পিলখানা বিডিআর সদর দপ্তরে গোলাগুলির খবর প্রথম পাই জিটকে এক বন্ধুর কাছ থেকে। তখনি বাঁধ ভাঙার আওয়াজ ব্লগে ঢুকি; দেখি ব্লগাররা ইতিমধ্যেই লাইভ ব্লগিং শুরু করে দিয়েছেন। এরপরে যোগ দেয় সচলায়তন আর ক্যাডেট কলেজ ব্লগ। আমি তিন ব্লগেই চোখ রেখে ঠায় বসে থাকি। মাঝে মাঝে নানান সংবাদ মাধ্যমের আপডেট; আমাদের আড্ডা সাইটে স্ট্রিমিং বাংলা ভিশন সংবাদ।
নানান গুজব এড়িয়ে পরে যখন নিশ্চিত খবর পাওয়া গেলো ভেতরে কী হচ্ছে তখন; একদম সত্যি কথা বলি; আমার প্রাথমিক চিন্তাটা ছিলো খুবই সরল, "দেখ, এবার মজাটা দেখ!" আমার সহানুভূতি বলেন সমর্থন বলেন আর পক্ষপাত বলেন; সবই ছিলো বিডিআর জওয়ানদের জন্য। ওরা বলেছে ওদের উপর সেনা অফিসারেরা নির্যাতন করে, দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। সেটা তারা কাদের সাথে করে না?
ভাই শোনেন,
খুব ছোটবেলায় মেজর আনোয়ারের লেখা "হেল কমান্ডো" পড়ে মাথায় মেজরের একটা কথা ঢুকে গিয়েছিলো, "নারীর প্রেমের চেয়ে আমার কাছে দেশপ্রেম অনেক বড়।" আমার স্বপ্ন হয়ে উঠেছিলো বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে ঢোকার। সময়ের সাথে কী হলো বলেন তো? কী হলো যে আমার সামরিক বাহিনীর নাম নেবার আগে একটা গালি বসাতেই হয়? কী হলো যে খোদ বাংলাদেশের সেনারা আটক আছেন শুনে আমার কোনো উদ্বেগ আসে না?
আমি জানি, আপনারাও জানেন, বেশির ভাগ বাংলাদেশীদের প্রাথমিক অনুভূতি এমনই ছিলো। এই ঘটনার প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের মানুষ সামরিক কর্মীদের কোনো সহানুভূতি দেখায়নি। আমার পরিচিত যে ক'জন মানুষ সামরিক বাহিনীতে আছেন তাদের সবার কথাতেই আমি প্রতিশোধ স্পৃহা ছাপিয়ে এই নিয়ে অভিমানটাই বেশি দেখেছি। বাংলাদেশের মানুষ আপনাদের এতটা অপছন্দ করে এটা ইউনিফর্মের আবরণ ভেদ করে আপনারা হয়তো কখনোই বুঝতে পারেন নি। ফেসবুকে সেনা বন্ধুর স্ট্যাটাসে দেখলাম দেশ জুড়ে অনেক তরুন সৈনিকই রেজিগনেশন লেটার জমা দিচ্ছেন। তাদের অভিমান, "দেশের মানুষ আমাদেরকে চায় না; আমরা কেনো সামরিক বাহিনীতে থাকবো?"
ভাইরে,
কখনো কী ভেবেছেন, কেনো বাংলাদেশের মানুষ আপনাদের প্রতি বিরূপ?
বাংলাদেশের মানুষ বারে বারে আপনাদের কাছ থেকে প্রতারিত হয়েছে। আমরা একাধিকবার সামরিক শাসন; ব্যর্থ ক্যু দেখেছি। আপনাদের গুলিতে আমাদের বন্ধুকে মরতে দেখেছি। আপনাদের বুটের তলে পাহাড়ি ভাই-বোনের অধিকার লুন্ঠিত হতে দেখছি। আচ্ছা, বাদ দেন না হয়! এগুলো জাতীয় সমস্যা। আমরা বাংলাদেশীরা আমাদের নিজেদের গায়ে আঁচ না লাগলে এত বড় ব্যাপারে মাথা ঘামাই না। সেই ব্যক্তি পর্যায়েও আমাদের অনেক কিছু দেখা হয়ে যায়। আমার হয়তো সংবাদপত্রে পড়া পাহাড়ি নির্যাতনের কথা মনে থাকবে না। কিন্তু ক্যান্টনমেন্টে লেন পরিবর্তন করার দোষে বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালাকে আপনাদেরই কারো একজনের লাথি মারার কথা মনে থাকবে। কারণ এগুলো আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে।
আপনারা শপথ নিয়েছেন, "জল, স্থল, অন্তরীক্ষে যেখানে যাইবার আদেশ হইবে সেইখানে যাইতে বাধ্য থাকিব।" শপথ নিয়েছেন, "জীবনের বিনিময়ে হইলেও বাংলার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করিব।" তাই যে কোনো সমস্যায় আমাদের আপনাদের কথা মনে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে, বিদেশী অতিথির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, সাফ গেমসে সোনার দৌড়ে টিকে থাকতে, এমন কী যানযট নিরসনে! এর সব হয়তো আপনার করার কথা ছিলো না। এসব কিছু করার শপথ হয়তো আপনি নেননি। গরীব আমাদের বিন্দু বিন্দু করে উপার্জন করা টাকাগুলোর একটা বড় অংশ চলে যায় প্রতিরক্ষা খাতে। তাই আমরা আপনাদের কাছ থেকে এসব দাবি করি। আমাদের মনে হয় না এগুলো বাড়তি কোনো কাজ। দেশের জন্য এই কাজগুলো করার সামর্থ্য আমাদের সবার নেই। আপনাদের আছে। তাই এই কাজগুলো করে যখন আপনারা যখন আমাদের আঙুল তুলে দেখিয়ে দেন তখন আমাদের ভালো লাগে না। যখন আপনারা আমাদের "ব্লাডি সিভিলিয়ান" বলেন, আমাদের ভালো লাগে না। আমাদের মনে হয় আমাদের খুব প্রিয় কেউ আমাদের গালে চড় বসিয়ে দিলো। বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে। আপনাদের মধ্যেও। আমাদের দেশ রক্ষার ভার যাঁদের হাতে, তাদের মাঝে দুর্নীতি আমাদের ভালো লাগে না।
কিন্তু ভাই,
আমাদের এই রাগ, এই ক্ষোভ, এই অভিমান আপনাদের উপর করার হক আমাদের আছে। কারণ আমরা আপনাদের ভালোবাসি। আপনারা আমাদের দেশের মানুষ। আমাদের ভাই। আমরা আপনাদের গালি দেই। কিন্তু ভিনদেশী কেউ দিলে আমাদের মাথায় রক্ত উঠে যায়। আমরা নিজেরা আপনাদের নির্যাতনের কথা বলি। কিন্তু ভিনদেশী কেউ জিজ্ঞেস করলে মাথা উঁচু করে লাইবেরিয়ার গল্প শুনিয়ে দেই। আমরা আপনাদের অবিশ্বাস করি। কিন্তু ভিনদেশী কাউকে বলতে একবিন্দু দ্বিধা হয় না যে আমাদের সেনা পৃথিবীর সেরা। আমরা আপনাদের খলনায়ক বলি। কিন্তু আমাদের সব চেয়ে জনপ্রিয় কল্পনায়ক "মাসুদ রানা"কে বানাই সেনা সদস্য। আমরা আপনাদের ভরসা করি না। কিন্তু দেশের যে কোনো সংকটে আমাদের আপনাদের কথা মনে পড়ে।
আমরা নিজেদের বাড়িতেই ঝগড়া করি, রাগ করি, চিল্লাই। পড়শীর বাড়িতে না। আমাদের ভালোবাসাকে ভুল বুঝবেন না। অবহেলা করবেন না।
বিডিআর বিদ্রোহের খবরে আমার প্রাথমিক অনুভূতি তো বললাম। পরের কথা বলি। যখন নিশ্চিত হই বিডিআর কার্যালয়ে সেনা খুন হয়েছেন, আমার বুক কেমন চিনচিনিয়ে ওঠে। পরে যেখন শুনি সেই সংখ্যা শতাধিক তখন আমার আর কিচ্ছু ভালো লাগে না! এক একটা লাশ উদ্ধার হয়। আমি মেহেদী মুছে না যাওয়া নববধূর কান্নার ছবি দেখি। বাবাকে হারিয়ে শিশুর চিৎকার দেখি। সহকর্মী হারিয়ে অন্য সেনাদের গোঙানি দেখি। আমার চোখ জ্বালা করে ওঠে। আমার নিজেকে খুব, খুব ছোট মানুষ হয়! সেনা ভাইদের পাশে দাঁড়াতে ইচ্ছে হয়।
আজ দেখুন, সারা দেশ জুড়ে মানুষ আপনাদের শোকে বিহ্বল হয়ে আছেন। প্রথম ধাক্কার সেই "ঠিকই আছে" মনোভাব আর নেই। আজ আমাদের সবার চোখেই জল। কেনো জানেন? কারণ স্বজনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা নারী-পুরুষ-শিশুর বেদনাক্লিষ্ট মুখ আমার মতোই সবার বুকে কাঁপ ধরিয়ে দিয়েছে। সবাই হঠাৎ করেই বুঝতে পেরেছে একজন সেনা আর কেউ নয়, রক্ত মাংসেরই মানুষ। তাদেরও মা আছে, বাবা আছে। ভাই-বোন-স্ত্রী আছে। তাদেরকেও কেউ "বাবা" বলে ডাকে। তারাও আমাদের মতোই ভাতের সাথে ডাল মাখিয়ে খান। ইলিশের মৌসুমে বাজার থেকে ইলিশ কিনে আনেন। বিকেলে স্ত্রীর সাথে টিভি দেখেন। রাতে সন্তানকে পড়া দেখিয়ে দেন। ছুটির দিনে মা'কে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যান। এমনটা তো আমরা সব সময় বুঝতে পারি না!
আমরা তিন দিন ধরে শোক পালন করবো। আমার মতো সারা দেশের মানুষই রাতে ঘুমাতে গিয়েও শুধু এপাশ-ওপাশ করবেন। কারণ আমাদের ভাই খুন হয়েছেন; আমাদের ভাইয়ের হাতেই। এ যে কতো বড় কষ্ট, কতো বড় বেদনা; এই কষ্ট আর বেদনা যেনো আর কোনো বাংলাদেশীর কোনো দিনও পেতে না হয়। বিডিআরের প্রতি আপনাদের ক্ষোভ আমরা বুঝি। খুনি বিডিআর জওয়ানদের বিচার হোক; শাস্তি হোক। এটা আমি চাই; সারা দেশের মানুষ চায়। কিন্তু রক্তপাত করে সেই শোধ তুলবেন নারে ভাই। একই কষ্ট আমাদের আরেকবার দেবেন না। বিচার ব্যবস্থায় ভরসা রাখুন।
বিডিআর বিদ্রোহ আসলেই বিদ্রোহ ছিলো কিনা তা নিয়ে এখন আমাদের সন্দেহ দানা বাঁধছে। অনেকেই অনেক রকম কন্সপিরেসি থিয়োরি নিয়ে আসছেন। কিন্তু তাদেরও তো ক্ষোভ ছিলো। অনেক জওয়ানও তো নিহত হয়েছেন। আচ্ছা থাক, এসব নিয়ে আমি কিচ্ছু বলবো না, শুধু বলবো এই যে এই বিভৎস হত্যাকান্ড আপনাদেরকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছে, এখান থেকে আর দূরে সরে যাবেন না। আমরা আপনাদের কাঁধে সমবেদনার হাত রাখতে চাই। আমরা আপনাদেরকে "ভাই" বলে ডাকার অধিকার ফেরত চাই। যে ভুলগুলো আগে হয়েছে, করে ফেলেছেন, সেগুলো আর করবেন না। আপনারা "দায়িত্ব" আর "সম্মান"-এর শিক্ষা পেয়েছেন। সেই শিক্ষা বিফলে যেতে দেবেন না। আমি জানি অল্পকিছু অফিসারের জন্য আপনাদের মাথাতে দুর্নীতির বোঝা চলে এসেছে। দায়িত্ব আর সম্মানের কথা চিন্তা করে তাদের একঘর করে ফেলুন। শুধু আপনারা কেনো, বদলাতে হবে আমাদেরকেও। এই মর্মান্তিক ঘটনা থেকে আমরা সবাই শিক্ষা নেবো। আমরা একাত্তরের চেতনায় নতুন করে দেশ গড়তে শিখবো।
ভাইরে,
আমাদের দেশের মানুষেরা খুব সরল। আমরা মনে রাখি না, ভুলে যাই। পরম শত্রুকেও আমরা ক্ষমা করে দেই। সেই ভালো মানুষীর সুযোগ নিয়ে রাজাকারেরা সংসদে আস্ফালন করতে পারে। কোথাকার কোন শর্মিলা বোস লিখে দিতে পারে একাত্তরে নারী ধর্ষণ হয়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্রপতির বিশেষ দূত জিয়া ইস্পাহানি শুয়োরের বাচ্চা বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে বলার সাহস পায়, "যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি উত্থাপনের সময় এখন নয়।" আর আপনারা তো আমাদের দেশের সূর্য সন্তান। আমাদের বুকে আপনাদের জন্য যে ভালোবাসা যে গর্ব ছিলো তা তো কখনো মুছে যায় নি! যেমন ছিলো তেমনই আছে। শুধু বারে বারে আমাদের ভালোবাসা ঠেলে দিয়েছেন বলে এতো দূরে সরে গেছে যে হঠাৎ যেনো আমরাও ঠাওর পাই না। আপনারা একধাপ নেমে শুধু একবার আমাদের কাতারে আসুন। এরপরে দেখুন আমরা আপনাদের জন্য কী করি! আমাদের দেশটাতে অনুসরণ করার মতো নায়কের খুব অভাব রে ভাই। একবার আপনাদেরকে নায়ক ভাবার সুযোগ দিন। দেখবেন, বাংলাদেশের মানুষ আপনাদের জন্য জান লাগিয়ে দেবে।
আমি, একজন বাংলাদেশী হিসেবে, বুকে হাত রেখে আজ আপনাদেরকে এই ওয়াদা করলাম!
© অমিত আহমেদ
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ বিকাল ৪:২১