somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিশুসুরক্ষাকারী যৌন শিক্ষা: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ (পর্ব -১)

০৪ ঠা জুলাই, ২০১২ রাত ৯:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শিশু নির্যাতনের নানারকম ধরণ আছে যেমন শারীরিক, মানসিক নির্যাতন. এর মাঝে শিশু যৌন নির্যাতন এমন একটা বিষয় যেটা শারীরিক, মানসিক উভয় ধরনের ক্ষতির কারণ হয় একটা শিশুর জন্য. এই শিশুরা অনেক সময়ে বুঝতেই পারে না তাদের উপর দিয়ে কি ঘটে যাচ্ছে. সারা পৃথিবী জুড়ে এইডস বা এইচআইভি নিয়ে মিডিয়াগুলোতে অনেক অনেক কথা হয়, বিভিন্ন দেশের সরকারের তরফ থেকে নানারকম ব্যবস্থা নেয়া হয়. সে তুলনায় শিশুর একেবারে কাছের জগতে, ঘরে-স্কুলে তার উপর দিয়ে যেসব নিরব নির্যাতন ঘটে যায় সেসবের খবর হয় খুব কমই.

আবার অন্যান্য নির্যাতনের ঘটনা যতটা রিপোর্ট হয় মিডিয়াগুলোতে, সে তুলনায় একেবারে নিকট আত্মীয় বা পরিচারিকা বা শিক্ষক কর্তৃক যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের ঘটনা তো তেমন রিপোর্টই হয় না বললে চলে. এ ব্যাপারে শিশুরা মুখ খুলে খুবই কম. যে পরিবারে শিশুদের পর্যাপ্ত যৌন শিক্ষা দেয়া হয় না, শিশুকে তার যৌনাঙ্গসমূহের নাম ঠিকভাবে শেখানো হয় না, যেসব রক্ষনশীল পরিবারে শিশুদের স্বাভাবিক ও ক্ষতিহীন শিশুসুলভ যৌনতা বিষয়ক আগ্রহ দেখে বা এ বিষয়ক প্রশ্ন শুনে বাবা-মা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়, বাবা-মা সাবলীলভাবে শিশুদের সাথে এসব বিষয়ে কথা বলে না, সেসব পরিবারের শিশুরা কোন রকমের যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও চেপে যায়. এমনকি অনেকে বিশ্বাসও করতে চায় না যে তার পরিবারের নিকটজনের মাঝেই শিশু নির্যাতনকারী থাকার সম্ভাবনা আছে. বাবা-মা, ভাই-বোন, চাচা-মামা, দাদা-দাদী যে কারো দ্বারাই এমনটা ঘটে যেতে পারে.

শিশু যৌন হয়রানি/ নির্যাতনের নানান ধরণ আছে, অস্বস্তিকর স্পর্শ, শিশুদের আড়ালে নিয়ে বিভিন্ন রকম অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, বা নানান রকম অশ্লীল কথা বলা, পর্ণ দেখানো বা করতে বাধ্য করা ইত্যাদি. এসব বিষয়ে পরিষ্কার ধারনা থাকবার জন্য যেটা দরকার সেটা হলো শিশুদের অল্প বয়স থেকেই সুস্থ যৌন বিষয়ক জ্ঞান দেয়া যাতে করে অপ্রত্যাশিত স্পর্শগুলো বা ঘটনাগুলো বুঝতে পারে এবং বাবা-মার কাছে এসে মুখ ফুটে বলতে পারে যে কে তাকে কি করেছে বা কি বলেছে. আর এরকম সাবলীলভাবে যদি বলতে না পারে, তাহলে শিশুদের সুস্থ মানসিক বিকাশে এটা একটা বড় বাঁধা হয়ে উঠতে পারে. শিশুরা হয়ে যেতে পারে বিষন্ন, ব্যক্তিত্বহীন, হীনমন্য, ভীতু, শিশুটি ভুগতে পারে নিরাপত্তাহীনতায়.

খোদ আমেরিকা, বৃটেনের মতো জায়গাতেই শিশুদের প্রয়োজনীয় যৌন শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারে জনগনের একটা বিশাল অংশ রক্ষনশীল মনোভাব দেখিয়েছে… বিশেষ করে স্কুলে যৌন শিক্ষা দেবার ব্যাপারেই বেশি আপত্তি এসেছে. ২০১১ সালে বৃটেনের পার্লামেন্টে ‘যৌন শিক্ষা বিল‘ পাশ হয়েছে ৬৭-৬১ ভোটে. সেটাতে ১৩-১৬ বছর বয়সী মেয়েদের অতিরিক্ত যৌন শিক্ষা দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে. এক অনলাইন জরিপে ১৭০০ অভিভাবকের মধ্যে শতকরা ৫৯ জনই এর বিরোধিতা করেছেন. তাদের বেশির ভাগেরই এই মনোভাব শিশুদের যৌন শিক্ষা দেয়া উচিত নয়. যারা বিলটিতে দ্বিমত জানিয়েছেন তাদের মাঝে ৪১ ভাগ এটা বলেছেন. ২৮ ভাগের মত হলো এটা বাবা-মার পছন্দের উপর ছেড়ে দেয়া উচিত. ২৭ ভাগের মত হলো শিশুদের এ ধরনের শিক্ষার দরকারই নাই. ২২ ভাগ বলেছেন এতে করে শিশুরা আরো বেশি যৌনতার ব্যাপারে আগ্রহী হবে.

বাবা-মাদের অনেকেই এ ব্যাপারে কথা বলতে অস্বস্তিবোধ করেছেন. অথচ জরিপে দেখা গেছে প্রতি ছয়জনে একজনের বেশি অভিভাবককে তাদের শিশুরা যৌন বিষয়ক প্রশ্ন করেছে. এবং সেটা ৪ থেকে ৭ বছর বয়সেই. জাতীয় শিশু ব্যুরোর এক ফোরামে বলা হয়েছে যৌন শিক্ষা বিষয়ে সবাই এক ধরনের অস্বচ্ছ বা ভুল ধারনা পোষণ করেন. তিন থেকে ছয় বছরের একটা বাচ্চার জন্য যৌন শিক্ষা হতে পারে কোথা থেকে একটি শিশু জন্ম নেয় (মায়ের গর্ভ), ছেলে আর মেয়ের শারীরিক পার্থক্য, নিজের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের নামসমূহ ইত্যাদি. আবার মাধ্যমিক স্কুলে আরো বিস্তারিতভাবে আসতে পারে, কিভাবে বন্ধুবান্ধব বা সঙ্গীর কাছ থেকে মানসিক চাপ সামলাবে, রাগ, দু:খ, চাহিদা, ভালোবাসা – এ জাতীয় গভীর অনুভুতিগুলো কিভাবে প্রকাশ করবে, একটা সম্পর্ক থেকে কি আশা করা যেতে পারে – এরকম.

এখন পর্যন্ত বৃটেনের স্কুলগুলোতে যৌন শিক্ষা বাধ্যতামূলক নয়, ঐচ্ছিক. শুধুমাত্র জীববিজ্ঞানের মৌলিক শারীরিক বিদ্যাটুকুই মূল সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত, আমাদের দেশেও মাধ্যমিক পর্যায়ে কেবল জীববিজ্ঞানের সিলেবাসটুকুই আছে, আর কিছুই নেই.

এদিকে স্কুলে বড়শিশুদের দ্বারা বা কর্মচারী বা শিক্ষক কর্তৃক ছোট শিশুদের নানারকম যৌনহয়রানিমূলক ঘটনা ঘটছে. আজকের এই তথ্য প্রযুক্তি যুগে শিশুদের মাঝে অনেকে পর্নোগ্রাফির খোঁজ পেয়ে যাচ্ছে, সেগুলো দেখছে, আমাদের দেশের শহরাঞ্চলেও এর প্রকটতা বাড়ছে দিনে দিনে. তাই যারা শিশুদের জন্য নিরাপদ যৌন শিক্ষা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছেন তাদের মতামত হলো বাচ্চাদের সচেতন করতে হলে বাবা-মাকেই সবার আগে উদ্যোগী হতে হবে. পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ভিতরে থেকে কতটুকু যৌন শিক্ষা তাদের দেয়া যেতে পারে যাতে করে শিশুরা নিরাপদ থাকবে এবং যথেষ্ট জানবে এটা নিয়ে বাবা-মাদেরকেই ভাবতে হবে এবং বাবা-মাই এক্ষেত্রে প্রথম শিক্ষক হবেন.

অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত গবেষনাপত্রে গবেষকরা জোর দিয়েছেন মূল চারটি বিষয়ের প্রতি, শিশু নিরাপত্তা, যৌন শিক্ষা, সুস্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতনতা এবং মূল্যবোধ. এই মূল চারটি বিষয়ের কথা মাথায় রেখে বাবা-মায়েরা যেসব টপিকে শিশুদের সচেতন করতে হবে সেগুলো হলো:

১. দেহের বিভিন্ন অংশের নাম এবং মানব জন্মের প্রক্রিয়া,

২. সুস্বাস্থ্যের অধিকারী দেহের ছবি, কিভাবে সুস্বাস্থ্য রক্ষা করতে হয় প্রাকৃতিকভাবে,

৩. নারী-পুরুষের সম্পর্ক সন্বন্ধে সঠিক জ্ঞান,

৪. অপরিচিতদের দ্বারা কি বিপদ ঘটতে পারে (এটা পরিচিতদের দ্বারাও হতে পারে)

৫. পর্ণোগ্রাফি এবং ক্ষতিকর মিডিয়া

৬. তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার

৭. জেন্ডার ইস্যু

৮. শিশু নিরাপত্তা

অস্ট্রেলিয়ান গবেষকরা বাবা-মার ভূমিকার উপরেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন. বাবা-মাকেই পূর্ণ উদ্যোগ নিতে হবে কিভাবে শিশুদের সাথে যৌন বিষয়ক কথাবার্তা সাবলীলভাবে বলা যায়, সচেতন করে তোলা যায়, কেবলমাত্র স্কুল কারিকুলামের উপর নির্ভর করে থাকলে চলবে না. তবে এতে করে যেটা দরকার সেটা হলো বাবা-মাকেই এসব ব্যাপারে আগে স্বচ্ছ ধারনা নিতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে বাচ্চাদের কোন বয়সে কোন শিক্ষাটা কতটুকু দিতে হবে. এজন্যে বাবা-মাকে উত্সাহ দেবারও দরকার আছে. এছাড়া স্কুলের সিলেবাসে শিশুদের বয়স অনুযায়ী যৌন শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে বাবা-মাদেরকেই সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে শিক্ষকদেরকে সহায়তা করতে হবে. তবে মূল দায়িত্ব বাবা-মাদেরই শিশুদেরকে সঠিক মূল্যবোধের ভিতরে যৌন নিরাপত্তা বিষয়ক শিক্ষা দেয়া. এজন্যে বিভিন্ন সংস্থা থেকে সেখানকার বাবা-মাদেরকে উত্সাহ দেয়া হয়, প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ দিয়ে সাহায্য করা হয়.

চলবে …
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১২ রাত ৯:৩১
৬৭টি মন্তব্য ৪৫টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×