আগের অধ্যায়
বারান্দায় বসে গান শুনছি। এখন সন্ধ্যা পার হয়ে রাত। মোটামুটি নিরিবিলি হয়ে আছে পুরো এলাকাটা। ঢাকা শহর একটা চঞ্চল জায়গা হলেও আবাসিক এলাকাগুলোতে সন্ধ্যার পর একটা নিরবতা কাজ করে। মাঝে মধ্যে দুই একটা রিকশার টুং টাং আওয়াজ পাওয়া গেলেও নিরবতা সহজে ভাঙ্গে না।
রাতুল নিজের রুমে বসে গেম খেলছে। আপি আসার আগে যতটুকু খেলা যায়। স্কুল থেকে ফিরে আসার পর আমার সাথে কিছু গ্যাজাগ্যাজি করে বিকালের দিকে সে ক্ষান্ত দেয়।
মাশফিয়া আপুর সাথে কথা বলার পর আমি কাউকে না বলে কলেজ থেকে চলে আসি। অবশ্য আসতে অনেক কসরত করা লাগেছে। তারপর থেকে আমি বাসায় ঝিম মেরে বসে আছি। দুপুরে হালকা রান্না করে রেখেছি, দেখি একটু পর আবার রান্না ঘরে যেতে হবে।
আসলে আমি মাশফিয়া আপুর কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাচ্ছি। মুভি দেখা, গেম খেলা, গান শোনা কোনোটাতেই মনোযোগ দিতে পারছি না। বারবার তার কথাই শুধু মনে পড়ছে।
“ইয়ায়ায়া~” এই বলে নিজের গালে হালকা কতগুলো চাপড় মারলাম। হুম, এখন রান্না করতে হবে। আর কালকে রসায়ন ল্যাবের অ্যাসাইনমেন্টটা কমপ্লিট করতে হবে। এই বলে আমি বারান্দা থেকে চলে গেলাম।
“কিরে এমন ফিউজ মেরে আছিস কেন ?”
আপির এই প্রশ্ন শুনে আমার চমক ভাঙল। সে রান্না ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে এবার হাতে রাখা প্লেটের দিকে মনোযোগ দিলাম। সেগুলো পরিষ্কার করতে লাগালাম। আপি আমার কাছে এসে দাড়াল, সে এখন একটা ঢোলা টি-শার্ট আর থ্রী-কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে আছে। আম্মা যদি তাকে এই অবস্থায় দেখত তাহলে একটা দক্ষযজ্ঞ অবস্থা হয়ে যেত।
“কিরে আমার প্রশ্নের উত্তর দিলি না যে ?” আপি আবার প্রশ্ন করল।
“এমনি আজকে মন মেজাজ ভাল নেই,” আমি বললাম।
“হুম।”
এই বলে আপি আমার পাশে দাড়িয়ে থাকল। আমি কিছু বললাম না। আপি আর সাধারন মেয়েদের থেকে কিছুটা লম্বা, আর একহারা ধরনের। শুনেছিলাম ভার্সিটি থাকার সময় সে নাকি প্রায়ি মডেলিং করার প্রস্তাব পেত, কিন্তু সে সেগুলো সব ফিরিয়ে দিয়েছে।
“কিছু বলবি নাকি ?” আমি জিজ্ঞেশ করলাম।
সে একটু চুপ করে বলল, “সোহেল আজকে দেখা করেছে।”
“কি বললেন উনি ?”
“তোর সাথে দেখা করতে চেয়েছে।”
এই, আমি মনে মনে বলে উঠলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম, আরো কথা শোনার জন্য।
“তোর চোখের অবস্থা কি জানতে চেয়েছে।”
“কি বলেছিস তুই।”
“যা বলার কথা তাই বলে দিয়েছি,” আপি হালকা হেসে বলল। যদিও সে হাসিতে জোর ছিল না। সব বাসন-কোসনধোয়া শেষ আমার। আমার কাজ শেষ দেখে আপি রান্নাঘর থেকে চলে যেতে লাগল, আমি বলে উঠলাম, “সোহেল ভাই তোর জন্য ঠিক আছে, অন্য কেউ হলে আমি সেটা মেনে নিতে পারব না।”
আপি আমার কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেল।
আমি আমার কথা চালিয়ে যেতে লাগলাম, “আমাকে নিয়ে এত চিন্তা করা লাগবে না, আমি জানিনা সোহেল ভাই আমাকে নিয়ে কি করতে চায় তবে আমি নিশ্চিত সে আমার খারাপ চাবে না।”
আপি কি যেন বলতে চাইছিল আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম, “আর আমি আমার মত চলতে পছন্দ করব কেউ আমর জীবনের মধ্যে বা হাত ঢোকাক আমি সেটা চাই না। আমি এখন বাচ্চা নেই, একদম সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারি কিন্তু একদম ভুল সিদ্ধান্ত কখনই নিব না আমি।”
আমার এই কথা শোনার পর আপি হেসে উঠল, “কিরে তুই এই সিরিয়াস কথা বলে শিখলি কবে?”
“বয়স তো আর কম হল না আমার,” আমিও হেসে জবাব দিলাম।
“চা বানা, অনেক দিন তোর সাথে ঠিক মত গল্প-গুজব করা হয় না।”
“কিন্তু এখনতো ঘুমানোর সময়।”
“আরে বানাতো আগে, হালকা লিকার দিয়ে লাল চা, আমি বারান্দায় বসে আছি,” এই বলে আপি চলে গেল।
আমি আপি কথা মত চা বানাতে লাগলাম।
“শুনেছি ইদানিং নাকি তুই বেশ কয়েকটা সুন্দরি মেয়েদের সাথে লাইন মারছিস।”
আপি এই কথা আমি একটা বড়সড় বিষম খেলাম। আপির দিকে তাকালাম, সে নির্বিকার ভাবে চায়ের মগে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে।
“কে বলেছে তোকে এই কথা ?” এই প্রশ্ন জিজ্ঞেশ করার পরপরেই আমার মাথায় উত্তরটা এসে গেল।
কে আর হবে ওই তার ছেড়া লায়লা আপু ছাড়া।
“লাইন না, ওরা সব বন্ধু,” আমি বললাম।
“সুমনা দেখতে কেমন ?”
আপি এই প্রশ্ন শুনে আমি এবার বিষম খেতে খেতেও থেমে গেলাম।
“কেন ? কি কারনে ?”
“শুনেছি তোরা নাকি খুব ঘনিষ্ঠ তাই জানতে ইচ্ছে হল।”
“লায়লা আপু কি উড়াধুড়া খবর দেয়াও শুরু করেছে নাকি?”
“উড়াধুড়া কিনা জানিনা, তবে সুমনা নামের মেয়েটা তো তোর ক্লাসের?”
“হ্যা।”
“তোদের ক্লাস ক্যাপ্টেন সে ?”
“হ্যা।”
“মোটামুটি রাগী ধরনের ?”
“হ্যা।”
“সে তোর খুব ক্লোজ ?”
“হ… না এত ক্লোজ না।”
“হুম, বুঝলাম।”
আপি কি বুঝল আমি বলতে পারব না। তবে এখন লায়লা আপুকে ধরা দরকার। আমার নামে ইতিমধ্যে গিট্টু লাগানো শুরু করেছে।
“আর মাশফিয়া?”
ও তাহলে মাশফিয়ার কথাও তুলেছে সে !
“ওর কথা বল না সে একটা যন্ত্রনা, মাথা নষ্ট করে ফেলছে মেয়েটা আমার।”
“হুম,” আপি এই বলে সে তার মগে আরেকটা চুমুক দিল, “শুনেছি সে নাকি অনেক সুন্দরী, নাটক ফাটক করার জন্য বলে ডাক পায়।”
“আমিও শুনেছি,” এই বলে আমিও চায়ের মগে চুমুক দিলাম।
আমি আর আপি এখন বারান্দায় বসে আছি। প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। বলতে গেলে পুরো স্তব্ধ আছে এলাকাটা। হালকা বাতাস বইছে। দিনের বেলার মত দূষিত বাতাস বইছে না এখন। এখন এই সময়ে যে বাতাস পাওয়া যায় সেটা পাওয়া যায় গ্রামের বাড়িতে শুকনো ধানের মৌসুমে, হালকা একটা মিষ্টি গন্ধ থাকে সেখানে। আশে-পাশে কয়েকটা বাড়িতে এখনো লাইট জ্বলছে। তবে অধিকাংশ বন্ধ হয়ে গেছে।
“কলেজে উঠে দেখছি তোর অনেক পাখা গজিয়ে গেছে,” আপি বলে উঠল।
“এটা সবারই গজায়।”
আমার এই কথা শুনে আপি চোখ গরম করে আমার দিকে তাকাল, বলল, “একটা কথা বলি এই বয়সে মেয়েদের সাথে এত গলাগলি করতে যাস না, ফলাফল ভাল হয় না।”
সেটা আমি ভাল করে জানি, আমি মনে মনে বলে উঠলাম।
“সোহেল ভাই কেমন আছে ?” আমি জিজ্ঞেশ করলাম।
“হুম, দেখে তো মনে হ ভালই আছে। আগের চেয়ে তাগড়া হয়েছে।”
“আম্মার কাছে শুনলাম সোহেল ভাইয়ের জন্য বলে একটা মেয়ে ঠিক করেছে খালা।”
খালা মানে আমাদের আপন খালা নয়, তিনি আমাদের পাশের বাসায় থাকেন। সোহেল ভাই হল আমাদের সেই পাশের বাসার বই পড়ুয়া ভদ্র ছেলে যে কিনা এখন বর্তমানে আর্মির মেজর পদে আছেন। আপির থেকে তিনি দুই বছরের বড়। সোহেল ভাইয়ের প্রতি আপির একটা দূর্বলতা আছে অনেক দিন আগে থেকেই কিন্তু বর্তমানে এখন কেন যেন এক ধরনের দূরত্ব বিরাজ করছে ওদের মাঝে।
আমি জানি না কি কারনে আপি সাথে সোহেল ভাইয়ের মন কষাকষি হয়েছে। অনেকেই বলেছিল আপি সাথে একমাত্র সোহেল ভাইকেই বেশী মানায়।
আপি আমার এই কথা শুনে কিছু বলল না। আমিও তার দিকে না তাকিয়ে সামনের দিকে তাকালাম। আমাদের চার ভাই বোনের মধ্যে সেই একটু বেশী চাপা স্বভাবের। সহজের নিজে মনে কোনো কিছুই প্রকাশ করতে জানে না। হয়তো বা এখন সে চুপচাপ বসে আছে। নির্বিকার চেহারা নিয়ে ভাব দেখাচ্ছে যে এটা আমার ব্যাপার না। কিন্তু সে ভিতরে ভিতরে তার বুক ফেটে যাচ্ছে এই কথা শুনে।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দা থেকে চলে গেলাম। আপির মনে হয় এখন একটু একা থাকা দরকার।
মোবাইলের গুনগুন আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
মোবাইল আমি কখনো নিজের বিছানায় রাখিনা। যখন তখন কেউ ফোন দিয়ে সাধের ঘুম নষ্ট করে দিতে পারে। এখন আমার কাচা ঘুম নষ্ট হয়ে গিয়েছে, ঘড়ির দিকে তাকালাম প্রায় দেড়টা বাজে। আমি নিজের রুমে ডিম লাইট লাগিয়ে রাখি। হালকা হলুদ আলোয় টেবিলে রাখা অ্যালার্ম ক্লকে সময় দেখতে আমার কোনো সমস্যা হল না।
অপরিচিত নাম্বার। ভাবলাম রেখে দেই কিন্তু পরে কি মনে করে কলটা ধরলাম।
“বল দেখি কে ?”
এটা শোনার পর আমি কলটা সাথে সাথে কেটে দিলাম।
কে হতে পারে, আমি মনে মনে বলে উঠলাম। এত রাতে আমাকে তুই তোকারি করে জানতে চাইবে ‘বল দেখি কে’।
আপার কথা মাথায় প্রথমে আসলেও সেটা বাদ দিতে হল। আপা ঘুম কাতুরে মহিলা। সে কাচা ঘুম ভেঙ্গে আমার ঘুম ভাঙ্গতে যাবে না।
তাহলে কে ?
আমার এই উত্তর দেবার জন্য আমার মোবাইল আবার গুনগুন করে উঠল। মোবাইলের রিংটোন আমার পছন্দ না তাই সবসময় ভাইব্রারেশন মোডের দিয়ে রাখি। এটার জন্য অনেকে কাছে ঝাড়ি খেলেও আমি সেটা এক কানে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছি।
আমি আবার কল ধরলাম।
এবার মেয়েলী গলায় বলে উঠল, “আরে গাধা আমি রুপা? কল কাটলি কিসের জন্য?”
রুপা!
“এত রাতে ফোন কিসের জন্য?”
“না, ভাল লাগছিল না, আর আজকে তুই হুট করে কলেজ থেকে চলে গেলি। মাশফিয়ার ব্যাপারে কি হল সেটা জানতে পারলাম না।”
“হঠাৎ করে তুই তোকারি?”
“না, মনে হল তোর সাথে তুই তোকারি ভাবে শুরু করলে আরো ভাল ভাবে ফাজলামি করা যাবে,” এই বলে রুপা হালকা হেসে উঠল। ফোনের ওপাশ থেকে তার হালকা হাসির আওয়াজ পেলাম।
“ভাল, তা কিসের জন্য ফোন দিয়েছিস এত রাতে?”
সে যখন তুই তোকারি করতে পারে তখন আমার করতে দোষ কোথায়!
“না, আজকে মনে হয় কিছু হয়েছে মাশফিয়ার সাথে তোর।”
রুপা একদম ঠিক জায়গায় ধরতে পেরেছে।
“কি হয়েছে আমাকে বলা যায়,” রুপা বলতে লাগল, “আমি অবশ্য কাউকে বলব না।”
আমি চুপ করে থাকলাম।
“না বলতে চাইলে না বলিস,” রুপা বলে উঠল, “তবে আমার মতে মাশফিয়ার প্রতি তোর দুর্বলতা এসে পড়ে তাহলে এত তাড়াতাড়ি কিছু করতে যাস না। একটু দেখে শুনে করিস।”
“কেন?” আমি এবার জিজ্ঞেশ করলাম।
“আসলে মেয়েটা চলে খেয়ালের বশে,” রুপা একটু থেমে বলল, “আমি জানি না, তবে মনে হয় তুই আরো কয়েকদিন চুপ করে থাক, তার ভাবগতি দেখ তারপর না হয়…”
“না, ওর প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই,” আমি রুপার কথা বাধা দিয়ে বললাম, “আপাতত আমি কোনো মেয়ের সাথে রোমান্টিক সম্পর্ক করতে আগ্রহী নই, মাত্র তো কলেজে উঠলাম।”
“হুম,” এই বলে রুপা চুপ মেরে গেল, তারপর সে বলে উঠল, “সেটা তোর ইচ্ছা।”
“তা তুই কি এটা জানার জন্য আমাকে ফোন দিয়েছিস নাকি?”
“মনে হয়,” রুপা জবাব দিল।
“মনে হয় মানে?”
“আমি জানিনা, তবে এর ভিতর আরো ব্যাপার-স্যাপার আছে,” রুপা বলল, “একটা মেয়ে অফার দিল, তুই রাজী না বলে হুট করে কলেজ বাদ দিয়ে চলে গেলি। আমার কাছে কেমন যেন সন্দেহজনক লাগছে।”
রুপার কথা আমি চুপচাপ শুনতে লাগলাম।
“আচ্ছা মাশফিয়া কি তোকে কিছু বলেছে নাকি?” রুপা জিজ্ঞেশ করল।
আমি চুপ করে আছি দেখে রুপা বলে উঠল, “আরে বেটা বল না, আমার কাছে শেয়ার করতে তোর সমস্যা নাই, মনে কর তুই আমার কাছে উপদেশ নিতে এসেছিস।”
“কি ব্যাপার এত আগ বাড়িয়ে সব কিছু জানতে চাইছিস?” আমি এবার প্রশ্ন করলাম।
“না, এমনি। জানতে চাইলাম আরকি।”
“হুম।”
“শোন, তোর যদি কোনো সমস্যা থাকে তাহলে আমাকে জানাস। আমি সমাধান না করে দিতে পারলেও সান্ত্বনা দিতে তো পারব।”
“তোর কি সাইক্রিয়াটিস্ট হওয়ার ইচ্ছা আছে নাকি ?”
“কারেক্ট মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড, এটা আমার অনেক দিনে শখ,” রুপা উচ্ছাস নিয়ে বলল।
“বলতে গেলে পাগলের ডাক্তার,” খোচা দিয়ে বললাম।
“আরে আসল পাগলের চেয়ে ভদ্র পাগল অনেক খারাপ, তাই ভদ্র পাগলদের চিকিৎসার জন্য আমি আমার জীবন উৎসর্গ করে দিলাম।”
“আরে বাপরে !”
রুপার সাথে কথা বলতে বলতে মন দেখছি কিছুটা ভাল হয়ে গেল। ঘড়ির দিকে তাকালাম দুইটার বেশী বাজে।
“আচ্ছা অনেক কথা হল, কাল কলেজে দেখা হবে,” আমি বলে উঠলাম।
“হুম, কথা বলতে বলতে সময় কিভাবে চলে গেল টের পেলাম না, আচ্ছা ঠিক আছে।”
ঠিক আছে, এই বলে আমরা কথা শেষ করলাম।