় চাঁদ মিয়া নামে এক কয়েদির সাথে আমার সামান্য খাতির হয়েছিল। তার নাম ধরে ডেকে দুপুরের রুটি দিতে বলি। সে সময় জেলে ভাত দেওয়া হতো না। তিন বেলাই রুটি। সকালে একখানা, দুপুরে ও রাতে দুইখানা করে। সাথে পানির মতো পাতলা ডাল। চাঁদ মিয়া জেলের রান্নাঘরে কাজ করতো। সে আমাকে লুকিয়ে একটা দুটো বাড়তি রুটি দিয়ে যেত। সে রুটি রান্নাঘর থেকে চুরি করা। কিন্তু তাতেও আমার পেট ভরতো না। পেটে ক্ষুধা আর শরীরে অসহ্য ব্যথা নিয়ে সারারাত আমার ঘুম হতো না।

আমার অস্পষ্ট কথাবার্তার মধ্যে চাঁদ মিয়ার নাম শুনে মা একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘চাঁদ মিয়া কে বাবা?’
‘ম্যাট। না, না, রাইটার। না, না, ম্যাট।’
আমার এসব কথা মায়ের কাছে আবোল তাবোল বলে মনে হলো। তিনি কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে গেলেন। আমার মানসিক চিকিৎসার জন্য পাবনায় নিয়ে যেতে তিনি আব্বাকে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। তখনকার দিনে মানসিক চিকিৎসার একমাত্র উপায় ছিল পাবনার পাগলা গারদ। এখনকার মতো তখন রাজশাহী শহরে কোন সাইকিয়াট্রিষ্টের প্রাইভেট চেম্বার বা ক্লিনিক ছিল না। মায়ের পীড়াপীড়িতে আব্বা চিন্তায় পড়ে গেলেন। বললেন, ‘আচ্ছা, আর ক’টা দিন দেখি।’
এভাবে কয়েক মাস যাওয়ার পর ১৯৭৪ সালের সম্ভবত মার্চ এপ্রিল মাসের দিকে আমি কিছুটা স্বাভাবিক হলাম। মাকে বললাম, ‘আমি মধুপুর যাবো।’
মা বললেন, ‘আর ক’টা দিন পরে যাও বাবা। তোমার শরীর এখনো খুব দুর্বল।’
আমি চিৎকার করে বললাম, ‘না, না, না, আমি এখনই যাবো।’
মা ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা আচ্ছা, বাবা। ঠিক আছে। তোমার আব্বা বিকেলে কোর্ট থেকে আসুক। আমি তোমার মধুপুর যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।’
আব্বা বিকেলে কোর্ট থেকে ফিরলেন খারাপ সংবাদ নিয়ে। আমার জামিন বাতিল করে ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়েছে। আমার বর্তমান শারীরিক ও মানসিক অবস্থায় আবার জেলে গেলে আমি আর বাঁচবো না। নতুন করে জামিন করিয়ে তারপর আমাকে মধুপুর নিয়ে যাবেন বলে আব্বা কথা দিলেন। বড়ভাইও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝাতে লাগলেন। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকলেন।

মধুপুর নয়, আমার গন্তব্য হলো চট্টগ্রাম। সেখানে আমার এক দূর সম্পর্কীয় মামা এক তেল কোম্পানিতে (সম্ভবত শেল অয়েল) চাকরি করতেন। রাতের আঁধারে মা এবং বড়ভাই আমাকে নিয়ে ট্রেনযোগে রওনা হলেন চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। সেখানে পাঁচলাইশ এলাকায় আমার সেই মামার বাসায় আমাকে ও মাকে রেখে বড়ভাই ফিরে গেলেন রাজশাহী। চট্টগ্রামে পাঁচ ছয় মাস আমি আত্মগোপনে থাকলাম। সেখানে একজন সাইকিয়াট্রিষ্টকে দিয়ে আমাকে দেখানো হলো। তিনি কিছু ওষুধপত্র দিলেন। ওষুধ খেয়ে আমি সারা দিনরাত বেঘোরে ঘুমাতাম। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আরো একটা মৌসুম পার হয়ে গেল। ঝরে গেল আমার জীবন থেকে আরো একটি বছর।

আব্বা প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও আমার জামিন করাতে পারছিলেন না। উল্টো হাকিমের কড়া নির্দেশ ছিল একটি নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে পলাতক আসামীকে কোর্টে হাজির করাতে না পারলে বেলবন্ডের জামানত বাজেয়াপ্ত হবে এবং জামিনদারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আব্বা ঘন ঘন পিটিশন দিয়ে আসামী হাজির করার তারিখ পেছাতে লাগলেন। গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে গোপনে আমার আত্মীয়স্বজনের ঠিকানায় খোঁজ করা হচ্ছিল। পরে জানতে পেরেছি মধুপুরেও খোঁজ করা হয়েছিল। আব্বা ঝুঁকি না নিয়ে মা সহ আমাকে চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে রাজশাহীর পুঠিয়ায় নিয়ে এলেন। সেখানে আব্বার এক বিশ্বস্ত মক্কেলের গ্রামের বাড়িতে আরও কয়েক মাস লুকিয়ে থাকলাম। তখন আত্মীয়স্বজনের বাসায় থাকার চাইতে অনাত্মীয়ের বাসায় থাকা ছিল আমার জন্য নিরাপদ। এভাবে প্রায় বছর খানেক এখানে সেখানে পালিয়ে থাকার পর একটা সুসংবাদ পাওয়া গেল। নতুন হাকিম আব্বাকে কথা দিয়েছেন, আসামী কোর্টে আত্মসমর্পণ করলে তাকে জামিন দেওয়া হবে। একজন সিনিয়র এ্যাডভোকেটের ছেলে বলে এই খাতিরটুকু করতে তিনি রাজি হয়েছেন। কিন্তু আসামীর অনুপস্থিতিতে জামিন দেওয়া যাবে না। আব্বা আমাকে কোর্ট স্যারেন্ডার করিয়ে জামিন নিলেন। কিন্তু ততদিনে আমার জীবন থেকে আরো একটা শিক্ষা বছর ঝরে গেছে।

তিন বছর ‘ব্রেক অফ স্টাডি’ সত্ত্বেও পরের বছর আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। ১৯৭২ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম ১৯৭৬ সালে। সে সময় সাধারণত দুই বছরের বেশি ‘ব্রেক অফ স্টাডি’ বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাউ করা হতো না। তখন রাকসুর ভি,পি, ছিলেন আব্বার ঘনিষ্ঠ কলিগ এ্যাডভোকেট আশরাফ খোন্দকার সাহেবের ছেলে ফজলে হোসেন বাদশা (বর্তমানে সংসদ সদস্য)। বাদশা ভাই ভাইস-চ্যান্সেলরের স্পেশাল ডিসক্রিশনারি ক্ষমতার আওতায় পারমিশন বের করে আমাকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তাঁর এই উপকারের কথা আমি জীবনে কখনো ভুলবো না।

ইতিমধ্যে মামলার শুনানী ও সাক্ষ্য প্রমান শেষে আদালতের রায়ে আমি নির্দোষ প্রমান হওয়ায় বেকসুর খালাস পেয়েছি। আব্বা আমার মামলায় জান বাজি রেখে লড়ে আমাকে মুক্ত করেছেন। এ্যাডভোকেট আশরাফ খোন্দকার, এ্যাডভোকেট মুরাদ সাহেব(পুরো নাম মনে নাই), এ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলীদের মতো জাঁদরেল উকিলসহ রাজশাহী বারের প্রায় সব উকিল আব্বার সাথে সাথে একযোগে আমার পক্ষে মুভ করেছিলেন।
পুলিশের অনৈতিক ক্ষমতার দাপট ভেঙ্গে দিতে তাঁরা সবাই আমার পক্ষে লড়াই চালাতে গিয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন আদালত প্রাঙ্গন। সেদিনের কথা মনে হলে সেইসব শ্রদ্ধেয় আইনজীবীদের প্রতি আমার মাথা হেঁট হয়ে আসে, আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। তাঁরা কেউ আর এখন বেঁচে নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের সবাইকে যেন বেহেশত নসিব করেন। এই লেখায় তাঁদেরকে স্মরণ করতে পেরে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। তাঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই।

পাঠক, আপনারা আলেয়ার কথা জানতে চাইছেন তো! আমি বুঝতে পারছি। শুনুন তাহলে সেই হতভাগীর কথা।
বড় চাচীমার মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস পর বড় চাচা আবার বিয়ে করেন। এরপর আলেয়ার ওপর শুরু হয় তার সৎ মায়ের অমানুষিক নির্যাতন। এই মহিলার চেহারার মতো তার মন মানসিকতাও ছিল কুৎসিত। আলেয়াকে সে প্রতিদিনই মারধোর করতো। আলেয়ার সেই লম্বা চুলগুলো ধরে তার সৎ মা তাকে মাটিতে শুইয়ে ফেলে বুকের ওপর পা তুলে দিত। এসব কথা যদি আমি আগে জানতে পারতাম আর সেখানে উপস্থিত থাকতে পারতাম, তাহলে আল্লাহর কসম, আমার দুই মায়ের কসম, আমি ওই কুৎসিত মহিলাকে নিশ্চিত খুন করে ফেলতাম। আমার এই ক্রোধ বুকের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছি বছরের পর বছর। আলেয়ার ওপর সেই অত্যাচারের কথা কথা মনে হলে আজও আমি রাগে থর থর করে কাঁপি। আমার বুকের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ক্রোধ আর অশ্রুর নিষ্ঠুর পীড়নে আমি তখন আর মানুষ থাকি না। মনে হয়, ছুটে গিয়ে এখুনি খুন করে আসি ঐ কদাকার মহিলাকে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার কী জানেন, আমি না পারলেও আমার হয়ে প্রকৃতি নির্মম প্রতিশোধ নিয়েছে ঐ মহিলার ওপর। বিষধর সাপের কামড় খেয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে ডাইনিটা।

মার খেতে খেতে আলেয়া শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। চোখের নিচে কালি পড়ে। যে সরকার বাড়ির দানা খেয়ে একসময় অসংখ্য মানুষ বেঁচে থেকেছে, সেই সরকার বাড়ির আদুরে কন্যা আলেয়াকে প্রায়ই অনাহারে থাকতে হতো। মেজ ও ছোট চাচীমা আলেয়ার ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করলে বা তাকে দু’মুঠো খেতে দিলে আলেয়ার সৎ মায়ের সাথে তাদের তুমুল ঝগড়া লেগে যেত। ঝগড়ায় কখনো তারা ঐ কুৎসিত মহিলার সাথে পেরে উঠতেন না।
বড় চাচার সামনে এসব না ঘটলেও তিনি সবই জানতেন। একেবারে যে তার সামনে কিছু ঘটতো না তাও না। কিন্তু বড় বিচিত্র এই দুনিয়া! তিনি নাকি মেয়েকে সৎ মায়ের অত্যাচার থেকে বাঁচানোর জন্য তাকে বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বিদায় করার সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে (তারিখ জানা নাই) অন্য জেলার একই রকম গণ্ডগ্রামের এক অতি দরিদ্র গৃহস্থ পরিবারে আলেয়ার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়েটা হয়েছিল প্রায় গোপনে এবং কোন রকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই। বিয়ের মাত্র ষোল সতের দিন পর ঘুমন্ত অবস্থায় বিষধর সাপের কামড় খেয়ে মারা যায় আলেয়ার সৎ মা। আমি তখন চট্টগ্রামে মামার বাসায় আত্মগোপনে ছিলাম। মাও ছিলেন আমার সাথে। আমরা কেউ কিছু জানতে পারিনি। আব্বা তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদেরকে আলেয়ার বিয়ের সংবাদ দিতে সাহস পাননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে আমি তিন বছরের জুনিয়র ছেলেদের সাথে ক্লাস করি। মনটা কখনোই ভালো থাকে না। আমার সব সময় মনে হয় শুধু দাদাজান ও বড় চাচীমার মৃত্যুই নয়, মধুপুরে আরো কিছু ঘটেছে যা আমি জানি না। আমি সব সময় একটা উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকতাম। পড়াশুনায় মন বসাতে পারতাম না। একদিন আব্বা ও মায়ের সামনে মধুপুর যাওয়ার কথা বললাম। তাঁরা নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করে প্রথমে একটু থমকে গেলেন। তারপর আব্বা বললেন, ‘বেশ যাবে। তোমার ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষাটা শেষ হোক, তারপর আমরা সবাই মিলে যাবো। ঠিক আছে?’
চট্টগ্রামে মানসিক রোগের চিকিৎসায় কিছুটা উন্নতি হলেও নিউরোসিস প্রবলেমের কারণে তখনো আমার ব্যক্তিগত আচার আচরণের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা ছিল। আব্বা সেটা ঠিকই লক্ষ্য করতেন। পুলিশি নির্যাতন, জেল হাজত, মামলা মোকদ্দমা, পরাশুনায় ছেদ, দাদাজান ও বড় চাচীমার মৃত্যু ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে স্বাভাবিক হতে যে আমার আরো সময় লাগবে, এটা তিনি বুঝতে পারতেন। তাই ঐ অবস্থায় আমি মধুপুরে যাই সেটা তিনি চাইতেন না। তার ওপর সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটা ছিল, তা’ হলো আলেয়ার বিয়ে হয়ে যাওয়ার খবর আমি জানিনা। মধুপুর গেলে অবশ্যই তা’ জানতে পারবো। তখন আমার প্রতিক্রিয়া কী হবে কে জানে? মানসিক সমস্যা এসব ক্ষেত্রে বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। আব্বা এ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন।

আব্বার কথা শুনে সেদিন আমি আর কিছু না বললেও দু’দিন না যেতেই আমি আবার অস্থির হয়ে গেলাম। মাকে বললাম, ‘মা, আমি মধুপুর যাবো। আমার মায়ের কবর দেখবো, দাদাজানের কবর দেখবো। আব্বাকে বলে তুমি আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করো না, মা! তোমার পায়ে পড়ি।’ বলতে বলতে আমি সত্যি সত্যিই মায়ের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম।
মা অশ্রুসজল চোখে আব্বার সাথে কথা বললেন। আব্বা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষকের (আব্বার ক্লায়েন্ট ছিলেন) সাথে আলোচনা করলেন। কিন্তু তাঁর দুশ্চিন্তা দূর হলো না। এদিকে আমার ক্লাসে যাওয়া আসা অনিয়মিত হয়ে গেল। ইচ্ছা হলে কোনদিন যাই, ইচ্ছা না হলে যাই না। পরে ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা দেওয়ার সময় আমার পারসেন্টেজ না থাকায় সমস্যায় পড়লাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সহযোগিতায়, বিশেষ করে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ থেকে আসা বোর্ড স্ট্যান্ড করা ছাত্র ফেরদৌস হোসেনের আন্তরিক চেষ্টায় বিভাগীয় চেয়ারম্যান পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি দিলেন। তবে শর্ত জুড়ে দিলেন, দিস্ ইজ দ্যা ফার্স্ট এ্যান্ড লাস্ট টাইম। পড়াশুনা নাই, প্রস্তুতি নাই, তারপরেও কিভাবে কিভাবে যেন ফার্স্ট ইয়ারে আপার সেকেন্ড ক্লাস নম্বর পেয়ে পাশ করেছিলাম। এতে ফেরদৌসের অবদান ছিল অপরিসীম। সে আমার পেছনের জীবন ও তৎকালীন মানসিক অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা জানতো। সে নিজে খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমার দুর্বল দিকগুলো, বিশেষ করে স্ট্যাটিস্টিকস, ক্যালকুলাস ও ডাইনামিকসের অংকগুলো শিখিয়ে পড়িয়ে পরীক্ষার জন্য আমাকে প্রস্তুত করে তুলেছিল। তিন বছরের জুনিয়র হলেও সে ছিল আমার সত্যিকারের বন্ধু। আমার পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ফেরদৌস ছিল একাধারে আমার বন্ধু, সহপাঠী, গাইড, শিক্ষক ও পথ প্রদর্শক। সে না থাকলে হয়তো অর্থনীতিতে স্নাতক হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। বন্ধু, তুমি যেখানেই থাকো, ভালো থেকো। তোমার কথা আমি কখনো ভুলবো না বন্ধু।

যা হোক, আগের কথায় ফিরে যাই। মধুপুরে যাওয়ার ব্যাপারে আব্বার গড়িমসি এবং আমার মানসিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হলো। সময়টা আমার জন্য ছিল দারুন কষ্টের। মাঝে মাঝে মনে হতো কাউকে কিছু না বলে আমি একা একাই মধুপুর চলে যাই। কিন্তু আমরা ভাই বোনরা কোনদিনই বাবা মার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করিনি। তাই পাহাড় সমান কষ্ট আর জ্বালা বুকে ধারণ করে আমি সময়টা পাড়ি দিলাম।
পরীক্ষা যেদিন শেষ হলো, সেদিন রাতেই আমি আব্বা ও মা দু’জনের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘পরীক্ষা শেষ হলে তোমরা আমাকে নিয়ে যাবে বলেছিলে। কাল আমাকে মধুপুরে নিয়ে যাও। তোমাদের আল্লাহর কসম, আমাকে আমার মায়ের কবরের কাছে নিয়ে যাও। একবারের জন্য নিয়ে যাও, মা।’
মা কাঁদতে লাগলেন। আব্বা আশ্বাস দিলেন, আগামী রবিবার আমাকে ও মাকে নিয়ে তিনি মধুপুর যাবেন। আব্বার কোর্ট কামাই দেওয়া যাবে না। গুরুত্বপূর্ণ মামলা আছে। তাই রবিবার ছুটির দিন সকালে গিয়ে আবার বিকেলে ফিরে আসতে হবে। এখন যাতায়াত ব্যবস্থা কিছুটা উন্নত হওয়ায় সেটা সম্ভব। রাজশাহী-নওগাঁ রুটে বাস সার্ভিস চালু হওয়ায় নওহাটা পর্যন্ত বাসে যাওয়া যায়। নওহাটা থেকে পূর্বে ভবানীগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তার বারো তের মাইল হেরিং বন্ড বোন করা হয়েছে। নওহাটায় কিছু লক্কর ঝক্কর পুরাতন জীপগাড়ি এখন ভাড়া পাওয়া যায়। রিজার্ভ করে নিলে তারা একদম মধুপুর পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। সাকুল্যে সময় লাগে তিন চার ঘণ্টার মতো।

রবিবার আসতে দু’দিন বাঁকি। আমার অস্থিরতা যেন আর কাটে না। ইচ্ছা করলে তো আব্বা পরের দিনই যেতে পারতেন। একদিন কোর্ট কামাই গেলে কী হয়? কোর্টে যাওয়া আসা করে দেখেছি, প্রয়োজনে একজন উকিলের কাজ অন্য উকিল করে দেয়। জরুরী মামলা থাকলে আব্বা সে ব্যবস্থা করতে পারতেন।
আসলে আব্বা এই দু’দিন সময় নিয়েছিলেন অন্য কারণে। সেটা বুঝতে পারলাম পরদিন মা যখন অহেতুক আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে শুরু করলেন, তখন।
আমি বললাম, ‘মা, তুমি এত আদর করছো কেন? কী হয়েছে বলো তো!’
মা বললেন, ‘মধুপুর যাওয়ার আগে তোমাকে একটা কথা বলা খুবই জরুরী। কিন্তু তুমি হয়তো কান্নাকাটি করে ভেঙ্গে পড়বে, তাই বলতে সাহস পাচ্ছি না, বাবা।’
আমার ইনটুইশন ক্ষমতা বরাবরই বেশ ভালো ছিল। শত বিপর্যয়ের মধ্যেও সেটা হারিয়ে ফেলিনি। মায়ের এ কথা শোনা মাত্র আমি বুঝে ফেললাম কী হয়েছে। আমার বুকের ভেতর বাঁ দিকে খচ্ করে একটা কাঁটা ফোটার মতো হলো। বহু কষ্টে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, ‘ও, তুমি আলেয়ার বিয়ে হয়ে গেছে এই কথা বলবে তো?’
মা বোধহয় একটা বৈদ্যুতিক শক খেলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘তুমি জানো?’
আমি বললাম, ‘না, জানতাম না। অনুমান করে বলেছি।’

মা তখন আলেয়ার সৎ মায়ের অত্যাচারের কথা এবং আলেয়ার বিয়ের কথা সব খুলে বললেন আমাকে। আলেয়ার বিয়ে খুব গোপনে হলেও ছোট চাচীমা জানতে পেরে বাধা দিয়েছিলেন। তিনি আলেয়ার বাপকে আমার কথা ও দাদাজানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বড় চাচার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, যে ছেলেকে পুলিশ খুঁজে বেড়ায় এবং যে ছেলে জেল খাটে, সে কখনো ভালো ছেলে হতে পারে না। দাদাজান যতই বলুক, আমার সাথে তিনি আলেয়ার বিয়ে দেবেন না।
এসব খুঁটিনাটি সব কিছু আমাকে খুলে বলার পর মা আমার দুই হাত চেপে ধরে করুণ কণ্ঠে অনুরোধ করলেন, এ নিয়ে মধুপুরে গিয়ে আমি যেন কোন প্রতিক্রিয়া না দেখাই। বললেন, ‘তোমার দোহাই লাগে, বাবা। তোমার হাতে পায়ে ধরি। আমার বুকের এক ফোঁটা দুধও যদি তুমি খেয়ে থাকো তো আমার এই অনুরোধটা রাখো বাবা। তোমার মায়ের আর দাদার কবর জিয়ারত করে চুপচাপ আমাদের সাথে চলে এসো সোনা। সব অন্যায়ের বিচার একদিন আল্লাই করবেন।’
বলতে বলতে তিনি নিজেই কেঁদে ফেললেন এবং যা তিনি কোনদিন করেননি, আমার গালে ও কপালে একের পর এক চুমু দিয়ে যেতে লাগলেন। আমি পাথরের মতো অনড় হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম মায়ের দিকে।

আমার আর এক মায়ের কথা মনে পড়লো। আমাকে গর্ভে না ধরেও যিনি এভাবে আদর করতেন আমাকে। ছায়াছবির মতো আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক মমতাময়ী মা তাঁর তিন মাসের শিশু সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। গর্ভধারিণী মায়ের হাতে তাকে তুলে দিয়ে হাহাকার করছেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে পাগলের মতো তিনি ছুটে আসছেন জন্মদাতা মায়ের কোলে শুয়ে থাকা তাঁর কলিজার টুকরার পিছে পিছে। শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটাচ্ছে। উঁচু নিচু ভাঙ্গাচোরা পথে হোঁচট খেয়ে পড়ছেন। দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য এক অবুঝ নারী। তাঁর সন্তানকে হারিয়ে উদভ্রান্তের মতো ছুটে চলেছেন তিনি।
দুধ, কলা, আম আর চিঁড়া মুড়ি সাজিয়ে সন্তানের জন্য বসে আছেন মা। কখন তাঁর ছেলে খেতে আসবে সেই অপেক্ষায় হাতপাখা দিয়ে খাবারের মাছি তাড়াচ্ছেন তিনি।
রান্না করা সবচে’ বড় মাছের টুকরোটা হাঁড়ি থেকে তুলে বাটিতে নিয়ে ঘরে লুকিয়ে রেখেছেন মা। তাঁর ছেলে খাবে। আর তিনি সামনে বসে প্রাণ ভরে দেখবেন।
মায়ের ডাক এসেছে। যেতেই হবে। যে দেশে যাবার পর কেউ আর ফেরে না। মা বলছেন, আমার ছেলেকে তোমরা শুধু একবার দেখতে দাও। দেখাবার অনুমতি নেই। বুক ভরা হাহাকার আর কষ্ট নিয়ে দুনিয়া থেকে চলে গেলেন মা। নিষ্ঠুর পৃথিবী তাঁর কোন দুঃখই বুঝলো না। বুঝলেন না বিধাতাও।

আব্বার উদ্দেশ্য ছিল মধুপুর যাওয়ার আগে আলেয়ার ঘটনাটা জানিয়ে এই দুইদিন আমার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা। নেতিবাচক কিছু না ঘটলে আমাকে নিয়ে তিনি মধুপুর যাবেন। আব্বার এই পরীক্ষায় আমি পাশ করলাম। স্বাভাবিকভাবে দু’দিন খাওয়া দাওয়া করলাম। আমার আবেগের ভাণ্ডার ছিল শূন্য। তাই কোন আবেগ নাই। এই দুই দিন ‘আলেয়া’ শব্দটি আমি একবারও উচ্চারণ করলাম না। যেন এই নামটা আমি কোনদিন শুনিনি। এই নামের কাউকে আমি চিনি না।

আব্বার চেহারা দেখে বেশি কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু মায়ের চেহারায় উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট। দু’দিন ধরে সংসারের কাজকর্মে তাঁর মনোযোগ নাই। সবসময় তিনি আমার কাছাকাছি থাকেন। আমার যখন যা প্রয়োজন সাথে সাথে তা’ হাজির করেন। কোন কারণে আমি যাতে বিরক্ত না হই, সেদিকে তাঁর কড়া নজর। অথচ ছেলেমেয়েদের দেখভালের ব্যাপারে তাঁকে এত যত্নশীল হতে কোনদিন দেখিনি। সত্যি কথা বলতে কী এটা তাঁর স্বভাবের সাথে যায় না। আমরা ভাই বোনরা অনেকটা সেলফ-মেইড। নিজেরাই ভাত বেড়ে খেয়ে নিই, নিজেদের কাপড় চোপড় নিজেরাই গুছিয়ে রাখি। কোনদিন ভাত খেতে দেরি হলে ‘কী রে, এখনো ভাত খাসনি কেন?’ বলে তিনি নিজের কাজে চলে যান। আসলে এত ছেলেমেয়ের ঐ ভাবে দেখাশুনা করাটাও খুব কঠিন ছিল তাঁর জন্য।
কিন্তু এই দু’দিন মা যেন অন্যরকম। নিজের রক্ত যখন ক্ষরণ হয়, তখন মায়ের মন পাগল হয়ে যায়। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় মা তখন অস্থির হয়ে যান। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য মা তখন নিজের জীবন দিতেও দ্বিধা করেন না। আমার মাও তো মা। ছেলের এই দুর্যোগে তিনি স্থির থাকেন কিভাবে? তাঁকে দেখে মনে হয় যেন সব সময় তিনি চরম অস্থিরতায় ভুগছেন।

বড়ভাইয়ের চরিত্রে দুশ্চিন্তা বলে কোন ব্যাপার নাই। এতদিন সেরকমই দেখেছি। কিন্তু সেই মানুষটিও সব সময় চিন্তাগ্রস্থ থাকেন। আমি বই পড়তে ভালোবাসি বলে তিনি এই দু’দিন লাইব্রেরী থেকে নতুন নতুন বই এনে দিতে লাগলেন। আমার মুখে একটু হাসি দেখার জন্য তিনি তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকেন। কিন্তু আমার মুখে হাসি আসে না। আমার বড় ভাই, আমার রক্ত সম্পর্কের বন্ধু। এমন বন্ধুর সাথেও আমি হেসে কথা বলতে পারি না। আফসোস!
*************************************************************
আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:৩৮
১৬টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×