আমাদের সময়ে সেদিন মার্চের ২৯ তারিখ সংখ্যায় প্রোব বার্তা সংস্থার প্রতিনিধি ইরতিজা নাসিম আলীর প্রণীতএকটি সাক্ষাৎকার প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। সেখানে নেপালে নিযুক্ত ইজরেলের রাষ্ট্রদূতের বরাত দিয়ে ইরতিজা আমাদের জানাচ্ছেন যে, ১৯৭১ এ ইজরেলই আমাদের প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল (১৯৭১ সালে যারা সেই ভয়াবহ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাদের হয়তো একথাটি মনে আছে)। এছাড়াও ইজরেলের আরো একজন প্রতিনিধির উদ্ধৃতি দিয়ে সেখানে দেখানো হয়েছে যে ইজরেল আমাদের কত ভালোবাসে। তাদের দরজা আমাদের জন্য উন্মুক্ত আর তারা চায় আমাদের সাথে তাদের সবকিছু জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রকৌশল-শিল্প আর বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ ভাগাভাগি করে নিতে।
বারবার সেখানে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, মুসলমানদের সাথে ইহুদিদের কোন বিরোধ নেই আর প্যালেস্টাইনিদের সাথে ইজরেলের বিরোধ মূলতঃ রাজনৈতিক। কাজেই বাংলাদেশের উচিত ইজরেলের সাথে অবিলম্বে সম্পর্ক স্থাপন করে উন্নতির পথে ধাবিত হওয়া।
সেখানে আবার একটু পরেই দেখা যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসনের অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহর সমর্থন। তার নিজেরও মত যে, বাংলাদেশের উচিত ১৯৭১ এর সমর্থনের
জন্য কৃতজ্ঞ থেকে আর বর্তমান বিশ্ববাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে ইজরেলের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা।
লেখাটি পড়ে আমার মনে বেশ কিছু প্রশ্নর জন্ম হয়েছে।
কোন কোন রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ কূটনৈতিক এবং অন্যান্য সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে তা নিতান্তই বাংলাদেশ সরকারের, রাষ্ট্রনীতি, ভূ-রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি এবং আরো কোন কোন অপ্রকাশ্য নীতির ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে বলেই আমার মত মূর্খ পাঠকের ধারণা। ইরতেজা নাসিম আলি/প্রোব বার্তা সংস্থা সেখানে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ইজরেলের রাষ্ট্রদূতের সাথে কথা বলে এসে উপকারিতা বর্ণনা করতে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই কেমন যেন মনে হতে থাকে যে কোথায় যেন কী আছে তা আমরা ঠিক জানতে পারছি না। ইরতিজা নাসিম আলী অনেকদিন ধরেই সাংবাদিকতা করছেন জানি। বাংলাদেশের প্রকাশ্য, গোপন অনেক স্তরেই তার সংবাদসূত্র রয়েছে।তার লেখা আরো তথ্যবহুল হলে আমাদের মত আম পাঠকের সুবিধা হতো বুঝতে কেন হঠাৎ করে ইরতিজা নাসিম আলী ইজরেলের রাষ্ট্রদূতের সাথে কথা বলতে গেলেন নেপালে। নাকি এই দেখা অনেক তোরজোর আর পরিকল্পনার ফল কিন্তু তা ঠিক পরিষ্কার হলো না কোন পটভূমি বর্ননা না করায়।
আমরা জানি ভারতের সাথে ইজরেলের সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। ভারতে তথাকথিত সন্ত্রাসবাদ বিরোধী প্রশিক্ষণ আর সামরিক প্রকৌশল বিক্রয় ইজরেলের একটি বড় স্বার্থ। সেখানে ইজরেলের রাষ্ট্রদূতের সাথে কথা বলতে হলে একজন সাংবাদিক হয়তো ভারতেই যেতে চাইবেন, নেপালে নয়। আর ইরতিজা নাসিম আলী ঠিক কোন প্রণোদনা পেয়ে ইজরেলের রাষ্ট্রদূতের সাথে দেখা করলেন বাংলাদেশের সাথে তাদের পুরোনো প্রেম নবআবিষ্কার করতে সেটা জানতে পারলে আমরা তার এই প্রেরণা সম্পর্কে জানতে পারতাম।
অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ এর আগেও একবার আমাদের সময়ে ইজরেলের সাথে সম্পর্ক করার উপকারিতা নিয়ে বলেছেন। এখন আবার সরব হলেন। ইজরেলের পক্ষে অধ্যাপক সাহেবের এই কলমধরা বেশ কৌতুহলোদ্দীপক। ছাত্রাবস্থায় জামাত-শিবিরঘেষা এই বুদ্ধিজীবি জোট সরকারের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালোয়র প্রোক্টরিয়াল দায়্ত্বিপালনকালে রোকেয়া হলের ছাত্রীদের ওপর পুলিশি হামলার কারণে নিন্দা-ধিক্কার অর্জন করেছিলেন।
বোঝা যাচ্ছে ইজরেল বাংলাদেশে বেশ ভালভাবেই নেমেছে লেজিটিমেসি অর্জন করার জন্য। আর সেজন্য মিডিয়া, বুদ্ধিজীবিমহল সহ আরো অনেক বর্তমানে অপ্রকাশ্য জায়গায় তাদের প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে।
এর আগেও কোন এক তথাকথিত সাংবাদিক সালাউদ্দিন শোয়েব চৌধুরি ইজরেলের পক্ষে লিখে সোরগোল তুলেছিলেন। তিনি ইজরেলের ভিসা নিয়ে সেখানে ওড়ার পথে আটক হয়েছিলেন বিমানবন্দরে।
সহৃদয় পাঠকের হয়তো মনে আছে, ইজরেল থেকে বাংলাদেশযাত্রী একদল "তাবলীগি" কোলকাতা বিমানবন্দরে আটক হয়েছিলেন বছরখানেক আগে ইমিগ্রেশনের সন্দেহভাজন হওয়ায়।
বোঝা যায়, ইজরেল বাংলাদেশের সমর্থন পেতে বেশ উদ্বিগ্ন। ইরতিজার প্রতিবেদনে এক ইজরেলী কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে ইজরেল জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সাথে নিয়মিত কথা বলে থাকে। কথাটি সত্য হতেও পারে, নাও পারে, কিন্তু তার ওপর ভিত্তি করে তো
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পাল্টাতে পারেনা।
১৯৭১ সালে ইজরেল আমাদের সমর্থন দিতে চেয়েছিল সেজন্য আজ আমাদের উচিৎ হবে তাদের সাথে সম্পর্ক করা, যুক্তিটি ঠিক আমি বুঝতে পারিনি।
ইজরেল বর্তমান বিশ্বের একমাত্র ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র যা এক বিভৎস শ্রেষ্ঠত্ববাদী বর্ণবাদী ধারণা যায়নবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যায়নবাদ মনে করে যে, ইহুদিরা সৃষ্টিকর্তার মনোনীত শ্রেষ্ঠ মানুষ আর ইজরেল তথা প্যালেষ্টাইন তাদের জন্য ঈশ্বরকর্তৃক প্রতিশ্রুত একটি ভূখন্ড। যায়নবাদীরা নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ আর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে প্যালেস্টাইনের অধিবাসীদের নিজ ভূখন্ড থেকে বিতারিত করে প্রতিষ্ঠা করে
ইজরেল। প্যালেস্টাইনে ইজরেল পরিচালিত হত্যা, জুলম, দমননীতির বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত জাতিসংঘে নেয়া দুশোর ওপরে প্রস্তাব ইজরেল অবজ্ঞা করে গেছে কোনরকম শাস্তির ভয় ছাড়াই।
মধ্যপ্রাচ্যে ইজরেলের বৃহত্তর ইজরেলের স্বপ্নের জন্য হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হচ্ছে নারী-শিশুসহ অসংখ্য মানুষ।
বছরে ২০ বিলিয়ন ডলার মার্কিন সাহায্য পাওয়া এই দেশটি তাদের বিভিন্ন যায়নবাদী সংগঠনের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে মার্কিন কংগ্রেসকে হাতের মুঠোয় রাখে।
সেই ইজরেলের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক স্থাপন কেন ইরতিজা গংদের উদ্বেগ হয়ে উঠেছে তা জানা দরকার আমাদের।
ইজরেলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ বিভিন্ন দেশে তাদের প্রভাব বিস্তারে কাজ করে যাচ্ছে। এজন্য তারা অর্থ, ভয়-ভীতি, আর অন্যান্য লোভ-লালসার ব্যবহার করে থাকে বলে জানা যায়। আমাদের দেশে যারা ইজরেলের হয়ে লবিং করছেন তারা ঠিক কোন কারণে ইজরেলের বশীভূত হয়েছেন তা জানা দরকার বোধহয় আমাদের।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০১০ রাত ৩:৫১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



