দৈনিক প্রথমআলোতে সেদিন শিরোনাম পড়ে আমার তৎক্ষণাৎ যা মনে হলো তা হলো “আরে সাব্বাশ!” সাংবাদিকেরা যে আমার মতো এতো উচ্ছসিত ছিলেন না তা স্পষ্ট বোঝা যায় সেদিন আর পর পর ক’দিনের সংবাদপত্রে, ওয়েবসাইটে। একটু গুতো মারতে গুগলে ক্রিকইনফো আর নানান সংবাদপত্রের লিংক চলে আসে। সেখানেও সেই একই রকম একগুঁয়ে মূলভাব, “বাংলাদেশের বিদ্রোহী ক্রিকেটারেরা টাকার লোভে দেশের সাথে বেঈমানী করেছে!”
সাংবাদিকরা খুব সহজেই এই তেরো ক্রিকেটারদের গায়ে “বিদ্রোহী”, “বিশ্বাসঘাতক”, “অর্থলিপ্সু” তকমা লাগিয়ে দিলেন। কেনো? এই তেরোজনের মধ্যে জাতীয় দলে ছিলেন মোটে ছয়জন (আফতাব, কাপালী, নাফিস, রেজা, ধীমাণ আর মোশাররফ)। তাও জানার উপায় নেই এদের মধ্যে ক’জন নিউজিল্যান্ড সিরিজে সুযোগ পেতেন। রফিক আগেই অবসর নিয়েছেন। হাবিবুলের অবস্থানও তেমন মজবুত ছিলো না। বাকিরা কেউ জাতীয় দলে খেলেনি। কথা ঠিক এদের পেছনে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড শ্রম দিয়েছে অর্থ ঢেলেছে। কিন্তু তা তো মাগনা নয় খেলার বিনিময়ে।
আজকের বিনোদন-বাজার ও পেশাদারিত্বের যুগে খেলা আর শখ নেই। আয়োজকেরা হয়ে গেছেন ব্যবসায়ী আর খেলোয়াড়েরা চাকুরে। এখানে আবেগ কিংবা ঠুনকো মূল্যবোধের কোনো দাম নেই। আমার আগের লেখাতেও ঠিক এই কথাটিই বলেছিলাম। বলেছিলাম বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের পেশাদারিত্ব শিখতে হবে। আমাদের “তথাকথিত” বিদ্রোহী তেরো খেলোয়াড় কিন্তু হাতে-কলমে ঠিক তাই দেখিয়ে দিলেন। চলে যাবার কারণ হিসেবে তারা বলেছেন তাদের সাথে করা অনাচার/অবিচার। অর্থ নয়। তবে সেটি এখানে বিবেচ্য নয়। যা বিবেচ্য তা হচ্ছে - নিজেদের পরিস্থিতি বিচারে তারা পেশাদারের মতো সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। তাদের এই সিদ্ধান্ত হয়তো বিসিবিকেও পেশাদারিত্ব শেখাবে। দেখাবে বাঙালি ক্রিকেটারদের যাবার অন্য জায়গাও আছে।
আচ্ছা বাদ দেই না-হয় এসব আলোচনা। বরং আইসিএল কেনো বিদ্রোহী হলো তার কারণ শুনি। তারা তাদের নিজেদের টুর্নামেন্ট চালু করেছে। তো? ক্রিকেটাররা ক্রিকেটই খেলছেন। ভালো কোচ পাচ্ছেন। উন্নত ট্রেনিং সুবিধা পাচ্ছেন। এমনকি নিজের দেশ কিংবা শহরের নাম পিঠে চড়িয়েই খেলতে পারছেন। এ-কি দোষের কিছু? কেনো আইসিএল-এ খেললে সেই খেলোয়াড়কে নিষিদ্ধ করা হবে? বিসিসিআই আর আইসিসি কি ক্রিকেট কিনে রেখেছে যে তাদের কথা ছাড়া ক্রিকেট খেলা যাবে না?
দোষ আসলে সেখানে নয়। দোষ হচ্ছে হচ্ছে বিসিসিআই এই খেলা থেকে অর্জিত টাকার কোনো ভাগ পাচ্ছে না। একদম সংক্ষেপে বলি। বিশ্বজুড়ে ক্রিকেটের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বিসিসিআই। আর এই কারণে কোনো দেশই ওদেরকে ঘাঁটাতে সাহস পায়না। আইসিসি তো অনেক আগে থেকেই বিসিসিআই-এর পকেটে ঢুকে বসে আছে।
এরপরে আছে ভারতের প্রাদেশিক রাজনীতি। শক্তিশালী প্রদেশগুলো সবাই ভারতীয় জাতীয় দলে তাদের এক/দুইজন খেলোয়াড় দেখতে চায়। অনেক ভালো খেলোয়ার এজন্য বাদ পড়ে যায়। ম্যাচ গড়াপেটা আর বাজীর ব্যাপার-স্যাপারও আছে বলে কপিল দেব ও অন্যান্যরা প্রায়ই ইঙ্গিত দেন। সব মিলিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটারদের একটি বড় অংশ বিসিসিআই এর উপর খাপ্পা।
অন্যদিকে ভারতের এসেল গ্রুপ চাচ্ছিলো ক্রিকেট ব্যবসার কিছু ভাগ পেতে। কিন্তু বিসিসিআই এর হর্তা-কর্তাদের সাথে ব্যক্তিগত ঝামেলা থাকায় একাধিক বার বেশি টাকার প্রস্তাব দিয়েও এসেল গ্রুপ ভারতের (কিংবা অন্য দেশের) ক্রিকেট সম্প্রচার স্বত্ত কব্জা করতে পারেনি। পরে তারা অনেকটা বাধ্য হয়েই বিসিসিআই এর উপরে যারা নাখোশ তাদের সঙ্গে নিয়ে নিজেরাই নিজেদের লীগ খুলেছে। এতে ব্যক্তিগত ভাবে আমি দোষের কিচ্ছু দেখি না।
আইসিএল-এর বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহের পেছনেও কিন্তু বানিজ্য আছে। ব্যাপার এরকম যে যতো বেশি দেশ আইসিএল-এ খেলবে ততো বেশি দর্শক। ততো বেশি বিজ্ঞাপন। আপনি মানুন আর না মানুন। সমর্থন করুন আর না করুন। ক্রিকেট ফ্যান হলে আপনাকে স্বীকার করতেই হবে যে ঢাকা ওয়রিয়র্স খেলতে শুরু করার পর থেকে আপনি এই টুর্নামেন্টের খবর রাখবেন। আর তা জানে বলেই দেশের সংবাদপত্রগুলোও সিরিজের আপডেট দেবে। এভাবে বাংলাদেশের মিডিয়া আর দর্শকের একাংশ কিন্তু ওদের হাতে চলে গেলো। পাকিস্তানের লাহোর বাদশাহস-এর আদলে বাংলাদেশ নিয়ে একটি দল করার ইচ্ছে তাদের গতবছরও ছিলো। সে সময় তারা আশরাফুলকে অফার দিয়েছিলো। শুনি সে নাকি নিমরাজীও ছিলো। পরে সেই পরিকল্পনা আর ব্যাটে-বলে হয়নি।
আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে আইসিএল ২০-২০ ইন্ডিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ঢাকা ওয়রিয়র্সের যাত্রা। প্রথম খেলা চেন্নাই সুপারস্টারসদের সাথে। আমি মনে প্রানেই ওদের সমর্থন দেবো। আমাদের মাটির ছেলে। বাংলাদেশের ছেলে। ওদের নামের সাথে জড়িয়ে থাকবে আমার এই হতভাগ্য দেশটিরও নাম। তাই আগামীকাল টিভিস্ক্রিন কিংবা ইন্টারনেট ব্রাউজারের সামনে আমাকে হাত মুঠো করে বসতেই হবে।
ঢাকা ওয়রিয়র্স… ফাটায়ালাও!
© অমিত আহমেদ
ছবি কৃতজ্ঞতা: Indian Cricket League
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০০৮ দুপুর ২:০০