আগের অধ্যায়
“আচ্ছা ভালোবাসা কাকে বলে?”
নুশরাতের এই প্রশ্ন শুনে আমি সতর্ক হয়ে গেলাম। ডেস্কের উপর মাথা রেখে ঝিমাচ্ছিলাম কিন্তু তার এই প্রশ্নের কারনে আমার ঝিমুনি কেটে গেল। সাবধানের সাথে আমি নুশরাতের দিকে তাকালাম। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে এই বিষয় নিয়ে সিরিয়াস।
সুমনা হলে আমি মজা করে বলতাম, তিনটা রুম, একটা ডাইনিং রুম দুই বাথরুম এক বারান্দার ফ্ল্যাট কম ভাড়া মধ্যে পাওয়াকেই ভালোবাসা বলে।
আমি নিশ্চিত এটা শুনে সুমনা রেগে একদম বোম হয়ে যেত। যেসব মেয়ে সহজে রেগে যায় তাদেরকে রাগাতে বেশী মজা পাওয়া যায়। তবে নুশরাতের বেলায় এটা কাজ করে না।
“আমার কোনো ধারনাই নাই,” আমি জবাব দিলাম।
বাস্তবিক ভাবে আমার এই কথা কিছুটা হলেও সত্য।
রুপা আমার কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে করুনার হাসি দিল, তবে কিছুই বলল না। ব্যাপারটা দেখেও না দেখার ভান করলাম।
আজকে এই দুইজন আমার সামনে এসে বসে আছে। ইতিমধ্যেই একটা ক্লাস শেষ হয়ে আছে, এরপর আরেকটা ক্লাস শুরু হবার সময় হয়ে আসছে তখনই নুশরাত এই প্রশ্ন করে উঠল।
“আমার চেয়ে তো নুশরাতের তো ভালো ধারনা থাকার কথা ভালোবাসা সম্পর্কে,” আমি বলে উঠলাম।
তা ঠিক, কারন সে প্রেম করে বিয়ে করেছে। বিয়ে বলতে কাবিননামা ঠিক হয়ে গেছে। নুশরাতের প্রেমিকপ্রবর বিদেশে পড়তে গিয়েছেন, তিনি ফিরে আসলেই সব কাজ পাকাপাকিভাবে হয়ে যাবে।
“তা আমাদের চেয়ে তো তোমারই ভালো ধারনা থাকার কথা ভালোবাসা কি,” আমি বলতে লাগলাম।
“তিনটা রুম, একটা ডাইনিং রুম দুই বাথরুম এক বারান্দার ফ্ল্যাট কম ভাড়া মধ্যে পাওয়াকেই ভালোবাসা বলে।”
হাহ, আমার সংজ্ঞাটাই বলে দিল সে!
আমি অপেক্ষায় ছিলাম তারা দুজন কখন তাদের আসল মতলবটা বের করে কিন্তু তারা আমার সামনে খিল মেরে বসে রইল। আমিও সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আবার ডেস্কের উপর মাথা রাখলাম। ঝিমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম কিন্তু সেটা বেশীক্ষনের জন্য হল না স্যার এসে পড়লেন।
রুপা আর নুশরাত কি ব্যাপার নিয়ে গুজুর-ফুসুর করছে। তাদের একদম পিছনের বসে সেটা আমি শুনতে পাচ্ছিনা। সবচেয়ে বড় কথা তাদের দুজনকে একসাথে বসতে দেখা। এই জিনিষটা একদম ঈদের চাঁদ দেখার মত। সেই ইশরাতের ঘটনার পর থেকে তাদের দুজনকে তেমন একসাথে দেখা যায় না যদি তাদের মাঝে সুমনা থাকে।
নিশ্চয়ই কোনো মতলব নিয়ে তারা পিছনের দিকে বসেছে। নুশরাত সবসময় সুমনার সাথে সামনে বসে আর রুপার এদিক সেদিক বসলেও সে কখনো পিছনের দিকে বসে না। তারা তাদের মতলব নিয়ে থাক, আমি আমাকে নিয়ে থাকি। সময় হলে তারা এমনি বলবে আমাকে।
ক্লাস শেষ হতেই আমি বেঞ্চ থেকে উঠলাম। বসে থাকতে থাকতে আমার কোমড় ধরে গেছে, বাইরে থেকে একটু হাটাহাটি করে আসলে ভালো হয়। দরজার সামনে আসত হাটার ইচ্ছা মরে গেল। আমাদের ক্লাসরুমের বাইরে মাশফিয়া আপু দাঁড়িয়ে আছে। অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু মাশফিয়া আপুর সেদিকে কোনো খেয়াল নেই, সে আমাকে দেখে হাত নাড়ালো। আমিও ঠোটে ঠোট চেপে তার দিকে হাত নাড়ালাম।
আমি খেয়াল করলাম অনেকেই আমার দিকে হিংসার দৃষ্টিতে তাকাল। কারন আছে, মাশফিয়া হচ্ছে কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েদের মধ্যে একজন বলতে গেলে সেই সবচেয়ে বেশী সুন্দরী। প্রতিদিন নাকি তার ডেস্কে প্রেমপত্র পাওয়া যায় তার মধ্যে প্রায় সব হচ্ছে বেওয়ারিশ। সেই মেয়ে যদি আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ায় তাহলে কিছুটা হলেও তো সবাই হিংসা বোধ করবে।
“একেই বোধহয় ভালবাসা বলে,” আমার পিছন দিকে দিকে রুপা বলে উঠল।
আমি তিক্ত স্বরে বললাম, “এটাক ভালবাসা না বিরক্ত করা বলে।”
“ওকে সরাসরি বলে দিলেই তো হয়,” সুমনা আমাদের দিকে এসে বলল।
“মনে হয় না সে মানবে,” আমি বলে উঠলাম।
“বলে দেখেছ?”
“না,” আমি মাথা নিচু করে বললাম।
“আচ্ছা ওর মধ্যে কিসের কমতি আছে যে ওর প্রেমে সাড়া দিতে সমস্যা?” রুপা এবার জিজ্ঞেশ করল।
“সে সুন্দরী সেটা বড় কথা না, তবে তার মধ্যে কিসের যেন কমতি আছে,” আমি বললাম।
“কি সেটা ?”
নিশ্চিত না আমি, মনে মনে বলে উঠলাম, তবে রুপার প্রশ্নের জবাব দিলাম না।
দুজনে দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে আছে। উত্তর পাবার অপেক্ষায়। আমি চুপ করে রইলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে যাওয়াই ভাল যদিও বাইরে মাশফিয়া আপু দাঁড়িয়ে আছে। আমি হুট করে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে গেলাম।
“আরে আমি আমার প্রশ্নের জবাব পেলাম না তো,” রুপা বলে উঠল।
আমি মাশফিয়া আপুর সামনে গেলাম, যদিও ওর সাথে কথা বলার ইচ্ছা আমার একদম ছিল না। অভদ্রতা হয়ে যাবে দেখে তার সামনে গেলাম। সেও আমাকে দেখে এগিয়ে আসল, জিজ্ঞেশ করল, “কি খবর তোমার?”
সে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল, তার হাসির মধ্যে কেমন যেন মেকি মেকি ভাব ছিল।
“আচ্ছা রানা তুমি কি এখন ব্যস্ত আছ ?” মাশফিয়া আপু আমাকে জিজ্ঞেশ করে উঠল।
আমি মাথা নাড়িয়ে না করতে যাচ্ছিলাম তখনই সে বলে উঠল, “আচ্ছা ঠিক আছে লাইব্রেরীতে চল, কথা আছে তোমার সাথে।”
আমার উত্তর শোনার অপেক্ষাও পর্যন্ত করল না সে। সে আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি লাইব্রেরীতে আছি, তাড়াতাড়ি এস কিন্তু।”
এই বলে সে সামনের দিকে হাটতে লাগল।
আমি হা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। হুশ ফিরল সবার বিষদৃষ্টিতে, অনেকেই দেখছি আমার দিকে হিংসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি তাদের জ্বলন্ত দৃষ্টি থেকে বাচার জন্য সামনের দিকে এগোতে থাকলাম।
অনেক ভেবে চিন্তে আমি লাইব্রেরীতে গেলাম। প্রথম প্রথম যাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও পরে মনে হল যাওয়া উচিত। মাশফিয়া আপুকে এড়িয়ে চলে আমার কোনো লাভ হবে না সেটা আমি ভাল করেই বুঝতে পারছি।
লাইব্রেরীতে তেমন কেউ নেই। দুই একজন বসে নিচু গলায় গল্প করছে না হয় বই পড়ছে। লাইব্রেরীর দরজার সামনে দাড়াতেই দেখলাম মাশিফিয়া আপু চুপ করে বসে আছে হাতে একটা বই, তবে সে সেটা পড়ছে না।
আমি সেদিকে হাটতে লাগলাম। আমার পায়ের আওয়াজ শুনে সে বই থেকে মুখ তুলল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এত বই পড় কিভাবে, আমারতো দুই লাইন পড়তে গিয়ে মাথা ঘুরে যাচ্ছে,” এই বলে সে হালকা ভাবে হাসল।
আমি কিছু না বলে তার পাশে বসে পড়লাম। তার উল্টো পাশে বসতে পারতাম কিন্তু টেবিলের মাঝখানে আলাদাভাবে কাঠের পার্টিশন দেওয়া দেখে মুখোমুখি কথা বলা যাবে না। তাই বাধ্য হয়ে তার পাশে বসতে হল।
আমরা দুজন চুপচাপ বসে থাকলাম। কিভাবে কথা শুরু করব সেটা বুঝে উঠতে পারছি না, মাশফিয়া আপুরও মনে হয় একই অবস্থা। সে তার হাতের বই নিয়ে ঘাটাঘটি করছে। দশ-পনের মিনিট এভাবে যাওয়ার পর মাশফিয়া বইটা বন্ধ করে বলল, “চুপ করে আছ কেন ?”
আরে, তুমি তো ডেকে এনেছ কি কথা বলবে আমার সাথে, আমি মনে মনে বলে উঠলাম।
মনে হচ্ছে আমাকেই শুরু করতে হবে, “কিসের জন্য ডেকেছ আমাকে ?” আমি জিজ্ঞেশ করে উঠলাম।
আমার সরাসরি প্রশ্ন শুনে মনে হয় কিছুটা দমে গেল সে। আমার দিকে তাকিয়ে থাকল সে। তার চেহারার মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করছে, কি যেন বলবে বলবে করেও বলতে পারছে না। সে এবার চোখ বন্ধ করে মনে মনে সাহস আনার চেষ্টা করতে লাগল।
আমি বসে বসে তা দেখছি।
“সুমনা কি তোমার পছন্দের সেই মেয়ে?” মাশফিয়া জিজ্ঞেশ করে উঠল।
“কি!?” আমি বলে উঠলাম।
“মানে সুমনাকে কি তুমি পছন্দ কর?”
“কে বলেছে এই কথা ?”
“দেখলেই বোঝা যায়। তোমরা ইদানিং দেখি প্রায়ই একসাথে ঘোরাফেরা কর।”
“একসাথে ঘোরাঘুরি করলেই কি মনে হল আমি তাকে পছন্দ করি ?” আমি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেশ করলাম।
মাশফিয়া আমার প্রশ্নের জবাব দিল না, সে বলে উঠল, “গত মাসে আমি দেখছি তোমাদের নিউমার্কেটে একসাথে ঘোরাঘুরি করতে, নিশ্চয়ই ডেটিংয়ে গেছ।”
“না,” আমি এক কথায় জবাব দিলাম।
“তাহলে কি ?”
“তোমাকে কি সব বলতে হবে নাকি ?”
আমি মাশফিয়ার প্রশ্নের উপর পাল্টা প্রশ্ন করলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, তার চেহারায় বিস্ময়, দুঃখ, রাগ সব একসাথে ফুটে আছে।
সে তার চেয়ার থেকে উঠে গেল। আমার দিকে এবার না তাকিয়ে বলে উঠল, “আমাকে কি তোমার চোখে পড়ে না, সুমনার থেকে আমার কি কম আছে ?”
আমি চুপ করে থাকলাম। নিজের মুখের ভিতর কেমন যেন তেতো একটা ভাব আসল, আসলে আমি বিরক্ত হচ্ছি না রাগ হচ্ছি সেটা বুঝতে পারছিনা। আমি কি মাশফিয়ার উপর রাগ করে আছি? নাকি নিজের উপর?
মাশফিয়া এখনো দাঁড়িয়ে আছে। আমি মাথা নিচু করে চুপ করে থাকলাম।
“রানা শোনো কখনো যদি আমাকে তোমার দরকার হয় তাহলে বিনা দ্বিধায় আমার কাছে চলে এস, আমি অপেক্ষা কর।”
এই বলে মাশফিয়া আপু হাটা শুরু করল, দুই কি তিন কদম হাটার পর সে দাড়াল, “আর আমাকে কখনো আপু বলে ডাকবে না, আর যে কেউ আমাকে আপু বলে ডাকুক আমার সমস্যা নেই, কিন্তু ডাকলে সমস্যা আছে।”
এই বলে সে হেটে চলে গেল।
আমি নিজের চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে থাকলাম।