টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ ছিল ওটি। আর এই প্রফেট হলেন মাওলানা ভাসানী। সময়টা উত্তাল উনসত্তর।
সেই রিপোর্টিংয়ের কারনেই কিনা বলতে পারব না, মাওলানার সাক্ষাৎকার নিতে এলেন এক ফরাসী মহিলা সাংবাদিক। পরের ঘটনা বলছি হায়দার আনোয়ার খান জুনোর বই "আগুনঝরা সেই দিনগুলো" থেকে-
"একটা গাড়ি জোগাড় করে পরের দিন সকালেই ফরাসি সাংবাদিককে নিয়ে রওয়ানা হলাম। রাস্তার দুই পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে তিনি বিদেশিদের মতো স্বভাবসুলভ বিষ্ময় প্রকাশ করে 'হাউ বিউটিফুল' 'সো রোমান্টিক' ইত্যাদি বলে চলেছেন। এরই ফাঁকে ফাঁকে তিনি গনঅভ্যুত্থান, মাওলানা, বামপন্থীদের ভূমিকা বিষয়ে প্রশ্ন করতে থাকেন।
আমরা যখন সন্তোষে ভাষানীর বাড়িতে পৌছাই তখন সকাল দশটা হবে।ভাসানী তাঁর একচালা টিনের ঘরের সামনে একটা ভাঙ্গা চেয়ারে বসে আছেন। গায়ে ছেড়া গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি। মাথায় চির পরিচিত তালপাতার টুপি। চেয়ারের পাশে একটা কুকুর শুয়ে আছে।
মহিলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম,
- হুজুর ইনি একজন ফরাসি সাংবাদিক।আপনার সাক্ষাতকার নিতে এসেছে।
ভাসানী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কুকুরের উদ্দেশ্যে দুইবার যা যা বলে মহিলাকে সামনের চেয়ারে বসতে বলে নিজে তাঁর ঘরে ঢুকলেন। কিছুক্ষন পরেই ভাসানী ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন। ছেঁড়া গেঞ্জির ওপর তিনি একটা সাধারণ পাঞ্জাবি চাপিয়েছেন। আর হাতে একটা পুরানো ট্রের উপর এক কাপ চা ও কয়েকটি বিস্কুট।
সাংবাদিক অবাক বিষ্ময়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলেন। তারপর হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ভাসানী মহিলার সামনের টুলে চা ও বিস্কুট রেখে বললেন -
- বাঙালীরা এমনিতেই অতিথি পরায়ণ। আর তুমি সাংবাদিক, তার উপর মহিলা। ঠিক মতো আপ্যায়ণ করার যোগ্যতা আমার নেই।
এরপর শুরু হলো সাক্ষাতকার- ভাসানী বাংলায় আর সাংবাদিক ইংরেজীতে। আমি সাধ্যমতো অনুবাদ করে যাচ্ছি। এক বার ভাসানী আমাকে থামিয়ে দিয়ে, 'নো নো আই মিন' বলে সুন্দর ইংরেজীতে তাঁর বক্তব্যটা তুলে ধরলেন।
এই আলোচনার মধ্যেই গ্রামের বহু লোকে উঠান ভরে গেছে। অনেকেই ভাসানীর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করছে। ভাসানী তাদের বললেন, এখন যাও রে বাপু, পরে এসো। দেখছো না, আমি একজন বিদেশির সাথে কথা বলছি।
প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে সাক্ষাতকার চললো। উঠে আসার সময় একজন কৃষক দুটো পাঁকা পেঁপে ভাসানীকে দিলেন। তিনি নিজ হাতে পেঁপে দুটি মহিলার হাতে দিয়ে বললেন -
এখনই গাছ থেকে পাড়া। খুব মিষ্টি। বাসায় গিয়ে খেও।
গাড়িতে ওঠার সময় দেখি মহিলার দু'চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। তিনি ভেজা গলায় বললেন ,
ইওর মাওলানা ইজ রিয়েলি প্রফেট।
কাজী মাহমুদুল হক এর ওয়াল থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ১০:৪৭